অটলবিহারী তিনিই যিনি ব্রহ্মবিহারী। নিজের মধ্যে অন্যের জন্য মৈত্রী পোষণ করেন। যাঁর দেশপ্রেম অটল ও অটুট। যিনি পদ্মবিভূষণ, ভারতরত্ন। যাঁর মধ্যে সনাতনী সংস্কৃতির মোক্ষ-রঙের সৌকর্য। যাঁর হাতে আধুনিক ভারতবর্ষের ভিত্তি নির্মাণ। তিনি দেশের দশম প্রধানমন্ত্রী: এক ক্ষণজন্মা রাষ্ট্রনায়ক, সুভদ্র সুশাসক। দেশব্যাপী তাঁর জন্মশতবর্ষ পালিত হচ্ছে।
একশো বছর আগের কথা।
মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়র শহরে ১৯২৪ সালের ২৫ শে ডিসেম্বর অটলবিহারীর জন্ম। বাবা কৃষ্ণবিহারী একজন কবি স্বভাবের মানুষ, পেশায় শিক্ষক; মা কৃষ্ণাদেবী, ধর্মে মতি এক সর্বংসহা নারী। কাব্যে অটলজীর হাতেখড়ি তাঁর বাবার কাছে। পরে ‘পাঞ্চজন্য’ পত্রিকা সম্পাদনার সুবাদে অটলের কবি প্রতিভা বিকাশ লাভ করে।
ছোটো থেকেই রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের ভাবাদর্শে তাঁর দীক্ষা। ১৯৩১ সালে বাবাসাহেব আপ্তের অনুপ্রেরণায় সঙ্ঘকাজে যোগদান করেন। পরে সঙ্ঘের প্রচারক হন।
স্নাতক স্তরে অটলের পড়াশোনা গোয়ালিয়রের ভিক্টোরিয়া কলেজে। এরপর কানপুর ডিএভি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তিনি প্রথম শ্রেণীতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
স্বাধীনতা সংগ্রামে অটলজীর অংশগ্রহণ ছিল। ৪২-এর ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনে অংশ নিয়ে তিনি ২৩ দিন জেল খাটেন।
স্বাধীনতার পর ১৯৫১ সালে তাঁকে পূর্ণ সময়ের রাজনৈতিক কর্মী হিসাবে দেখা যায়। ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় জনসঙ্ঘে দীনদয়াল উপাধ্যায়ের অনুপ্রেরণায় যোগদান করেন। ১৯৫৩ সালে শ্যামাপ্রসাদের কাশ্মীর অভিযানে তিনি অন্যতম সহযোগী ছিলেন।
তাঁর সাংসদ জীবন সুদীর্ঘ এবং বর্ণময়। ছ’ বার লোকসভায় এবং দু’বার রাজ্যসভায় তিনি দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৫৭ সালে বলরামপুর লোকসভা আসন থেকে প্রথমবার জয়লাভ৷ ১৯৬৮ সালে ভারতীয় জনসঙ্ঘের সর্বভারতীয় সভাপতির দায়িত্ব পান। রাজনৈতিক সহকর্মী হিসাবে তিনি নানাজি দেশমুখ, বলরাজ মাধোক, লালকৃষ্ণ আদবাণী প্রমুখ প্রাতঃস্মরণীয় ব্যক্তিত্বকে পেয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালে ইন্দিরা গান্ধী গণতন্ত্ররোধী জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন৷ বহু বিরোধী নেতার সঙ্গে অটলজী গ্রেপ্তার হলেন। যে ইন্দিরাজীকে স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের সময় সার্বিক প্রয়াস নেবার জন্য সমর্থন করেছিলেন অটলজী।
কংগ্রেসী একনায়কতন্ত্রকে পরাজিত করতে ১৯৭৭-এ নির্বাচনের প্রাক্কালে জনতা পার্টি তৈরি হল। জনসঙ্ঘ সদলে মিশে গেল সেই দলে। মোরারজি দেশাইয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বে তিনি পেলেন বিদেশমন্ত্রকের দায়িত্ব। সেই থেকে তিনি রাজনৈতিক বিশ্বের এক উজ্জ্বল নক্ষত্ররূপে পরিচিত।
জনতা পার্টির সদস্য হিসাবে RSS-এর সামীপ্যে সান্নিধ্যে থাকা যাবে না, এমন অযৌক্তিক দাবী উঠলে, সঙ্ঘ-ই তাঁদের মূল আধার, এই বোধে জনতা পার্টি থেকে বেরিয়ে এলেন সাবেক জনসঙ্ঘের প্রথিতযশা নেতৃত্ব। দেশাই সরকারের পতন ঘটল। অটলজীর নেতৃত্বে ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠিত হল ‘ভারতীয় জনতা পার্টি’। তারপর তিল তিল করে দলের গঠন ও গ্রোথন। রাজনৈতিক বিশ্বে সে এক রূপকথার গল্প!
১৯৯৬ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিজেপি একক বৃহত্তম দলে পরিণত হল। অটলজী দশম প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ নিলেন। কিন্তু নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা না থাকায় ১৩ দিনের মাথায় সরকারের পতন ঘটলো। বিদায়ী প্রধানমন্ত্রীর সাংসদীয় ভাষণ হয়ে রইলো এক চিরস্মরণীয় বক্তৃতা।
এদিকে বিজেপিকে সরাতে কংগ্রেসের সমর্থনে পুষ্ট সংযুক্ত মোর্চার সরকার কিন্তু টিকলো না। ১৯৯৮ সালে ফের নির্বাচনে বিপুল খরচের মুখোমুখি হল দেশ। এবারও বৃহত্তম দল হিসাবে বিজেপি-র পুনঃপ্রতিষ্ঠা। গঠিত হল বাজপেয়ীজীর নেতৃত্বে এনডিএ সরকার, বিজেপি যার মধ্যমণি। কিন্তু তেরো মাসের মাথায় জয়ললিতার এআইডিএমকে সমর্থন প্রত্যাহার করে সরকার ফেলে দিলেন। ১৯৯৯ সালে ফের নির্বাচন। জনগণ স্পষ্ট রায়ে ফের বিজেপিকে প্রতিষ্ঠা দিলেন। বাজপেয়ীজীর নেতৃত্বে এটাই পূর্ণ সময়ের প্রথম অ-কংগ্রেসী সরকার।
সুশাসন কাকে বলে দেশনায়ক হিসাবে তৃতীয় কার্যকালে পরিচয় দিলেন তিনি। এক নব ভারতের স্বপ্ন তাঁর চোখে। যার নাম ‘স্বর্ণ চতুর্ভুজ’ যোজনা। সুগম-সড়কের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপিত হল। ৫৮৪৬ কিলোমিটার সেই ঝাঁ চকচকে দ্রতগামী মহাসড়ক আজ যোগ করেছে দিল্লি, কলকাতা, চেন্নাই ও মুম্বাইকে। পথ-প্রবাহে যুক্ত হয়েছে দেশের অসংখ্য শিল্প-কৃষি-শিক্ষা-সংস্কৃতির অনবদ্য কেন্দ্রগুলি। দেশ একসূত্রে গেঁথেছে৷
অটলজীর কূটনৈতিক সাফল্য এবং ভারসাম্য প্রশ্নাতীত। ‘বন্ধু বদলানো যায়, কিন্তু প্রতিবেশী বদল হয় না।’ তাই পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কের উন্নতির চেষ্টা করলেন। পাক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে চললো সদর্থক আলোচনা। ভারত-পাক বাসযাত্রার শুভ সূচনা হল। পাশাপাশি ভারত যে আপন সামর্থ্যে এগিয়ে যেতে লক্ষ্যচ্যুত হবে না, সে প্রমাণ দিলেন পোখরান পরমাণু বিস্ফোরণের পরীক্ষায়। বৃহৎ বিশ্বশক্তির অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি হল। অসামান্য দক্ষতায় এবারও সামলে নিলেন অটলজী৷ উপরন্তু কূটনৈতিক দক্ষতায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিন্টনকে ভারত সফরে আনলেন। এক নতুন যুগের সূচনা হল।
সংসদে তাঁর অতুল্য বক্তৃতায়, বিরোধী নেতার কণ্ঠস্বরে, সরকারি প্রভাষণে কে না মুগ্ধ হয়েছেন! ১৯৭৯ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘে তিনি হিন্দি ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে দেশের সে গরিমা আন্তর্জাতিক স্তরে বৃদ্ধি করলেন।
একসময় তাঁর দল সংসদে মাত্র দুটি আসন জিতেছিল। অন্য সদস্যরা হাসাহাসি করতেন। দীপ্তকণ্ঠে তিনি সংসদে বললেন, আজ আপনারা যে সংখ্যার বিচারে বিজেপিকে বিদ্রুপ করছেন, একদিন সংখ্যার সেই অমোঘ সত্য আপনাদের লজ্জাকেই বেআব্রু করবে। কথাটা ফলতে খুব দেরী হল না। ২০১৪ সালে বিজেপি এককভাবে ২৮২ আসন পেল, ২০১৯ সালে পেল ৩০৩টি আসন। এই বিজেপিই এখন নিষ্কণ্টকভাবে দেশ শাসন করছে, দেখিয়ে দিয়েছে সুশাসন কাকে বলে। তা অটলজীরই উত্তরাধিকার। এই দলই আগামীদিনে তাঁর আশীর্বাদ লাভ করে ৪০০-র সাংখ্যমান পেরিয়ে যাবে। আর সংখ্যা নিয়ে বিরোধীদের বিদ্রূপ তখন আপন কথার অসারতাকে জাগিয়ে তুলবে। অটলজী কিন্তু কাউকে কোনদিন অন্যায় আক্রমণ করেন। কবি কণ্ঠে তাই শুনতে পাওয়া যায় —
‘পূর্ণতার মহামন্ত্র অন্তরের সুধা
ভারতের পুণ্যভূমে রাজিল বসুধা।
সৌকর্য কবিত্বময় নিরন্তর জাগে
আত্মজয়-সুবচন ধায় পুরোভাগে।’
ভারতবর্ষের সংজ্ঞা-স্বরূপ কী, অটলজী লিখছেন —
‘ভারত জমীন কা টুকরা নহীঁ
জীতা জাগতা রাষ্ট্রপুরুষ হ্যায়
ইসকা কংকর-কংকর শঙ্কর হ্যায়।
ইসকা বিন্দু বিন্দু গঙ্গাজল হ্যায়।
হম জিয়েঙ্গে তো ইসকে লিয়ে
মরেঙ্গে তো ইসকে লিয়ে।’
২০১৮ সালের ১৬ই আগষ্ট ৯৩ বছর বয়সে দিল্লির AIIMS-এ পরলোকগমন করেন। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে সুভদ্র-রাজনীতির একটি বিরল ধারার পরিসমাপ্তি ঘটে। স্বয়ংসেবক হিসাবে অটলজী বিশ্বভারতের বিশ্ববাণীর প্রচারক। খণ্ড খণ্ড করে না দেখে তিনি সমগ্র ভারতকে নিয়ে চলেছেন। তাঁর সুশাসনে ছিল না আঞ্চলিকতার স্থান, ছিল না সাম্প্রদায়িক বৈষম্য। বৈশ্বিক রাজনীতিতে তিনি ভারতকে চালকের আসনে স্থির করেছেন। নরেন্দ্র মোদীজী তারই উত্তরাধিকার। জন্মশতবর্ষে ব্রহ্মবিহারী অটলজীকে শতকোটি প্রণাম জানাই।
তথ্যসূত্র: স্বস্তিকা ৭৬(১৪), ২০২৩
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী