পর্ব-১

১৯৮৫ সালে তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রকের নাম পালটে রাখা হয়েছিল মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক, এবং ১৯৮৬ সালে তৈরী হয়েছিল একটি জাতীয় শিক্ষানীতি। সেই শেষ, এবং তারপর দীর্ঘ তিরিশ বছরে সেই শিক্ষানীতিকে দ্বিতীয়বা্র আতশকাচের তলায় ফেলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেনি ভারতের অথাকথিত ‘প্রোগ্রেসিভ’ এবং ‘বৈপ্লবিক’ রাজনৈতিক দলগুলো। সেই বহু অপেক্ষিত সংস্কার এলো মোদী সরকারের দ্বিতীয় দফায়।

শিক্ষার সংস্কারের অঙ্গীকার করা হয়েছিল এন ডি এর ২০১৪র নির্বাচনী ইশ্তেহারেই। নির্বাচনে জেতার দু বছরের মাথায়, নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি রাখতে সরকার ‘নতুন শিক্ষানীতির প্রবর্তন বিষয়ক কমিটি’ গঠন করে। যার রিপোর্টের ভিত্তিতে ২০১৭ সালে ইসরোর প্রাক্তন চেয়ার ম্যান শ্রী কে কস্তুরীরঙ্গনের নেতৃত্বে ২০১৭র জুন মাসে তৈরী হয় ‘খসড়া জাতীয় শিক্ষানীতি কমিটি’। আরো দু বছর পরে কস্তুরীরঙ্গন কমিটি তার রিপোর্ট পেশ করে ২০১৯ এর ৩১ মে। এই খসড়া নীতি মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক তাদের পোর্টালে পরবর্তী এক বছর জনসাধারণের জ্ঞাতব্যের জন্য আপলোড করে রাখে এবং একই সময় সারা ভারত জুড়ে বিশেষজ্ঞদের অনুরোধ করে এ বিষয়ে তাদের অভিজ্ঞ ও সুচিন্তিত মতামত প্রদানের জন্য। এই অভূতপূর্ব আহবানে সাড়া দিয়ে বিগত এক বছরে ভারত জুড়ে ৬৭৬ টি জেলা হতে প্রায় দু লক্ষ অভিমত জমা পড়ে। সেই দুইলক্ষ অভিমতের ভিত্তিতে কমিটির সুপারিশকে পরিমার্জিত করে, মন্ত্রীসভার অনুমোদন ক্রমে, গতকাল প্রকাশিত হয় জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০।

এক ঝলক দেখে নেওয়া যাক, দেশবাসীর সামগ্রিক ফীডব্যাকের সঙ্গে শিক্ষাবিদদের দূরদর্শিতার অভূতপূর্ব মিশেলে তৈরী এই জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ র মুখ্য অভিমুখগুলো।

(১) নতুন শিক্ষানীতি বড় বদল আনছে স্কুল এডুকেশনে। চিরাচরিত ১০+২ শিক্ষাব্যবস্থা বদলে যাচ্ছে ৫+৩+৩+৪ মাত্রার শিক্ষাকালে। প্রথম প্রশ্নই আসে ১২ বছরে বদলে ১৫ বছরের শিক্ষাকাল আসছে কোত্থেকে? উত্তর হচ্ছে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার তিনটি বর্ষ, প্রচলিত ভাষ্যে যা টডলারি-নার্সারী-প্রিপেটরী নামে পরিচিত ছিল আধুনিক নাগরিক সমাজে, তাও এখন সরকারী শিক্ষাধারার আওতায় আসছে। এতে সবচেয়ে বেশী উপকৃত হবে অবশ্যই গ্রামাঞ্চলের শিশুরা, এতোকাল অবধি যাদের প্রথামাফিক অনুশীলন শুরু করতে অপেক্ষা করতে হত গড় পরতা ৬-৭ বছর বয়স অবধি। অথচ শহুরে উচ্চ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী অন্ত গত তিন দশক ধরে তাদের শিশুদের অনুশীলন শুরু করিয়ে দিচ্ছে ৩-৪ বছর বয়সে। এর অর্থ সাধারণ গ্রামীন শিক্ষা ব্যবস্থা কিশলয়েই পিছিয়ে পড়ছিল প্রায় তিন বছর। নতুন শিক্ষা ব্যবস্থা এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার গোড়াটাই কেটে দিচ্ছে। অর্থাৎ শিক্ষার সূচনাতে এখন সকলেই সমান।

(২) শিক্ষার অধিকার এখন ক্লাস এইট থেকে বাড়িয়ে করা হচ্ছে ক্লাস ১২ অবধি। সব মিলিয়ে সরকার তার নাগরিকের শিক্ষাভার ৮ বছরে বদলে ১৫ বছর অবধি বহন করতে অঙ্গীকার বদ্ধ হচ্ছে।

(৩) শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মাতৃভাষার। ক্লাস ফাইভ অবধি (মানে ৫+৩) মাতৃভাষায় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। এরপরও পরবর্তী তিন বছর (ক্লাস এইট) মাতৃভাষাই শিক্ষার মাধ্যম হোক এই অভিমত শিক্ষানীতির। এমনকি ক্লাস এইটের পরেও মাতৃভাষায় শিক্ষাই হবে শিক্ষানীতির পরবর্তী লক্ষ্য।

(৪) মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ বটেই, কিন্তু ইংলিশের অপরিহার্যতা তাতে কমে না।
দেশের সৌভাগ্য এই যে বামসরকারের শিক্ষানীতির মত দ্বিচারিতার কোন স্কোপ রাখছে না NEP 2020. মাতৃভাষার পাশাপাশি বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে ইংলিশ ভাষা শিক্ষাও। সরকার আনছে নতুন ত্রিভাষা নীতি। মাতৃভাষা/স্থানীয় ভাষার পরেই বাধ্যতামূলক ভাষা শিক্ষা হচ্ছে ইংলিশ।

(৫) সকল জল্পনা, আশঙ্কা এবং অপপ্রচারের অবসান ঘটিয়ে সরকার জানিয়েছে, তৃতীয় ভাষা হিসেবে কোন ভাবেই হিন্দী বাধ্যতামূলক নয়। বরং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ তৃতীয় ভাষা হিসেবে প্রমোট করবে সংস্কৃত ভাষাকে। সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা ও শিক্ষণের জন্য একাধিক উৎকর্ষ কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে। সংস্কৃত বিশ্ববিদ্যালয় গুলির সঙ্গে উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠান গুলিকেও যুক্ত করা হবে যাতে উচ্চতর পর্যায়েও সংস্কৃত শিক্ষার উপযুক্ত সুযোগ তৈরী হয়। এছাড়া দেশী ও বিদেশী অন্যনায় ধ্রুপদী ভাষা এবং সাহিত্যও তৃতীয় ভাষা হিসেবে পড়া যাবে

(৬) আমূল পরিবর্তন আসছে পঠন ব্যবস্থায়। ক্লাস সিক্স থেকে ছাত্র ছাত্রীরা ভোকেশনাল ট্রেনিং পাবে। দেশে ক্রমবর্ধমান শিক্ষিত বেকার নিয়ে সকলে উদ্বিগ্ন থাকলেও স্কিল ও পেশা ভিত্তিক শিক্ষার কোন ব্যবস্থাই অদ্যাপি নেওয়া হয় নি। ক্লাস ইলেভেন ট্যুয়েলভের পর ছমাস-নয়মাসের নানা ভোকশনাল ট্রেনিং যে যথেষ্ট উপযোগী নয় তা ইতিমধ্যেই প্রমাণিত। অন্যদিকে পুঁথিগত বিদ্যা যে কেবল মেকলে নীতি অনুসরণ করে কেরানী তৈরী করছে তা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ একশত বছর আগে বলে গেছেন। একশত বছরে ভারত থেকে রাশিয়া, কমিউনিজম নামক একটা ফাঁপা বেলুনের জন্ম ও মৃত্যু হয়ে গেছে কিন্তু এ বিষয়ে যথোচিত পদক্ষেপ হয় নি। সনাতন ভারতে কিশোররা অনেক সময়েই তাদের পিতার কাছ থেকে পিতৃপুরুষের পেশাগত দক্ষতায় ট্রেইন হতে শুরু করত। পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থায় ভারতের সনাতনী পেশাশিক্ষাব্যবস্থার অনুপম মেলবন্ধন ঘটিয়েছে নতুন শিক্ষানীতি। কেবল শিক্ষিত হওয়াই নয়, তারই সঙ্গে ভবিষ্যতের সুষ্ঠু জীবিকার জন্যও তালিম পাবে আমাদের নবীন প্রজন্ম। পাবে তাদের কৈশোর বয়স থেকে, দীর্ঘ সময়কাল ধরে। শিক্ষিত বেকার নয়, শিক্ষিত স্বাবলম্বী নাগরিক তৈরী করা – এই হল জাতীয় শিক্ষানীতির প্রথম ও প্রধান লক্ষ্য।

(চলবে)

অচলায়তনের অবসানে
পর্ব ২

মাস খানেক আগের কথা। একটা মেইল এল। সরকারের উচ্চস্তর থেকে। অনুবাদক চাই। ইঞ্জিনিয়ারিং ও সায়েন্সের বিভিন্ন বিষয়কে (পাঠ্যপুস্তক সহ) অনুবাদ করতে হবে বিভিন্ন দেশীয় ভাষায়- হিন্দী, বাংলা, তামিল, তেলেগু, গুজরাটি, অহমিয়া, ওড়িয়া, মারাঠী এরকম বারো-চোদ্দটা ভাষার লিস্ট ছিল। ভলান্টিয়ার চায়, তাদের ভাষা এবং বিষয় উভয়েই যথোপযুক্ত যোগ্যতা থাকতে হবে। যদিও ইচ্ছুকদের যোগ্যতা নির্ধারণের মাপকাঠিতে উত্তীর্ণ হতে হবে, তবেই এই কাজে অংশ নিতে পারবে। খুব ভালো লাগল দুটো জিনিস দেখে, এক দেশীয় ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা, খুব সম্ভবতঃ আচার্য জগদীশ চন্দ্র এর পরে আর সে বিষয়ে কেউ লার্জ স্কেলে ভাবেনইনি। বর্তমান সরকার ভাবছে। দ্বিতীয় কথা, হিন্দী একটি ভার্ণাকুলার ল্যাঙ্গুয়েজ (দেশীয় ভাষা) মাত্র, তাকে অন্যসকল ভাষার সঙ্গে একাসনে রাখা হয়েছে, নো ন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ স্ট্যাটাস (এবং নয়ও), নো অফিসিয়াল ল্যাঙ্গুয়েজ স্ট্যাটাস। আমি এর আগেও বহুবার বলেছি, হিন্দী ইম্পোজিশন একটা নেহেরুভিয়ান স্ট্র্যাটেজি এবং হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্থানের কন্সেপ্ট একটা মাকু কন্সপিরেসী প্রোগ্রাম মাত্র। গতকাল জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ পড়তে পড়তে আবার দুমাস আগের সেই মেইলটার কথা মনে পড়ে গেল। আজ আপনারা যেটা দেখছেন, সেটা এক দিনের কোন একটা মানুষের আবেগ বা চিন্তা প্রসূত নীতি নয়। সরকার দীর্ঘদিন ধরে এবিষয়ে ভাবনা চিন্তা করেছে; লক্ষাধিক, আই রিপীট লক্ষাধিক বিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করেছে এবং এই সিদ্ধান্তে এসেছে। হ্যাঁ হয়তো অদূর ভবিষ্যতেই এর কিছু নীতি বিবর্তিত হবে, কিন্তু সেটাই তো আমরা চাই। জীবন প্রতিটা ক্ষণে যেখানে পাল্টাচ্ছে সেখানে অনন্তকাল ধরে এক নীতি আঁকড়ে ধরে রাখার কোন অর্থই তো নেই।

কাল এনইপির ছটি নীতি নিয়ে বলেছিলাম। আজ সেখান থেকেই শুরু করছি।

(৭) দেশীয় ভাষা চর্চার জন্য জন্য শুধুমাত্র পাঠ্যপুস্তক তৈরী করা হবে তাই নয়, দেশীয় ভাষায় লেখা হবে বিভিন্ন মেশিনের ইন্সট্রাকশন ম্যানুয়াল, ওয়ার্কবুক, ম্যাগাজিন নাটক, তৈরী হবে সেগুলোর ই-ভারসান ও ভিডিওও। ভাষাকে আধুনিক করতে ক্রমাগতঃ আধুনিক টার্ম গুলোকে প্রাঞ্জল ভাবে ভাষায় ঢোকানো হবে, দেশীয় ভাষার অভিধান ও চলিত কথায় যাকে বলে ভোক্যাবুলারি তার নিরন্তর আপডেট করা হবে এবং সেগুলোর চর্চা বাড়ানো হবে

(৮) নবপ্রজন্মকে বইয়ের পাতা থেকে বাইরে বার করে আনতে বিশেষ জোর দেওয়া হবে ছবি আঁকা, শিল্প চর্চা, নাটক ও খেলা ধূলায়। স্থানীয় শিল্পী, লেখক, চিত্রকর, ও অন্যান্য কলায় পারদর্শীদের স্কুলে স্কুলে নিয়োগ করা হবে। একই সঙ্গে দেশজ সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করাতে ছাত্রছাত্রীদের স্কুল থকে দেশের বিভিন্ন অংশে ঘোরাতে নিয়ে যাওয়া হবে (সামার ট্রিপ)।

(৯) আট বছর বয়স অবধি সকল শিশুদের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ করার জন্য কেন্দ্রীয় স্তরে এন সি ই আর টি National Curricular and Pedagogical Framework for Early Childhood Care and Education (NCPFECCE) নামে একটি নতুন কেন্দ্রীয় সংস্থা তৈরী করবে। ইহা ইতিহাস, দিজ ইজ হিস্ট্রি। শুধু এই একটা সিদ্ধান্তের জন্যই আমরা য়াজ থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্রের জায়গায় নিজেদের উন্নত রাষ্ট্র বলে দাবী করতে পা্রি। রাষ্ট্রের ভবিষ্যত এখন আরো বেশী করে রাষ্ট্রের দায়িত্ব (আই শুড হ্যাভ রেড কালারড দিস)।

(১০) সম্পুর্ণ বদলে যাচ্ছে মূল্যায়ন ব্যবস্থা। নাম্বার ভিত্তিক পরীক্ষার বদলে আসছে ৩৬০ ডিগ্রী হোলিস্টিক মানবিচার। শুধু ভাষা, বিজ্ঞান আর অঙ্কশিক্ষাই নয়, ছাত্রের ভোকেশনাল ট্রেনিং, আর্ট স্কিল, ব্যবহার ও আচরণ সবই হবে মূল্যায়নের আধার। কিন্তু সেটা হবে না কোন একতরফা বিচার। ছাত্র বা ছাত্রী নিজেই তার মূল্যায়ন করবে (সেলফ এপ্রাইজাল), বলবে তার চয়ে্ব, জানাবে তার পছন্দ-অপছন্দ। অবশ্যই তাদের বিষয়ে বলবে তাদের ট্রেনার/টিচার/সুপারভাইজারও। দুজনের ‘মতামত’ এর ভিত্তিতে একটি কেন্দ্রীয় এ আই (আরটিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) সিস্টেম বাচ্চাদের মূল্যায়ন করবে। হ্যাঁ ঠিকই বুঝেছেন, দশম শ্রেণীর মাধ্যমিক চলে যাচ্ছে ইতিহাসের পাতায়। আর কিছু না হোক, আমরা অন্ততঃ বাজারী পত্রিকার জেলা-বনাম-কলকাতার লড়াই থেকে মুক্তি পাব। মাসী পিসিদেরও আমাদের রেজাল্ট নিয়ে উদ্বেগ (?) কমবে

(১১) আসছে মেজর-মাইনর কন্সেপ্ট, হাই স্কুলেও এবং কলেজেও। থাকছে না সায়েন্স- কমার্স- আর্টস ভাগাভাগি। শুধু এই একটা ব্যপারের সুদূরপ্রসারী ইম্প্যাক্ট ভাবুন। ‘আমার ছেলে সায়েন্স নিয়ে পড়ছে’’ যেদিন এই কথা নেই, সেদিন ইশান অবস্তীর জন্য নিকুঞ্জ স্যারের দরকার নেই। যেদিন এই কথা নেই, সেদিন জয় লোবর আত্মহত্যা করার দরকার নেই। আপনার ছেলে একসঙ্গে পড়বে ফিজিক্স আর ফ্যাশন ডিজাইনিং। আমি পড়তাম কেমিস্ট্রি, ফিজিক্স, লিটারেচর আর হিস্ট্রী। সঙ্গে থাকত ছবি আঁকা আর স্টাটিস্টিক্স। আপনি কি পড়তেন?

(১২) জাতীয় শিক্ষানীতির যুগান্তকারী পদক্ষেপ হচ্ছে উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন। ২০১৪ সালে গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও ছিল ২৪%, পরের চার বছরে তা বেড়ে হয়েছে ২৬%মোদী সরকার পাখির চোখ করেছে ২০৩৫ এর মধ্যে তা ৫০% করতে। গ্রস এনরোলমেন্ট রেশিও কি? দেশের শিশুদের কত জন উচ্চশিক্ষায় যাচ্ছে। সোজা বাংলায় সরকার চায় ২০৩৫ এ অর্ধেকের বেশী ছাত্র ছাত্রী অন্তত; গ্রাজুয়েট হবে। সেই উদ্দেশ্যে নতুন দেড় কোটী, ইয়েস স্যার এণ্ড ম্যাডাম, নতুন দেড় কোটি আসন তৈরী হবে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে।

(১৩) শুধু তাই নয়, এই উদ্দেশ্যে আসছে এককেন্দ্রীয় এন্ট্রেন্স সিস্টেম। সকল কলেজ ও ইউনিভার্সিটি এই এন্ট্রেন্স মানবে। যত বেশী সম্ভব ভাষায় সেই এন্ট্রেন্স এক্সাম নেওয়া হবে। আগের ইউপিএ আমলে মত নয় যে পরীক্ষা কেবল হিন্দী আর ইংলিশে হবে।

(১৪) এরপরও যদি কারোর মনে ভাষা নিয়ে বিন্দুমাত্র দ্বিধা দ্বন্দ্ব থাকে, বাজারী পত্রিকার প্রোপাগাণ্ডায় যদি একবারের তরেও মনে হয় আপনাকে ভাষাপক্ষে যোগ দিতে হবে, তাদের জন্য বলি, সকল রকম দেশীয় ভাষার উত্তকর্ষতা সাধনের জন্য, দেশীয় ভাষায় উচ্চশিক্ষা পেতে দেশ জুড়ে তৈরী হবে হাজারের বেশী অনুবাদ কেন্দ্র। সংস্কৃত সহ সকল ভাষা বিভাগকে সকল রকম ইউনিভার্সিটিদের সঙ্গে যুক্ত করা হবে। যাতে সেখানকার টিচাররা অন্যনায় তথাকথিত সায়েন্স কলেজ গুলোতে গিয়ে ভাষাবিষয়ক সাবজেক্ট পড়াতে পারে। পাশাপাশি ধ্রুপদী ভাষায় ক্রমাব্লুপ্তির পথে যেতে থাকা সকল রচনাকে পুন্রুদ্ধার করা হবে এবং অনুবাদ করা হবে।

উচ্চশিক্ষা বিষয়ক দিকনির্দেশক ও পেশাগত পরিবর্তন গুলো উল্লেখ করব পরের পর্বে। আপাতত এই পর্ব শেষ করার আগে, ওই মেলটার কথায় ফিরে যাই। হ্যাঁ, মেল্টার উত্তর দিতে আমার একমিনিটও দেরী হয় নি। লিখে দিয়েছিলাম – বাংলা এবং ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার আমার প্রফিসিয়েন্সি। আপাততঃ অপেক্ষায় আছি কবে ডাক আসবে, অপেক্ষায় আছি কবে লিখব থেভেনিন’স থিওরেম বাংলাতে

(আগামী পর্বে সমাপ্য)

অচলায়তনের অবসানে
তৃতীয় ও শেষ পর্ব

হীরক রাজা বলেছিল এরা যত বেশী শেখে, তত বেশী জানে, তত কম মানে। সেইজন্যই চৌত্রিশ বছরের বামাবর্তে পোড়ার বাংলায় কিছু শেখানোটাই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল যাতে সময়কালে স্বাবলম্বী না হতে পেরে যুব সম্প্রদায় বিপ্লবের চোরা গলিতে ঢুকে পড়ে। পোটেনশিয়াল টুলসম্যানদের হাতুড়ি চালানোর শিক্ষা না দিয়ে হাতুড়ি মার্কা পতাকা তুলে দেওয়া হয়েছিল হাতে। সেই সর্বনাশী স্বার্থান্বেষীদের শেষ প্রজন্ম যে মাথার সাত সেন্টিমিটার ব্যাণ্ডেডের আড়ালে চৌত্রিশটা সেলাই লুকিয়ে রেখে ইন্টার্নশিপ আর ভোকেশনাল ট্রেনিংকে চাইল্ড লেবার আখ্যা দিয়ে জালিয়াতি করতে চাইবে তাতে আর আশ্চর্য কি?

সে যাই হোক, ইতিহাস রচনার দিনে, প্রাগৈতিহাসিকদের কথা এড়িয়ে গিয়েই শেষ পয়েন্টগুলো বলে এই দীর্ঘ প্রবন্ধ শেষ করি। এখনো অবধি চোদ্দটা পয়েন্ট বলেছিলাম। শুরু করছি তারপর থেকে,

(১৫) উঠে যাচ্ছে ইউ জি সি, এ আই সি টি ই সহ দেশের একাধিক ছোট বড় নিয়ামক সংস্থা। একাধিক সংস্থা যে কেবল দীর্ঘসূত্রীতা আর গাফিলতির অজুহাত তৈরী করে তা নয়, দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত হয়। ভারতের এক বিরোধী দলনেতা একসময়ে চুইয়ে পড়া অর্থনীতির কথা বলে ছিল, কিন্তু তার বিপদ্মুক্তিতে ন্যায় নামক ভিক্ষাপাত্র ছাড়া কোন আসল সমাধান পঞ্চাশ বছরের যুব নেতা দেননি। নতুন শিক্ষানীতি সেই দিকে খেয়াল রেখে মেডিক্যাল ও ল কলেজ বাদে সকল কলেজকে একটা মাত্র ছাতার তলায় নিয়ে আসতে চলেছে।

(১৬) মেজর মাইনরের কন্সেপ্ট ব্যপক ভাবে আসতে চলেছে উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রেও। একদিকে যেমন আই আইটি, এন আই টি সহ সকল ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান কে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সেখানে পড়ানো হবে আর্টস, ল্যাঙ্গুয়েজ, লিটারেচার ও সোশ্যাল সায়েন্স। তেমন জে এন ইউ এর মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলিকে বলা হয়েছে সেখানে ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনোলজির সাবজেক্টকে মাইনরের মধ্যে আনা। উভয় ধরনের প্রতিষ্ঠানের মধ্যেই শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী আদানপ্রদান হবে। উভয় রকম সাব্জেক্ট মিলে মিশে যাবে। এটাকেই বলা হচ্ছে ইন্টারদিসিপ্লিনারী। ড্যান ব্রাউনের বই গুলো যারাই পড়েছেন তারা সকলেই জানেন বিদেশে কি রকম ভাবে বিজ্ঞান ভিত্তিক ইতিহাস চর্চা হত। হয়তো মোগল স্থাপত্য গুলোর তলায় হিন্দু মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হওয়ার আশঙ্কাতেই এতোকাল ইতিহাস বইতে পড়ানো হত কেবল আকবরের রাজস্বনীতি। কিন্তু নতুন শিক্ষানীতি আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য নিয়ে আসবে নবীনতম ধারা।

(১৭) একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ল্যাঙ্গুয়েজ থেকে লিটারেচরকে আলাদা করে দেওয়া। আমরা ভালো ইংলিশ এই কারণেই বলিনা কারণ আমাদের ইংলিশ ভাষা শেখানো হয় না, সাহিত্য পড়ানো হয়। ভাষা শিক্ষা সবার দরকার, সাহিত্য চর্চা সকলের প্রয়োজন নয়। এই সহজ কথাটা আমাদের মেক্লে অনুসারী নেহেরুভিয়ান শিক্ষাবিদরা বোঝেননি এবং তাই পাড়ার মোড়ে মোড়ে একসময় গজিয়ে উঠত স্পোকেন ইংলিশের কোচিং, এখন বাড়ছে ইংলিশ মিডিয়ামের রমরমা। নতুন শিক্ষানীতি সকলকে ইংলিশ ল্যাঙ্গুয়েজ শেখাবে। তারপর যারা চায় তারা ইংলিশ সাহিত্য পড়বে, যারা চায় না পড়বে না

(১৮) সবচাইতে গুরুত্ব পূর্ণ তিনটে বিষয়ের মধ্যে একটা হল মাল্টিপল এন্ট্রি এক্সিট সিস্টেম। ডিগ্রী কোর্সের দৈর্ঘ্য কমানো হচ্ছে, এম ফিল তুলে দেওয়া হচ্ছে, সবই করা হচ্ছে যাতে উচ্চ শিক্ষার্থীরা অন্যে কি করেছে তা মুখস্থ না করে নিজেরা কিছু উদ্ভাবন করে তা মাথায় রেখে। চীন যখন থ্রেট তখন আমাদের চাই গবেষক, চাই উদ্ভাবক। এবং তার জন্য যেন আমাদের পারিবারিক দায়িত্ব বা অন্যান্য পিছুটান যেন বাধা না হয়। তাই মাল্টিপল এক্সিট-এন্ট্রি সিস্টেম। জীবন কত সময় এমন মোড় আনে যে আমাদের পড়া মাঝপথে থামিয়ে দিতে হয়, কত মেয়ে বিয়ে বা সন্তান ধারণের কারণে ছ মাস বাকি থাকতে ডিগ্রী শেষ করতে পারে না, কত সময় দুর্ঘটনা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। কিন্তু তারপর আর ফেরার পথ থাকে না। মাল্টিপ্পল এক্সিট এন্ট্রি সিস্টেম দেবে সেই সুযোগ যাতে আপনি আবার আপনার পুরোনো পড়াশোনা শুরু করতে পারবেন, ‘বছর নষ্ট’ না করে। আপনার আগে পড়া সাবজেক্ট আপনাকে আর নতুন করে পড়তে হবে না। আপনাকে শুধু বাকি পথটা শেষ করতে হবে। জীবন থাকবে তার নিজের ছন্দে, কিন্তু আপনার পড়াশোনা চলবে আপনার দাবীতে।

(১৯) কিন্তু তা হবে কেমনে? তার জন্য আসছে সেন্ট্রাল ক্রেডিট ব্যাঙ্ক সিস্টেম। যখনই আপনি কোন সাবজেক্ট পড়বেন তার জন্য ক্রেডীট জমা হবে সেই ব্যাঙ্কে। এবং সেই ক্রেডিট আপনার থাকবে যতক্ষণ না পর্যন্ত আপনার ডিগ্রী লাভ হচ্ছে। যখন যে স্তরেই পড়ুন না কেন, আপনার পঠিত সব বিষয়ই আপনার ক্রেডিট। সেই ক্রেডিট জড়ো করে প্রয়োজনীয় ক্রেডীট জোগাড় হলেই আপনি ডিগ্রি পাবেন। সত্যিই তো সমাজ কে বলুন তো ঠিক করে দেবে বা বাধ্য করবে আপনি কি পড়বেন? আপনি পড়বেন আপনার পছন্দ মত বিষয়ে, আপনার সুবিধা মত সময়ে। আপনি যদি হন আন্তরিক, আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করার দায় শিক্ষা ব্যবস্থার।

(২০) এবং এই সব কিছুর জন্য জি ডি পির ৬% বরাদ্দ হবে শিক্ষা ক্ষেত্রে। এতোদিন তা ছিল ২% এর কম। বিপ্লবীদের দীর্ঘদিনের দাবী কিন্তু তাদের বা তাদের সমর্থিত সরকার তার ধারে কাছেও যায় নি। হয়তো গেলে বিপলব আর করা যেতো না বলে। কিন্তু নতুন শিক্ষানীতি জানে যে যখন ঘরের দ্বারে যুদ্ধ কড়া নাড়ে, জ্ঞানই তখন প্রদীপ হয়ে অসিতে আগুন জ্বালে।

হয়তো বাকি রয়ে গেল বলা আরো অনেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্তের কথা, যেমন স্কুলে স্কুলে সাধারণ টাইমের পরে চলবে সান্ধ্য স্কুল বয়স্কদের জন্য, ডাকা হবে বিশ্বের সেরা একশোটা বিশ্ববিদ্যালয়কে এখানে ক্যাম্পাস খোলার জন্য। কিন্তু হয়তো সব বলার দরকারও নেই। হয়তো এতটা বলারও দরকার ছিল না, শুধু হয়তো এটুকু বললেই হত নতুন শিক্ষানীতি একাধারে ভারতে কে দিচ্ছে আধুনিকতা প্রগতি ও স্বাচ্ছন্দ্য। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই বুঝেছেন, নতুন শিক্ষানীতি হয়তো আপনাকে কেবলি জুলু ড্যান্সের উপর পি এইচ ডি করতে দিয়ে ঈন্ডিয়া তেরে টুক্রে হোঙ্গে বলার অখণ্ড অবসর করে দেবে না, কিন্তু আপনাকে বানাবে রবার্ট জে ওপেন হাইমার, যিনি নিজসৃষ্ট পারমাণবিক বিস্ফোরণের দ্যুতি দেখে স্তব্ধ কন্ঠে বলে উঠবেন গীতা শ্লোক –

দিবি সূর্যসহস্রস্য ভবেদ্ যুগপদুত্থিতা
যদি ভাঃ সদৃশী সা স্যাদ্ ভাসস্তস্য মহাত্মনঃ।।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.