কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছিলেন —-
কোথায় ফলে সোনার ফসল, সোনার কমল ফোটে রে?
সে আমাদের বাংলাদেশ, আমাদেরই বাংলা রে!
আমাদের অখন্ড বাংলা আজ বিভক্ত। একসময়ের পূর্ববঙ্গ আজ ইসমালিক বাংলাদেশ। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হওয়ার ইতিহাস রক্তাক্ত। কাঁটা তারের এপারে ‘আপাতত সুরক্ষিত’ যে ভূমিতে হিন্দু বাঁচার আশায় এখনো বিশ্বাসী তাঁর নাম —- পশ্চিমবঙ্গ।
ইসলামিক বাংলাদেশে প্রতিবছর দুর্গাপূজার সময় মূর্তি ভাঙচুরের খবর পাওয়া যায়, হিন্দু যুবতীদের জোরপূর্বক ধর্মান্তরণের খবর পাওয়া যায় তা দেখে পশ্চিমবঙ্গে সুরক্ষিত হিন্দুর বাসভূমির পেছনের নায়ককে স্মরণ করতেই হয়। এই পশ্চিমবঙ্গ ছিল বলেই লক্ষাধিক হিন্দু ওপার বাংলা থেকে ভিটেমাটি ছেড়ে শুধুমাত্র নারীর সম্ভ্রম ও জীবনরক্ষার আশায় পশ্চিমবঙ্গে পাড়ি দিয়েছে বছরের পর বছর। একসময় যারা স্লোগান তুলেছিল ‘বাংলা ভাগ করলো কে ? শ্যামাপ্রসাদ আবার কে? ‘ সেই কমিউনিস্টরাও নিজেদের কমিউনিজমের তত্ত্বকে ইসলামিক বাংলাদেশে চালাতে পারে নি।
ভারতকেশরী ছিল বলেই হয়তো যে বাঙালি স্বামী বিবেকানন্দ , রবীন্দ্রনাথ , সুভাষচন্দ্রের একজাতীয় বলে গর্ববোধ করে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতো। হিটলারের ইহুদী নিধন যজ্ঞের ইতি টেনেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির পরাজয় কিন্তু বাঙালি তথা হিন্দু নিধন যজ্ঞের ইতি টানতে হিন্দুদের সুরক্ষিত বাসভূমি ‘পশ্চিমবঙ্গ’ সৃষ্ট করতে শ্যামাপ্রসাদ যে রাজনৈতিক যুদ্ধে জয়ী হয়েছিলেন তার তাৎপর্য হিন্দু বাঙালি সময়ের প্রবাহের সাথে বেশি করে উপলব্ধি করছে।
একসময় অখন্ড বাংলার অর্থনৈতিক , সামাজিক ও আধ্যাত্মিক জাগরণকে স্তব্ধ করতে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব করেছিল। সেই চক্রান্তের বিরুদ্ধে আপামর বাঙালি সমাজে জাতীয়তাবাদের স্ফূরণ হয়েছিল আর সেই একাত্মবোধকে ধ্বংস করতে লর্ড কার্জনের প্ররোচনায় হিন্দু-মুসলিম বিভেদকে হাতিয়ার করতে মুসলিম লীগের জন্ম হয়। তবুও ৬ বছর পর বঙ্গভঙ্গ রদ করতে হয়। কিন্তু তার ৩৬ বছর পর কি এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হলো যে হিন্দু সমাজ বঙ্গভঙ্গের মধ্যেই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার আশা দেখতে পেলো ?
১৯০৯ সালে Indian Council Act অনুযায়ী প্রথম মুসলমানদের স্বতন্ত্র নির্বাচন অধিকার দিয়ে বিভেদের বীজ পোঁতা হয়। ইংরেজের মুসলীম লীগ পোষণের পর কংগ্রেসের মুসলীম লীগ তোষণ শুরু হয়। উভয়ের মধ্যে লখনৌ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে কংগ্রেস নিজেদের আদর্শ বিসর্জন দিয়ে হিন্দু মুসলমানের পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা মেনে নেয়। তাছাড়া যে সমস্ত প্রদেশে মুসলমানরা সংখ্যালঘু সেসব প্রদেশে মুসলমানদের জনসংখ্যার অনুপাত এর চেয়ে বেশি আসন দেওয়ার নীতি ও মেনে নেওয়া হয়। বাংলার আইন পরিষদে ১৪৪ জন সদস্যের মধ্যে সাধারণ আসন সংখ্যা ছিল ৩৯ সংরক্ষিত মুসলিম আসন ছিল ৪৬। পুরো বাংলা যে মুসলিম শাসনাধীনে যাবে তার বীজ পোঁতা হলো ১৯১৯ এর শাসনব্যবস্থা ও লখনৌ চুক্তির মাধ্যমে।মুসলিম সমাজকে স্বাধীনতা আন্দোলনে সঙ্গে পেতে গান্ধীজির খিলাফত আন্দোলনকে সমর্থন সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন , হিন্দু নিধন ও অখন্ড ভারতের বিভাজনের ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
সাম্প্রদায়িক বাটোয়ারা মাধ্যমে হিন্দু সমাজকে বর্ণ হিন্দু ও বিবর্ণ হিন্দুতে ভাগ করে আসন বন্টন হল। পাঞ্জাবেও একই কাজ করা হলো। বাংলা ও পাঞ্জাব এই দুটি প্রদেশের হিন্দু ও শিখদের উপর ইংরেজের জাত ক্রোধ কারণ এদের হাতেই সহিংস ও অহিংস পন্থায় ব্রিটিশ প্রশাসনকে নাকানি চোবানি খেতে হয়েছিল। কবিগুরু এই সাম্প্রদায়িক বাঁটোয়ারাতে অশনি সংকেত দেখেছিলেন। এর মধ্যেই ১৯১৭ থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত দেশে বিদেশে মুসলিম লীগ ও বিভিন্ন মুসলমান নেতৃবৃন্দ ভারত ভাগ তথা পাকিস্তান প্রস্তাবের পক্ষে সমর্থন ও পরিকল্পনা গ্ৰহণ করে। ‘সারে জাঁহাসে আচ্ছা’র কবি মহম্মদ ইকবাল এর মধ্যে অন্যতম। একসময়ের কংগ্ৰেসী মহম্মদ আলি জিন্না লীগ রাজনীতির ভার গ্ৰহণ করলেন। মুসলমানদের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বে যখন মুসলিম লীগ নিজেদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করছে , কংগ্রেস মুসলমানদের মন পেতে লীগের সঙ্গে আপোসের পথ নিয়েছ কিন্তু হিন্দুর স্বার্থরক্ষা দূরে থাক, স্বাধীনতা সংগ্রামের মন্ত্র ‘বন্দেমাতরম্’ থেকেও নিজেদের দূরত্ব বাড়াতে শুরু করেছে কংগ্রেস। শিক্ষাক্ষেত্রে অভিজ্ঞ শ্যামাপ্রসাদের এইসময় রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। তিনি ১৯২৯ সালে কংগ্রেস প্রার্থী হিসেবে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন।১৯৩৭ সালের নির্বাচনে কংগ্রেস বৃহত্তম দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও কৃষক প্রজা পার্টির ফজলুল হকের সাথে সরকার গঠনে অসম্মত হয়। ফলে কৃষক প্রজা পার্টির সঙ্গে মুসলিম লীগ ক্ষমতা দখল করে। ফলে বাংলায় কার্যত মুসলমান শাসন স্থাপিত হয় এবং তারা শিক্ষা ক্ষেত্রে অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ শুরু করে এবং সমাজের সর্বক্ষেত্রে হিন্দুদের বঞ্চিত করে। এই অবস্থায় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী বীর সাভারকারের ডাকে হিন্দু মহাসভায় যোগদান করেন। এই অবস্থায় লাহোরে মোহাম্মদ আলী জিন্নার সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের অধিবেশনে পাকিস্তান প্রস্তাব গৃহীত হয়। সুভাষচন্দ্র বিহীন কংগ্রেসের দৃঢ়তার অভাবে জিন্না পাকিস্তানের দাবিতে অনড় থাকে। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী দেশ বিভাজনের বিরুদ্ধে মুখর হন এবং জিন্নাহর বিভেদ নীতি সম্পর্কে সবপক্ষকে বোঝাতে থাকেন।১৯৪০ -৪১ এ নোয়াখালী ও ঢাকার দাঙ্গায় হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়। ১৯৪১ সালে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ হক সরকার থেকে সমর্থন তুলে নিলে হিন্দু মহাসভার সমর্থনে ফজলুল হক সরকার গঠন করে। এই সময় শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী আইন পরিষদের ভিতরে পাকিস্তান দাবির বিপক্ষে নিজের দায়িত্ব পালন করেন।১৯৪৫ সালের দেশব্যাপী সাধারণ নির্বাচনে জিতে কংগ্রেস সরকারি যোগদানের সিদ্ধান্ত নিল কিন্তু মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভায় যোগদানে বিরত থাকলো। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ জিতলে সুরাহবর্দী প্রধানমন্ত্রী হন। পাকিস্তানের দাবিতে ১৬ই অগাস্ট ১৯৪৬ সালে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের ডাক দেয় মুসলিম লীগ। প্রথমে কলকাতায় ও পরে নোয়াখালী ত্রিপুরা ঢাকা-চট্টগ্রাম প্রভৃতি অঞ্চলে হিন্দুদের উপর একতরফা আক্রমণ লুটপাট নারীজাতির লাঞ্ছনা অগ্নিসংযোগের অবন্তী ঘটনা ঘটলো। বাঙালি হিন্দুর নিরাপদ বাসভূমির জন্য শ্যামাপ্রসাদ বাংলা ভাগের ডাক দিলেন। অন্যদিকে হোসেন শহীদ সুরাবর্দি স্বাধীন যুক্তবঙ্গের পক্ষ নিল , যাতে পরবর্তীকালে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ যুক্তবঙ্গ কে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত করে দেওয়া যায়।১৬ ই অক্টোবর, ১৯৪৬ এর নোয়াখালী দাঙ্গার প্রদুত অঞ্চল পরিদর্শন করে আচার্য কৃপালিনী বিবৃতি দেন। মুসলিম লীগের শাসনাধীন বাংলায় হিন্দুদের উপরে অত্যাচারের খবর যাতে বহির্বিশ্ব জানতে না পারে সেই চেষ্টার কোন খামতি ছিল না। সেই সময়ে বাংলার গভর্নর বারজ মন্তব্য করেন যে এক ডজন গান্ধীরও সাধ্য নেই নোয়াখালীতে শান্তি ফিরিয়ে আনার। এই সময় অবিভক্ত পাজ্ঞাবেও পাকিস্তানের দাবিতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। তারকেশ্বরে হিন্দু মহাসভার কনফারেন্সে বাংলা ভাগের দাবিকে গণ দাবিতে পরিণত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জী আইনসভার কংগ্রেসী প্রতিনিধিদের প্রতি আহ্বান জানান যে হিন্দুদের ভোটে জিতেছেন ,হিন্দু স্বার্থ রক্ষা করুন। কেন্দ্রীয় কংগ্রেসের মতামতের তোয়াক্কা না করে হিন্দু মহাসভার প্রস্তাব আনুসারে বাংলার হিন্দু গরিষ্ঠ ও মুসলমান গরিষ্ঠ অঞ্চলের জন্য দুটি আলাদা মন্ত্রিসভা গঠনের দাবি তোলা হয়। মাউন্টব্যাটেন কে শ্যামাপ্রসাদ বলেন পাকিস্তান সৃষ্টি হলে বাংলা ভাগ করতেই হবে। বাংলা ভাগের দাবিতে ঐতিহাসিক যদুনাথ সরকার, বিজ্ঞানী ডঃ মেঘনাদ সাহা , ভাষাবিদ ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় সহ আরো শিক্ষাবিদ যুক্ত হন। অমৃতবাজার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বাংলা বিভাজনের পক্ষে জনমত সংগ্রহ করা হয়। বেশিরভাগ হিন্দু বাংলা ভাগের পক্ষে দাঁড়ায়, এমনকি বিভিন্ন বার অ্যাসোসিয়েশন ও সামাজিক সংগঠন বাংলা ভাগের দাবিতে সোচ্চার হয়। অবশেষে ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বঙ্গীয় আইনসভায় দুই বাংলার বিধায়কগনের ভোটে বাংলা ভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। জিন্না পাকিস্তান পেলেন কিন্তু ঐতিহাসিকরা বলেন সেই পূর্বপাকিস্তান থেকে পশ্চিমবঙ্গকে ছিনিয়ে নেওয়ার কৃতিত্ব শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির।
আজ যদি কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘কোন দেশে’ কবিতার ‘বাংলাদেশ’ খুঁজতে হয় তাহলে তা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির জন্যই এই পশ্চিমবঙ্গেই অবশিষ্ট আছে —–
“চন্ডীদাসের রামপ্রসাদের কন্ঠ কোথায় বাজেরে? সে আমাদের বাংলাদেশ, আমাদেরই বাংলা রে!”
পিন্টু সান্যাল