[অর্থকরী জামচাষের জন্য ৮x৮ মিটার (বিঘায় ২০ সংখ্যক গাছ) অথবা অধিক ঘনচাষের জন্য ৫x৫ মিটার (বিঘায় গাছের সংখ্যা ৫৩) দূরত্ব দেওয়া যায়। বেঁটে জাতের কলমের চারায় ৫-৬ বছর বয়সে ভালো ফলন আসে; ৮-১০ বছর থেকে পাওয়া যায় অর্থকরী ফলন। উদ্যানগত পরিচর্যায় বছরে গাছপ্রতি ৮০-১০০ কেজি জাম উৎপন্ন হতে পারে। কোয়ালিটি জামের বাজার মূল্য কেজিতে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা, চাষি বিক্রি করতে পারবেন প্রতি কেজি ১০০ থেকে ২০০ টাকায়। জ্যৈষ্ঠ্য থেকে ভাদ্রমাস পর্যন্ত পাকে এরকম নানান জাত-বৈচিত্র্য ঘন করে লাগিয়ে বিঘা প্রতি বছরে তিন-চার লক্ষ টাকা আয়ের হাতছানিও কিন্তু রয়েছে। অথচ মধুমেহ, হৃদয়-ঘটিত রোগ, লিভারের সমস্যায় ভুগে নানান রোগীর পরিবার কোয়ালিটি জাম বাজারে খোঁজেন, কিন্তু বাজারে দীর্ঘমেয়দী যোগান নেই। কোন কোন জাত চাষ করার কথা ভাবা যায়, সেই নিয়ে লিখেছেন অস্মিতা চক্রবর্তী এবং ড. কল্যাণ চক্রবর্তী]
উদ্ভিদবিদ্যাগতভাবে জামের দুই-তিনটি রূপবৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। ছোটো সাইজের ‘কথা জাম’, যার ফলগুলো অতিক্ষুদ্র এবং স্বাদে অম্ল। মাঝারি মাপের ‘আডকা জাম’ যার বলিষ্ঠ বীজ এবং শাঁস গোলাপি রঙের। এছাড়া রয়েছে ‘জাম্বোজাম’, যা সাইজে বড়সড়, পুরু শাঁস, ছোটো বা মাঝারি বীজ। এই তৃতীয় টাইপের ফলের চাহিদাই বাজারে বেশি। এছাড়া বীজহীন অথবা ক্ষুদ্র বীজযুক্ত জামও পাওয়া যায়।
কয়েকটি ভালো জাতের জাম হচ্ছে গুজরাট রাজ্য তথা পশ্চিম ভারতের জনপ্রিয় জাত ‘পরশ’ (Paras) এবং উত্তর ভারতের জনপ্রিয় স্থানীয় জাত ‘রাজামুন’ (Ra-Jamun) , বিহার কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভাবিত ‘রাজেন্দ্র জাম -১’ (Rajendra Jamun -1), ফৈজাবাদের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উদ্ভূত বারাণসী অঞ্চলের বিখ্যাত জাত ‘নরেন্দ্র জাম’ (Narendra Jamun), গুজরাটের গোধরাতে কেন্দ্রীয় উদ্যানফসল পরীক্ষণ কেন্দ্র (CHRS, Godhra) থেকে উৎপন্ন ‘গোমা প্রিয়াঙ্কা’ (Goma Priyanka), মহারাষ্ট্রের ভেঙ্গুরলা আঞ্চলিক ফল গবেষণা কেন্দ্র থেকে উদ্ভাবিত ‘কোঙ্কন বাহাডোলি’ (Konkan Bahadoli), বেলগাঁও জেলা থেকে জি.আই ট্যাগপ্রাপ্ত এবং আরাভাবি অঞ্চলে জনপ্রিয় ‘ধূপদল’ (Dhoopdal), লক্ষ্মৌতে অবস্থিত কেন্দ্রীয় নাতিশীতোষ্ণ উদ্যান ফসল কেন্দ্র থেকে উদ্ভাবিত CISH J-42, CISH J-37 (Jamwant), CHES, Godhra থেকে উদ্ভাবিত থর ক্রান্তি (Thar Kranti) ইত্যাদি। সম্প্রতি ব্যাঙ্গালুরুর ICAR-IIHR (ভারতীয় উদ্যানফসল গবেষণা সংস্থা) জামের উন্নয়নে বেঁটে জাতের প্রকরণ এবং উন্নত গুণমানের ফল পাওয়ার দিকে অধিক দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছে। সংস্থাটি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে (কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তামিলনাড়ু, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, বিহার থেকে) ১১০ টি উন্নত জামের জার্মপ্লাজম সংগ্রহ করেছে অধিক মূল্যায়নের জন্য।
উল্লেখ করা হল, অধিক ফলনশীল কয়েকটি জামের বিস্তারিত কথা —
বাহাডোলি জামুন: এটি ভারতের একটি ঐতিহ্যবাহী জামের জাত, যা মহারাষ্ট্র রাজ্যে জন্মায়। পালঘর জেলার বাহাডোলি গ্রামে এই জাতটি বহুল পরিমাণে জন্মাতে দেখা যায়। ২০২৪ সালের ৩১ শে মার্চ এই জাতটি নিবন্ধীকৃত হয়ে GI Tag (Geographical Indication Tag) লাভ করেছে।
বাহাডোলি গ্রামটি মুম্বাই শহর থেকে ৮৭ কিলোমিটারের পথ। স্থানীয় মারাঠী ভাষায় জাতটিকে বলা হয় ‘বাহাডোলি জাম্বুল’। প্রকৃতপক্ষে গ্রামটির নাম ‘জাম্বুলগাঁও’ (জামের গ্রাম)। জাতটি ঐতিহ্যের মর্যাদালাভ করেছে৷ জাতটির বিশেষ বৈশিষ্ট্য এমনতরো: ফলের আকার বড়, আকৃতি আয়তাকার বা অবলং, বর্ণ ঘন বেগুনি, স্বাদে টকমিষ্টি। এতে অ্যানথোসায়ানিন নামে প্রাকৃতিক রঙ মেলে। জাতটির ভেষজগুণ বিশেষ সমাদর লাভ করেছে, বিশেষত ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে। গাছের বিভিন্ন অংশ যেমন বীজ, ছাল, পাতা, ফুল এবং ফলের শাঁস ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতিতে ব্যবহৃত হয়। আর উৎপন্ন হয় বিভিন্ন উপজাত দ্রব্য যেমন জামের জ্যুস, জাম থেকে তৈরি মদ, পানীয় বা বেভারেজ ইত্যাদি। জাতটি স্থানীয় অঞ্চলেট অর্থনীতিতে এবং ঐতিহ্য-সংস্কৃতিতে সদর্থক প্রভাব ফেলেছে৷
‘কঙ্কন বাহাডোলি’ জাতটি মহারাষ্ট্রের কঙ্কন অঞ্চলের একটি পৃথক জামের জাত, যা উদ্ভাবিত হয়েছে ড. বালাসাহেব সাওয়ান্ত কঙ্কন কৃষি বিদ্যাপীঠ (DBSKKV), দাপোলি থেকে। বাহাডোলির স্থানীয় জামের গাছগুলির মধ্যে থেকে অতি যত্নে জাতটি নির্বাচিত করা হয়েছে। এই জাতের জামের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে — অধিক ফলন, থোকায় ফলে, বড় ও বলিষ্ঠ আকারের ফল, ওজন ২৫-২৮ গ্রাম, বীজের আকার ছোট, শাঁসের মাত্রা ৮৩.৩ শতাংশ, টেবিলে সাজিয়ে পরিবেশনের উপযোগী জাত, প্রক্রিয়াকরণ করারও উপযুক্ত।
গোমা প্রিয়াঙ্কা: গুজরাটের গোধরার গবেষণা কেন্দ্র (CHES, Godhra) থেকে এই জাতটির উদ্ভব। জামচাষীদের জন্য জাতটি একটি আশীর্বাদ স্বরূপ। গাছটি চেহারায় ছোটোখাটো (Semi-dwarf)। শাখাগুলি ঘন এবং ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা যুক্ত। এই জাত অর্থকরী চাষে ঘন করে লাগানোর উপযোগী। গাছটি প্রতি বছর প্রভূত ফলনদায়ী। চাষীদের কাছে জাতটি জনপ্রিয় এই কারণে যে এর ফলন উচ্চ (১০ বছর বয়স থেকে গাছ প্রতি ৫০-৭০ কেজি ফলন পাওয়া যায়), শাঁসের পরিমাণ বেশি (৮৫-৯০ শতাংশ), বীজের ওজন কম। মে মাসের চতুর্থ সপ্তাহে ফল পাকে। প্রতিশ্রুতি-সম্পন্ন এই জাতটি চাষ করে আর্থ-সামাজিক সমৃদ্ধি এবং পুষ্টি-নিরাপত্তার সম্ভাবনা। এই জাত গুজরাট রাজ্য ছাপিয়ে রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাব, উত্তরপ্রদেশ, কর্ণাটক, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিসগড়, তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রে ছড়িয়ে পড়েছে।
পরশ: গুজরাট অঞ্চলে দৃশ্য এই জাতের ফলের আকার কিছুটা বড়, অধিক মাত্রায় আইরন বা লৌহ থাকে। ফলের ওজন ৯-১০ গ্রাম, ফলের দৈঘ্য ও প্রস্থ ৩০ এবং ১৮ মিলিমিটারের মতো। পুরুত্ব ১৬-১৮ মিলিমিটার, শাঁসের মাত্রা ৭০-৭২ শতাংশ।
নরেন্দ্র জামুন – ৬: জাতটি NDUAT, Faizabad থেকে নির্বাচিত একটি জাত, আয়তাকার, ফলের ওজন বেশি, শাঁস ও বীজের অনুপাত বেশি। বারাণসী এলাকায় লভ্য এবং বীজের ভাগ অতি নগণ্য এমন স্থানীয় জাত থেকে নির্বাচিত হয়েছে এই আকাঙ্ক্ষিত জাতটি।
রাজেন্দ্র জামুন -১: জাতটি বিহার এগ্রিকালচার কলেজ, ভাগলপুর থেকে চিহ্নিত হয়ে উন্মুক্ত হয়েছে। জাতটি জলদি (মে-জুন নাগাদ পাকে), ফলন: গাছ প্রতি ৪৫০ কেজি, মোট দ্রবণীয় কঠিনের মান ১৮.২০ ডিগ্রি ব্রিক্স, অম্লত্ব ০.৩১ শতাংশ, ফলের ওজন প্রায় ১৩ গ্রাম, শাঁসের মাত্রা ৮৮ শতাংশ।
জামন্ত (CISH J- 37): জুনের দ্বিতীয় সপ্তাহে ফল পাকে, পূর্ণ বয়স্ক গাছের ফলন ২০০-৩০০ কেজি। ফল আয়তাকার, ফলের আকার বলিষ্ঠ (ওজন ২৫ গ্রাম), শাঁস গুণমানে উন্নত (৯০-৯২ শতাংশ শাঁস), ভিটামিন-সি উচ্চমাত্রায় থাকে (১০০ গ্রাম শাঁসে ৫০ মিলিগ্রাম)। অ্যান্টি-অক্সিডেন্টের মোট পরিমাণও উচ্চ (প্রতি গ্রামে ৩৮ মিলিগ্রাম AEAC)।
রাম জামুন: উত্তর ভারতের জাত। লম্বা এবং সুন্দর গড়নের চিরহরিৎ বৃক্ষ, ছায়াদানকারী (Shade tree), হাওয়া-ভাঙ্গানি (Wind break), পথিপার্শ্বস্থ বৃক্ষ (Avenue tree) রূপে ব্যবহৃত হয়। ছালের রঙ বাদামি অথবা ধূসর, পাতাগুলি মসৃণ (১০-১৫:সেন্টিমিটার লম্বা, ৪-৬ সেন্টিমিটার চওড়া), ফুলগুলি হলুদ, ৫ মিলিমিটার তার ব্যাস। আয়তাকার সবুজ ফলগুলি পাকলে অগ্নিবর্ণ লাল রঙে রূপান্তরিত হয়ে ঘন বেগুনি রঙ ধারণ করে। বীজের দৈঘ্য ১ থেকে ১.৫ সেন্টিমিটার।
রা-জামুন: ফলের আকার বড়, রসালো, ফলের রঙ বেগুনি, বীজ আকৃতিতে ছোটো। রাজা জামুন: উত্তর ভারতে চাষগত প্রভাব বিস্তার করেছে৷ জুন-জুলাই মাসে ফল পাকে।
কথা জামুন: CIAH, Bikaner থেকে নির্বাচিত একটি জাত, ফল পাকে জুনের মাঝামাঝি, ফলের ওজন কম (গড় ওজন ৮ গ্রাম), শাঁসের মাত্রা ৭০ শতাংশ, মোট দ্রবণীয় কঠিনের মান ৯ ডিগ্রি ব্রিক্স, স্বাদে টক (অম্লত্ব ০.৪২ শতাংশ), ভিটামিন – সি রয়েছে প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে ৩৪ গ্রাম, জাতটি প্রক্রিয়াকরণের উপযুক্ত।
এছাড়া আষাঢ় জাতের ফল পাকে জুন-জুলাই নাগাদ। ভাদো জাতের ফল পাকে আগষ্ট মাসে।
(ছবি সংগৃহীত: ফেসবুক থেকে এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে)
তথ্যসূত্র:
- Rekha, A. (Compiled) 2016. Jamun — A future crop of India (Technical Bulletin No. 58), Indian Institute of Horticultural Research, Bengaluru, pp. 1-11.
- https://eudyan.hp.gov.in (ICAR-CISH, Lucknow Package of practices for Jamun Cultivation)
- http://www.agritech.tnau.ac.in (TNAU Agritech Portal Horticulture::Fruits::Jamun Fruit)
- https://www.apnikheti.com
অস্মিতা চক্রবর্তী এবং ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
