কল্যাণীকে যেদিন এপার বাংলায় পাঠিয়ে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন বাবা-মা, ও পালিয়েছিল শরিফাদের বাড়িতে। “চিলেকোঠায় গুটিসুটি বসেছিল যেন কেউ না দেখে, যেন খুব শীগরি বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, যেন তাকে ইন্ডিয়া পাঠাবার ষড়যন্ত্রটি বাতিল হয়ে যায়। কল্যাণী ধরা পড়েছিল হরিনারায়ণের হাতেই, তাকে হিড়হিড় করে টেনে নামিয়েছিলেন তিনি। কল্যাণী একবার তার ঘরের দরজা, একবার বারান্দার থাম, একবার সরলাবালার হাত, একবার তুলসীতলা আঁকড়ে ধরে হু হু করে কেঁদেছিল, ঘাট ছেড়ে যাওয়া স্টিমারে অমন মর্মন্তুদ আর্তনাদ কেন ওঠে, কল্যাণী সেদিন বুঝেছিল।” (তসলিমা নাসরিন, ‘ফেরা’, পৃ ১১)।
এ পার বাংলায় আসার পর? ”……চোখের সামনে ডিঙি নৌকো দুলতে দুলতে যায়, আর সে তার স্মৃতিগুলো চোখের জলে ধেয়ে বুকের কৌটোয় তুলে রাখে। কলঘরে দাঁড়িয়ে চিঠি পড়তে পড়তে কল্যাণীর বুক ভেঙে কান্না নামে, কান্নার শব্দ বাড়িতে যদি কোনও অঘটন ঘটায় সে কল ছেড়ে দেয় যেন জলের শব্দের তলে সেটি হারিয়ে যায়” (‘ফেরা’, পৃ ১৬)।
কল্যাণী একটা মাত্র চরিত্র। গত প্রায় আট দশক ধরে অসংখ্য কল্যাণী বা তাদের বাবা-মা-ভাই-বোনরা প্রাণের ভিটে ছেড়ে অনির্দিষ্ট বিভুঁয়ে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন।
সবাই কি নিরাপত্তার আশায় অচেনা মুলুকে পাড়ি দিয়েছিল? না। কল্যাণীর বাবা হরিনারণের মৃত্যুর পর সরলাবালাকে কলকাতায় নিয়ে আসবার অনেক চেষ্টা করেও তা সফল হয়নি। ‘জীবনের বাকি কয়টা দিন স্বামী শ্বশুরের ভিটায় কাটাইতে দে, আমি আর বাঁচবই বা কয়দিন! আমারে নিয়ে টানা হেঁচড়া আর না করলি। এসব বলে সরলাবালা কাঁদছিলেন।’ পরে যখন সরলাবালারও খবড় এল, এপারে চলে আসা পুত্র-কন্যারা পরিস্থিতির জেরে যেতে পারেননি (‘ফেরা’, পৃ ২০)।
আবার অনেকেই থেকে যেতে চেয়েছিলেন ওপারে। “আমার জন্ম এখানে, মরবও এখানে“—এই প্রত্যয় নিয়ে। তাঁদের অনেককে খুন হতে হয়েছে নৃশংসভাবে। তখন কি ধ্বণিত হয়েছিল ‘হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই’, ’এক বৃন্তে দুই কুসুম’? তালিকা অতি দীর্ঘ। স্বদেশি আমলে তৈরি আয়ুর্বেদিক ওষুধ সংস্থা সাধনা ঔষধালয়। ঢাকায় জন্ম, পরে শাখা মেলেছিল কলকাতার হরেক জায়গায়। তার পণ্য রফতানি হত আফ্রিকা, চিনেও। এখানকার ওষুধ খেতেন সুভাষচন্দ্র থেকে শরৎচন্দ্রও। এখন বিস্মৃতির অতলে। টলানো যায়নি অশীতিপর যোগেশচন্দ্র ঘোষকে। ১৯৭১, এপ্রিল। পুরনো ঢাকার গেণ্ডারিয়া, সূত্রাপুর এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা পালিয়েছেন। কিন্তু থেকে গিয়েছিলেন তিনি। নৃশংসভাবে খুন হতে হয়েছিল তাঁকে। তখন তো প্রশ্ন ওঠেনি ‘দেশ তুমি কার?’
এ পারে এসে নতুন ভিটেয় যাঁরা ঠাঁই পেয়ে শূন্য থেকে জীবনসংগ্রাম শুরু করেছিলেন, তাঁরাও কেউ ভয়ে, কেউ ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছিলেন। তাঁদের কেউ টিঁকে গিয়েছেন। কেউ পর্যদূস্ত হয়েছেন।
‘দেশ তুমি কার’— যত প্রশ্ন আজ? আর কেবল এপারে?
— অশোক সেনগুপ্ত। ৩০/৩/২০২৫।
