RSSorg – রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের সরসংঘচালক ডঃ মোহন ভাগবৎ-এর বিজয়াদশমী ভাষণ নাগপুর- 24/10/2023

আজকের অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি এবং মঞ্চে উপস্থিত শ্রদ্ধেয় শ্রী শঙ্কর মহাদেবন কী, মাননীয় সরকার্যবাহজী, বিদর্ভ প্রান্তের মাননীয় সংঘচালক, নাগপুর মহানগরের মাননীয় সংঘচালক, অন্যান্য কার্যকর্তাবৃন্দ, সজ্জন নাগরিকবৃন্দ, মাতৃমণ্ডলী, এবং প্রিয় স্বয়ংসেবক বন্ধুরা।

মানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে মানবতার বিষয়কে চিহ্নিত করতে আমরা প্রতি বছর বিজয়াদশমী উদযাপন করি। এই বছর এই উৎসব গর্ব, আনন্দ এবং দেশবাসীর মনে উদ্দীপনা সঞ্চারকারী ঘটনাবলী নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।

গত এক বছর ধরে, বিভিন্ন বৃহৎ রাষ্ট্রের সংগঠন ‘জি-২০’ –র সভাপতিত্বের ভূমিকায় ছিল আমাদের দেশ। সারা বছর ধরে, ভারতের বিভিন্ন জায়গায় রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, প্রশাসকবৃন্দ এবং রাজনীতিবিদদের উপস্থিতিতে বহু অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। ভারতীয়দের উষ্ণ আতিথেয়তার অভিজ্ঞতা, ভারতের গৌরবময় অতীত এবং বর্তমানের উৎসাহপূর্ণ উত্থান সমস্ত দেশের অংশগ্রহণকারীদের মুগ্ধ করেছে।

আফ্রিকান ইউনিয়নকে সদস্য হিসাবে গ্রহণ করা এবং সেই সংক্রান্ত প্রস্তাব প্রথম দিনেই পরিষদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের প্রকৃত সদিচ্ছা এবং কূটনৈতিক দক্ষতার অভিজ্ঞতা সকলেই অনুভব করেছেন। ভারতের অনন্য চিন্তাভাবনা এবং দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে, ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্‌’-এর দর্শন সমগ্র বিশ্ব এক নতুন দিশা হিসাবে গ্রহণ করেছে। জি-২০ এর অর্থনীতিকেন্দ্রিক ধারণা এখন মানবকেন্দ্ৰিক উদ্যোগ হয়ে উঠেছে। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমাদের দেশের বর্তমান নেতৃত্ব বিশ্ব মঞ্চে ভারতকে অন্যতম প্রধান এবং প্রভাবশালী রাষ্ট্র রূপে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রশংসনীয় কাজ করেছেন।

এবারে, আমাদের দেশের ক্রীড়াবিদরা !এশিয়ান গেমস’-এ ১০৭ টি পদক (২৮ টি স্বর্ণ, ৩৮ টি রৌপ্য এবং ৪১ টি ব্রোঞ্জ) জয় করে আমাদের সকলের আনন্দ- উৎসাহ বৃদ্ধি করেছেন। আমরা তাঁদের অভিনন্দন জানাই। চন্দ্র অভিযানের ক্ষেত্রে বিশ্ব মানচিত্রে উদীয়মান ভারতের শক্তি, বুদ্ধিমত্তা এবং কারিগরি কৌশল আজ স্বীকৃত। দেশের বর্তমান নেতৃত্বের আগ্রহ আমাদের বিজ্ঞানীদের জ্ঞান এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার সাথে যুক্ত হয়েছিল। মহাকাশ গবেষণার ইতিহাসে এই প্রথম ভারতের বিক্রম ল্যান্ডার চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে অবতরণ করেছে। যে সমস্ত বিজ্ঞানীরা এই কাজটি সম্পন্ন করেছেন, তারা সমস্ত ভারতীয়কে গর্বিত করেছেন এবং দেশের মানুষের আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলেছেন। তাঁদের সমগ্র দেশ সম্মান জানাচ্ছে।

সমগ্র জাতির প্রেরণার উৎস হল জাতীয় আদর্শ এবং এই আদর্শ সেই জাতির বৈশ্বিক উদ্দেশ্য অর্জনে দিশা দেখায়। তাই, আমাদের সংবিধানের মূল প্রতিকৃতির পাতায় যে ভগবান শ্রীরামের চিত্র রয়েছে তাঁরই শ্রীমন্দির অযোধ্যায় নির্মিত হচ্ছে। ঘোষণা করা হয়েছে যে ২২ শে জানুয়ারি মন্দিরের গর্ভগৃহে শ্রী রামলালার শুভ অভিষেক অনুষ্ঠিত হবে। ব্যবস্থার সুবিধার জন্য এবং নিরাপত্তা জনিত কারণে, খুব সীমিত সংখ্যক মানুষ সেই শুভ অনুষ্ঠানে অযোধ্যায় উপস্থিত থাকতে পারবেন। শ্রীরাম আমাদের দেশে মানবিক আচরণের প্রতীক, মর্যাদার প্রতীক, কর্তব্য পালনের প্রতীক, স্নেহ ও করুণার প্রতীক। শ্রীরাম মন্দিরে শ্রী রামলালার প্রবেশ নিয়ে প্রতিটি স্থানেই এমন পরিবেশ তৈরি করা উচিত, যাতে সকলের হৃদয়ে শ্রীরাম জাগ্রত হন। আমাদের মননে যে অযোধ্যা বিরাজিত সেখানে ভালবাসা, প্রচেষ্টা এবং শুভেচ্ছার ভাব জাগ্রত হোক। আয়োজন ছোট হোক কিন্তু সর্বত্র এই উদ্যোগ গ্রহণ করে অনুষ্ঠান হোক।

বিগত কয়েক শতাব্দীর সঙ্কটের ধারাবাহিকতা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে, সমস্ত সঙ্কটকে পরাজিত করে ভারত এখন নিশ্চিতভাবেই ঐহিক এবং আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে এগিয়ে চলেছে। আমরা সকলেই এই ঘটনার সৌভাগ্যবান সাক্ষী।

যিনি তাঁর জীবন দিয়ে সমগ্র বিশ্বকে অহিংসা, দয়া এবং নৈতিকতার পথ দিয়েছিলেন সেই শ্রী মহাবীর স্বামীর ২৫৫০তম নির্বাণ বর্ষ, হিন্দু স্বরাজ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিদেশীদের চাপিয়ে দেওয়া একনায়কত্ব থেকে মুক্তির পথ প্রদর্শনকারী শিবাজি মহারাজের রাজ্যাভিষেকের ৩৫০ বছর, বৃটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতা অর্জনের ৭৫ বর্ষপূর্তি এবং মহর্ষি দয়ানন্দ স্বামীর ২০০ তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করেছি এই বছরে। আগামী বছরটি এমন দুই ব্যক্তিত্বের স্মরণের বছর, যারা জাতীয় জীবনে চিরকালের অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছেন। আগামী বছর রাণী দুর্গাবতী যিনি আত্মসম্মান এবং স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগ করেছিলেন এবং উদ্যম, সাহস, ধৈর্য, বুদ্ধিমত্তা, শক্তি এবং সাহসিকতার পাশাপাশি তার প্রশাসনিক দক্ষতা এবং জন-চেতনার জন্য আদর্শ হয়ে উঠেছিলেন— তাঁর ৫০০ তম জন্মবার্ষিকী। তিনি ছিলেন ভারতীয় নারীদের সামনে সর্বাত্মক প্রতিশ্রুতি, নেতৃত্বের ক্ষমতা, উজ্জ্বল বিনয় এবং জ্বলন্ত দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

এই সঙ্গে আগামী বছর ‘কোলাপুরের (মহারাষ্ট্র) শাসক ছত্রপতি শাহুজি মহারাজের ১৫০ তম জন্মবার্ষিকী, যিনি তাঁর জনহিতৈষী এবং প্রশাসনিক দক্ষতার সাথে, সামাজিক বৈষম্যকে নির্মূল করার জন্য তাঁর সমগ্র জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।

তামিল সাধক শ্রীমৎ রামালিঙ্গ ওয়াল্লালারের ২০০ তম জন্মবার্ষিকী সম্পন্ন হয়েছে। তিনি তার যৌবনকাল থেকে দেশের স্বাধীনতার লক্ষ্যে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। দরিদ্রদের মধ্যে অন্নদানের যে কর্মসূচি তিনি আরম্ভ করেছিলেন তা এখনো তামিলনাড়ুতে চলছে। স্বাধীনতার পাশাপাশি তিনি সমাজের আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণ এবং সামাজিক বৈষম্যের সম্পূর্ণ নির্মূলের জন্য আজীবন কাজ করে গেছেন। এই সব অনুপ্রেরণাদায়ী ব্যক্তিত্বদের জীবনকে স্মরণ করে আমরা সবাই আমাদের স্বাধীনতার অমৃত মহোৎসবের পূর্ণতার দিনে সামাজিক সাম্য, ঐক্য ও আত্মরক্ষার বার্তা পাই।

মানুষের স্বাভাবিক ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টা থাকে যে সে যেন তার নিজের স্বকীয়তা ও পরিচয় রক্ষা করতে পারে। বর্তমান বিশ্বে সকলে দ্রুত একে অপরের কাছাকাছি আসছে, সমস্ত জাতির মধ্যে এই বিষয়ে উদ্বেগ লক্ষ্য করা যাচ্ছে।। সমগ্র বিশ্বকে একই রঙে রাঙানোর বা অভিন্নতা অর্জনের কোনো প্রচেষ্টা আজ পর্যন্ত সফল হয়নি, ভবিষ্যতেও সফল হবে না। ভারতের পরিচয় এবং হিন্দু সমাজের পরিচয় বজায় রাখার চিন্তা স্বাভাবিক। আজকের বিশ্বের সমসাময়িক চাহিদা মেটাতে, নিজস্ব মূল্যবোধের ভিত্তিতে, সময়ের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক ভূমিকা পালন করে ভারত অগ্রসর। আজকের বিশ্ব ভারতের কাছে এই আশা করে।

সমগ্ৰ বিশ্ব আজ উপাসনা ভিত্তিক সম্প্রদায় থেকে উদ্ভূত মতান্ধতা, ঔদ্ধত্য ও উন্মাদনার মুখোমুখি। স্বার্থের সংঘাত ও চরমপন্থার কারণে উদ্ভূত ইউক্রেন বা গাজা উপত্যকার যুদ্ধের মতো সংঘাতের কোনো সমাধান নেই। প্রকৃতি বিরুদ্ধ জীবনযাপন, স্বার্থপরতা এবং লাগাম ছাড়া ভোগবাদ নতুন নতুন শারীরিক ও মানসিক রোগের জন্ম দিচ্ছে।

মানসিক বিকার, বিশৃঙ্খলতা ও অপরাধ প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছে। চরম স্বার্থপরতার কারণে পরিবারগুলি ভেঙ্গে যাচ্ছে। প্রকৃতির সীমাহীন শোষণের কারণে দূষণ, উষ্ণতা বৃদ্ধি, ঋতুগত ভারসাম্যহীনতা এবং এর ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রতি বছরই বাড়ছে। সন্ত্রাস, শোষণ ও আগ্রাসন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে অবশিষ্ট বিশ্ব তার অসম্পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে এই সঙ্কট মোকাবিলা করতে পারে না। তাই চিরন্তন মূল্যবোধ ও ঐতিহ্যের ভিত্তিতে, ভারত নিজে উদাহরণ হয়ে বিশ্বকে প্রকৃত সুখ ও শান্তির নতুন পথ দেখাবে বলে আশা করা যাচ্ছে।

এই বিরূপ পরিস্থিতিগুলি ততটা ব্যাপক আকারে না হলেও আমাদের ভারতেও প্রকট। উদাহরণ স্বরূপ, সম্প্রতি আমরা হিমাচল প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড থেকে সিকিম পর্যন্ত হিমালয় অঞ্চলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘনঘটা প্রত্যক্ষ করছি। এসব ঘটনা ভবিষ্যতে আরো গুরুতর ও ব্যাপক সঙ্কটের পূর্বাভাস দিচ্ছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

দেশের সীমান্ত নিরাপত্তা, জল সুরক্ষা এবং পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য ভারতের উত্তর সীমান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং যে কোনও মূল্যে এটিকে সুরক্ষিত করতে হবে। নিরাপত্তা, পরিবেশ, জনসংখ্যা ও উন্নয়নের দৃষ্টিকোণ থেকে এই সমগ্র অঞ্চলকে একক হিমালয় অঞ্চল হিসাবে বিবেচনা করতে হবে। প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর এই এলাকাটিতে ভূতাত্ত্বিকভাবে এখনও ভাঙ্গা-গড়া চলছে এবং এ কারণে অস্থির। এই অঞ্চলের ভূপৃষ্ঠ, ভূতত্ত্ব, জীববৈচিত্র্য ও জল সম্পদের বৈশিষ্ট্য না জেনেই নির্বিচারে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়।

এই অবিমৃষ্যকারিতার ফলে এই অঞ্চল এবং সমগ্র দেশ সংকটের কিনারায় দাঁড়িয়ে। আমরা সকলেই জানি যে এই অঞ্চলটি ভারত সহ পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার সমস্ত দেশে জল সরবরাহ করে। এই এলাকায়, বহু বছর ধরে ভারতের উত্তর সীমান্তে চীনের পদদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। তাই এই এলাকার বিশেষ ভূতাত্ত্বিক, কৌশলগত এবং ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে। এই কথা মাথায় রেখে এই এলাকাটি কে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করতে হবে।

যদিও এই ঘটনাগুলি হিমালয় অঞ্চলে বেশি ঘটছে, তবুও দেশের বাকি অংশের জন্য এগুলি সতর্কতার বার্তা। অপরিণামদর্শী, বস্তুবাদী ও চরম ভোগবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর ওপর ভিত্তি করে উন্নয়নের পথে এগোনোর ফলে মানবতা ও প্রকৃতি ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে ধাবিত হচ্ছে। সারা বিশ্বে এই উদ্বেগ বাড়ছে। এই সব ব্যর্থতার পথ পরিত্যাগ করে, অথবা ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়িয়ে, ভারতীয় মূল্যবোধ তথা ভারতের সামগ্রিক একাত্মতার দৃষ্টিভঙ্গীর ভিত্তিতে, কালানুগ ও আধুনিক প্রয়োজন অনুযায়ী পরিবর্তিত নিজস্ব স্বতন্ত্র উন্নয়নের পথ এই দেশকেই তৈরি করতে হবে। এটি ভারতের জন্য উপযুক্ত হবে এবং বিশ্বের জন্য একটি অনুকরণীয় মডেল হতে পারে। আমাদেরকে অন্ধ অনুকরণ, জড়তা ও গোঁড়ামি, তুল পথে চলার প্রবণতা ত্যাগ করতে হবে। আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে মুক্ত হতে হবে এবং আমাদের দেশের জন্য যা উপযোগী তা বিশ্বের অন্য অংশ থেকে গ্রহণ করতে হবে। আমাদের দেশে যা আছে তা সময়ের উপযোগী করে আমরা আমাদের নিজস্ব স্বআধারিত উন্নয়নের স্বদেশী বিকাশের পথ গ্রহণ করতে পারি, এটাই সময়ের আবশ্যকতা।

এই দৃষ্টিকোণ থেকে, সাম্প্রতিক কিছু নীতির পরিবর্তন হয়েছে এমনটা দৃষ্টিগোচর হয়। সমাজেও কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, পরিষেবা, সমবায় ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে নিত্য নতুন সফল পরীক্ষার সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। কিন্তু প্রশাসনের ক্ষেত্রে এবং বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যারা সব ক্ষেত্রে চিন্তাভাবনা করেন এবং দিক্‌নির্দেশনা দেন— তাদের মধ্যে এই ধরণের সচেতনতা বেশি প্রয়োজন। সরকারের ‘স্ব’নির্ভর সুযোগ- সুবিধা, প্রশাসনের তৎপরতা, ধারাবাহিক ও জনমুখী কাজ এবং উন্নয়নমূলক কাজে সমাজের সহযোগিতা ও সমর্থনই দেশকে পরিবর্তনের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবে।

কিন্তু এটা যাতে সম্ভব না হয়, সমাজের ঐক্য যাতে বিঘ্নিত হয় এবং দেশে বিচ্ছিন্নতা ও সংঘাত বৃদ্ধি পায় সেই অপচেষ্টাও বাড়ছে। আমাদের অজ্ঞতা, অবিবেচনা, পারস্পরিক অবিশ্বাস বা অসতর্কতার কারণে সমাজের কোথাও কোথাও এ ধরনের অপ্রত্যাশিত অশান্তি ও বিভেদ বাড়তে দেখা যায়। ভারতের উত্থানের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্ব কল্যাণ। কিন্তু এই উত্থানের স্বাভাবিক ফল হিসেবে স্বার্থপর, বিভেদকারী ও প্রতারক শক্তিগুলোর চিহ্ণিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে যায় – তাই তাদের পক্ষ থেকে এই উত্থানের নিরন্তর বিরোধিতাও চলছে।

এই দেশ বিরোধী শক্তিগুলি কোনো না কোনো মতাদর্শের ছদ্মবেশে এবং কিছু মনমোহিনী ঘোষণা বা লক্ষ্যের জন্য কাজ করার ভান করে, কিন্তু তাদের আসল উদ্দেশ্য অন্য কিছু। মতাদর্শ নির্বিশেষে যারা সত্য এবং নিঃস্বার্থ বুদ্ধিতে কাজ করে, যে কোনো ধরণের কাজই করুক না কেন, তাদে জন্য সর্বদা এইসব অপশক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

আজকাল এই সর্বগ্রাসী শক্তির লোকেরা নিজেদেরকে সাংস্কৃতিক মার্কসবাদী বা (Woke) ‘জাগ্রত জনতা’ হিসাবে নিজেদেরকে তুলে ধরে। কিন্তু ১৯২০ সালের পর তারা মার্কসকেও ভুলে গেছে। তারা পৃথিবীর সকল শৃঙ্খলা, সমৃদ্ধি, আচার-অনুষ্ঠান ও সংযমের বিরোধী। যাতে মুষ্টিমেয় কিছু লোক সমগ্ৰ মানৰ জাতিকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে তারা নৈরাজ্য ও স্বৈরাচারের ওকালতি করে, প্রচার করে এবং ছড়িয়ে দেয়। মিডিয়া ও বিভিন্ন শিক্ষা সংস্থান কুক্ষিগত করে দেশের শিক্ষা, মূল্যবোধ, রাজনীতি ও সামাজিক পরিবেশকে বিভ্রান্তি ও দুর্নীতির আখড়া করে তোলাই তাদের কাজের ধরণ।

এই পরিস্থিতিতে মিথ্যা, বিকৃত ও অতিরঞ্জিত তথ্য এর মাধ্যমে ভয়, বিভ্রান্তি ও বিদ্বেষ সহজেই ছড়িয়ে পড়ে। পারস্পরিক দ্বন্দ্বে জর্জরিত, বিভ্রান্ত, দুর্বল ও ভঙ্গুর সমাজ অজান্তেই এই ধ্বংসাত্মক আধিপত্যবাদী শক্তির শিকারে পরিণত হয়। আমাদের ইতিহাসে এই ধরনের কাজ যা একটি জাতির মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস, বিভ্রান্তি এবং পারস্পরিক বিদ্বেষ সৃষ্টি করে তাকে “মন্ত্ৰবিপ্লব” বলে।

দেশে রাজনৈতিক স্বার্থপরতার কারণে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীকে পরাজিত করতে এ ধরনের অবাঞ্ছিত শক্তির সঙ্গে জোট গঠন করা অবিবেচক কাজ। যেখানে আগে থেকেই সমাজ আত্মবিস্মৃত হয়ে, নানা ধরনের বিভাজনে জর্জরিত এবং স্বার্থপরতা, হিংসা ও বিদ্বেষের মারাত্মক প্রতিযোগিতায় জড়িয়ে পড়েছে। সেজন্য এই সব আসুরিক শক্তিগুলোও সমাজ বা রাষ্ট্রের বিভাজনকারী অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক শক্তির সমর্থন পায়।

মণিপুরের বর্তমান অবস্থার দিকে তাকালে এই বিষয়টি মাথায় আসে। প্রায় এক দশক ধরে শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকা মণিপুরে হঠাৎ করে এই পারস্পরিক বিরোধ কিভাবে শুরু হলো? যারা হিংসা করেছে তাদের মধ্যে কি সীমান্তের ওপারের চরমপন্থীরাও ছিল?

কেন এবং কাদের দ্বারা নিজেদের অস্তিত্বের ও ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কিত মণিপুরী মেইতেই সম্প্রদায় এবং কুকি সম্প্রদায়ের মধ্যে এই পারস্পরিক দ্বন্দ্বকে একটি সাম্প্রদায়িক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল? বছরের পর বছর ধরে সমান দৃষ্টি দিয়ে সকলের সেবায় নিয়োজিত সংঘের মতো একটি সংগঠনকে, বিনা কারণেই এর মধ্যে টেনে আনায় কাদের গোপন স্বার্থ আছে? এই সীমান্ত এলাকায় নাগ-ভূমি ও মিজোরামের মধ্যে অবস্থিত মণিপুরে এমন অস্থিরতা ও অস্থিতিশীলতার সুযোগ নিতে কোন বিদেশী শক্তি আগ্রহী হতে পারে? দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনীতিরও কি এই ঘটনার কারণগত ঐতিহ্যের কোনো ভূমিকা আছে? দেশে শক্তিশালী সরকার থাকা সত্ত্বেও কার জোরে এত দিন ধরে এই সহিংসতা নির্বাধে চলতে থাকে? গত ৯ বছর ধরে চলমান শান্তি বজায় রাখতে চেয়েছিল এমন একটি রাজ্য সরকার থাকা স্বত্বেও কেন এই হিংসা ছড়িয়ে পড়ে এবং চলতে থাকে? বর্তমান পরিস্থিতিতে যখন সংঘাতে জড়িয়ে পড়া উভয় পক্ষের মানুষ শান্তি কামনা করছে, তখন সেই দিকে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দুর্ঘটনা ঘটিয়ে আবার ঘৃণা ও সহিংসতাকে উস্কে দেওয়া শক্তিগুলো কারা? এই সমস্যা সমাধানে বহুমাত্রিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন আছে।

এ জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সমন্বিত সক্রিয়তা ও কর্মদক্ষতা যেমন সময়ের প্রয়োজন, তেমনি পারস্পরিক অবিশ্বাসের বাতাবরণ দূর করতে সমাজের আলোকিত নেতৃত্বকেও বিশেষ ভূমিকা পালন করতে হবে। এই দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতি উদ্বেগের। সংঘের স্বয়ংসেবকরা সামাজিক স্তরে নিরন্তর সকলের সেবা ও ত্রাণ কার্যে নিরত থেকে সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন শক্তির কাছে শান্তির জন্য আবেদন করছে।

সবাইকেই আপনজন বলে মনে করে নিরাপদ, সংগঠিত, সম্প্রীতিপূর্ণ এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য, সব ধরনের মূল্য দিতে প্রস্তুত থেকে কার্যরত থাকাই হল সংঘের প্রয়াস। যেভাবে এই ভয়ানক এবং অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতেও ঠান্ডা মাথায় তারা সবাই কে সামলানোর চেষ্টা করেছে সেজন্য আমরা আমাদের স্বয়ংসেবকদের জন্য গর্বিত। I

এই ‘মন্ত্র বিপ্লবের’-সঠিক উত্তর সমাজের ঐক্যের মাধ্যমেই পাওয়া যাবে। প্রতিটি পরিস্থিতিতে এই ঐক্যবোধই সমাজের বিবেককে জাগ্রত রাখে। এই মানসিক ঐক্য অর্জনের বিষয়টিও সংবিধানে নির্দেশনামূলক নীতি হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিটি দেশে, এই ঐক্যের অনুভূতি সৃষ্টিকারী ভিত্তিটি ভিন্ন। কোথাও সে দেশের ভাষা, কোথাও সে দেশের বাসিন্দাদের সাধারণ উপাসনা বা বিশ্বাস, কোথাও সবার অভিন্ন ব্যবসায়িক স্বার্থ, কোথাও কোথাও কেন্দ্রীয় ক্ষমতার দৃঢ় বন্ধন দেশের মানুষকে একত্রিত করে। কিন্তু মানবসৃষ্ট কৃত্রিম ভিত্তি বা স্বার্থের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা ঐক্যের সুতো টেকসই নয়। আমাদের দেশে এত বৈচিত্র্য যে এক দেশ হিসেবে এই দেশের অস্তিত্ব বুঝতে মানুষের সময় লাগে। কিন্তু আমাদের এই দেশ, জাতি হিসেবে, সমাজ হিসেবে, বিশ্ব ইতিহাসের সব চড়াই-উতরাই পেরিয়ে অতীতের সূত্রে অটুট সংযোগ বজায় রেখে আজও বেঁচে আছে।

“यूनान मिस्र रोमा सब मिट गए जहां से, अब तक मगर है बाक़ी नामो निशां हमारा, कुछ बात है कि हस्ती मिटती नहीं हमारी, सदियों रहा है दुश्मन दौर जहां हमारा”

গ্রীস, মিশর, রোম সব যাদের দ্বারা বিলীন হয়ে যায়, কিন্তু আমাদের নাম ও পতাকা আজো অম্লান, কিছু কথা আছে যে আমাদের মহানতা হারায় না, শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে শত্রুতার মুখমুখি আমরা।

এই জাতীয় ঐক্যের ঐতিহ্য ভারতের বাইরের মানুষের মনকে বিস্মিত করে রাখে, সকলের মন আকর্ষিত হবে এরকম ঐক্য আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। এই ঐক্যের পিছনে রহস্য কি? নিঃসন্দেহে এটা আমাদের সর্বাঙ্গীণ সংস্কৃতিই। পূজা, পরম্পরা, ভাষা, জাতপাত ইত্যাদি ভেদের উর্ধে উঠে, আমাদের নিজ পরিবার থেকে সমগ্র বিশ্বকে এক পরিবারে প্রসারিত করতে শেখায় আমাদের আচরণ এবং জীবনযাপন শৈলী। আমাদের পূর্বপুরুষরা অস্তিত্বের এই মূলভূত ঐক্যের সত্য উপলব্ধি করেছিলেন।

ফলস্বরূপ, শরীর, মন এবং বুদ্ধির এক সঙ্গে উন্নতি করে থেকে তিনটিরই সুখ প্রদানকারী, অর্থ এবং কামনার সমন্বয় ঘটিয়ে আমাদের মোক্ষের দিকে চালনা কারী ধর্মতত্ব তাঁদের দ্বারা অবগত হয়েছে। সেই উপলব্ধির ভিত্তিতে, তাঁরা একটি সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলেন যা ধর্মতত্ত্বের চারটি শাশ্বত মূল্য – সত্য, করুণা, পবিত্রতা এবং তপস্যা-র বাস্তবায়ন ঘটিয়েছিল। এটা সম্ভব হয়েছে সব দিক থেকে নিরাপদ ও সমৃদ্ধ আমাদের মাতৃভূমির খাদ্যভ্যস, জল ও জলবায়ুর কারণে।

তাই আমরা আমাদের ভারত-ভূমি কে আমাদের মূল্যবোধের অধিষ্ঠাত্রী মা বলে মনে করে তাকে। ভক্তি করি, পূজা করি। সম্প্রতি আমাদের স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে স্বতন্ত্রতা সংগ্রামের মহাপুরুষদের আমরা স্মরণ করছি। যে মহাপুরুষরা আমাদের ধর্ম, সংস্কৃতি, সমাজ ও দেশকে রক্ষা করেছেন, সময়ে সময়ে তাদের প্রয়োজনীয় সংস্কার করেছেন এবং তাদের গৌরব বৃদ্ধি করেছেন, তারা হলেন আমাদের কঠোর পরিশ্রমী পূর্বপুরুষ যারা আমাদের সকলের জন্য গর্বের উৎস এবং অনুকরণীয়। এই তিনটি উপাদান –মাতৃভূমির প্রতি ভক্তি, পূর্বপুরুষদের জন্য গর্ব এবং সকলের জন্য অভিন্ন সংস্কৃতি- আমাদের দেশে বিদ্যমান ভাষা, অঞ্চল, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, বর্ণ, উপজাতি ইত্যাদির সমস্ত বৈচিত্র্যকে একত্রিত করে এবং আমাদেরকে সমর্থা এক জাতি, আমাদের ঐক্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

সমাজের স্থায়ী ঐক্য হয় আত্মীয়তা থেকে, স্বার্থপর চুক্তি থেকে নয়। আমাদের সমাজ অনেক বড়। খুব বৈচিত্রপূর্ণ, সময়ের সাথে সাথে, বিদেশ থেকেও কিছু আগ্রাসী ঐতিহ্য আমাদের দেশে প্রবেশ করে, তবুও আমাদের সমাজ এই তিনটি জিনিসের উপর ভিত্তি করে একটি অনন্য সমাজ হিসাবে থেকে যায়। তাই ঐক্যের কথা বলার সময় মনে রাখতে হবে কোনো লেনদেনের মাধ্যমে এই ঐক্য অর্জিত হবে না। জোর করে তৈরি করলে বার বার নষ্ট হয়ে যাবে। বর্তমান পরিবেশে সমাজে অনৈক্য ছড়ানোর চলমান প্রচেষ্টা দেখে স্বভাবতই অনেকেই চিন্তিত। নিজেদেরকে হিন্দু বলে এমন অনেক ভদ্রলোকও খুঁজে পাই, উপাসনা পদ্ধতি অনুযায়ী যাদের মুসলমান বা খ্রিস্টান বলা হয়, এমন লোকও পাওয়া যায়। তারা বিশ্বাস করেন যে, অবরোধ, বিবাদ ও বিদ্বেষ ত্যাগ করে মিলন, নিরাপত্তা ও শান্তির পথে চলাই সর্বোত্তম। এই আলোচনায় প্রথমেই যে কথাটি মনে রাখতে হবে তা হল, ঘটনাক্রমে বিভিন্ন সম্প্রদায় এক জায়গায় একত্রিত হওয়ার বিষয় এটি নয়। আমরা, অভিন্ন পূর্বপুরুষের বংশধর, এক মাতৃভূমির সন্তান, এক সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আমাদের পারস্পরিক ঐক্য ভুলে গেছি। আমাদের মূলভূত ঐক্য বুঝতে হবে এবং সেই ভিত্তিতে আবার ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

আমাদের মধ্যে কি কোন সমস্যা নেই? নিজেদের উন্নয়নের জন্য আমাদের কি কোনো চাহিদা প্রত্যাশা নেই? আমরা কি উন্নয়ন অর্জনের জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করি না? আমরা সবাই কি মন, বাক্য ও কর্মের মধ্যে এই ঐক্যের নীতি অনুসারে আচরণ করি? সবাই জানে যে এটা সবার ক্ষেত্রে হয় না। কিন্তু এটা ঘটুক বলে যারা চায় তারা এই বলে সন্তুষ্ট হবেন না যে, আগে সমস্যার অবসান হোক, আগে প্রশ্নগুলোর সমাধান হোক, তারপর ঐক্যের বিষয়গুলো নিয়ে ভাবব। আমাদের সকলকে বুঝতে হবে যে, আমরা যদি আত্মীয়তার দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন করে আমাদের আচরণ শুরু করি, তাহলে সমস্যার সমাধানও তা থেকে বেরিয়ে আসবে। আমাদের ইতস্ততঃ ঘটতে থাকা ঘটনাগুলিতে বিভ্রান্ত না হয়ে শাস্তি ও সংযমের সাথে কাজ করতে হবে। সমস্যাগুলো বাস্তব কিন্তু সেগুলো শুধুমাত্র একটি জাতি বা শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

সমস্যা সমাধানের প্রচেষ্টার পাশাপাশি ঘনিষ্ঠতা ও ঐক্যের মানসিকতাও তৈরি করতে হবে। ‘আমি পরিস্থিতির শিকার’ – এই মানসিকতা, একে অপরের প্রতি অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকানো অথবা রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের কৌশল থেকে সরে আসতে হবে। এ ধরনের কাজে রাজনীতি বাধা হয়ে দাঁড়ায়৷ এটি আত্মসমর্পণ বা বাধ্যতার অপর রূপ নয়। দুই যুদ্ধরত পক্ষের মধ্যে কোনো যুদ্ধবিরতি মাত্রও নয়। এটি ভারতের সমস্ত বৈচিত্র্যের মধ্যে বিদ্যমান পারস্পরিক ঐক্যের সুতোর সাথে যুক্ত হওয়ার আহ্বান। আমাদের স্বাধীন ভারতের সংবিধানের ৭৫ তম বছরও চলছে। সেই সংবিধান আমাদের এই দিক নির্দেশ করে। সংবিধান প্রণয়নের সময় গণপরিষদে শ্রদ্ধেয় ডঃ বাবাসাহেব আম্বেদকরের দেওয়া দুটি বক্তৃতার দিকে যদি আমরা মনোযোগ দেই, তাহলে একই সারমর্ম বোঝা যাবে।

এটা আকস্মিক ঘটা কোনো ঘটনা নয়। পুরানো দ্বন্দ্বের তিক্ত স্মৃতি এখনও সকলের মনে গেঁথে আছে। দেশভাগের ভয়াবহতার ক্ষত অনেক গভীর। তার কর্ম ও প্রতিক্রিয়ার কারণে মনের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরী হয় তা তার কথাবার্তা ও আচরণে প্রকাশ পায়। একে অপরের এলাকায় ঘর না পাওয়া থেকে শুরু করে একে অপরের প্রতি অবজ্ঞা ও অবহেলার মতো আচরণ করা ইত্যাদি তিক্ত অভিজ্ঞতা রয়েছে। হিংসা, দাঙ্গা, নির্যাতন ইত্যাদি ঘটনার জন্য একে অপরকে দোষারোপ করার ঘটনাও ঘটে। কিছু লোকের অপকর্মকে সমগ্র সমাজের কার্যকলাপ ধরে নিয়ে উত্তেজক বক্তৃতা এবং আলাপ আলোচনা শোনা যায়। চ্যালেঞ্জ এবং পাল্টা চ্যালেঞ্জ দেওয়া হয়, যা উস্কানি হিসাবে কাজ করে।

আমাদের নিজেদের মধ্য গৃহযুদ্ধ বাধিয়ে যে শক্তিগুলো দেশ ভাঙতে চায়, তারাও এর সুযোগ নেয়। দেখতে দেখতে একটি ছোট ঘটনাকে বড় করে দেখিয়ে ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। দেশ ও বিদেশ থেকে উদ্বেগ প্রকাশকারী বিবৃতি ও সাবধান বানী দেওয়া হয়। সহিংসতাকে উস্কে দেওয়া “টুল কিটস্” সক্রিয় হয়ে যায় এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ঘৃণা আরও বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

যারা সমাজে সম্প্রীতি চায় তাদের সবাইকে এই মারণ খেলার ছলনা থেকে বাঁচতে হবে৷ এই সব সমস্যার সমাধান ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসবে। সে জন্য দেশে আস্থা ও সম্প্রীতির পরিবেশ সৃষ্টি পূর্বশর্ত। নিজের মনকে স্থির রেখে আত্মবিশ্বাসী হয়ে পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়াতে হবে, পারস্পরিক বোঝাপড়া বাড়তে হবে, পারস্পরিক বিশ্বাসের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হতে হবে এবং সবার মধ্যে সম্প্রীতি বৃদ্ধি পেতে হবে, এভাবেই মন, বচন ও কাজে চলতে হবে। প্রচার বা অনুমান নিয়ে নয়, বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনা করে কাজ করতে হবে। ধৈর্য, সংযম ও সহিষ্ণুতার সাথে, নিজের কথা ও কাজে উগ্রতা, ক্রোধ ও ভয় পরিহার করে, দৃঢ়তার সাথে, সংকল্পবদ্ধ হয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া অপরিহার্য। বিশুদ্ধ চিত্তে করা সত্ সংকল্প তখনই পূৰ্ণ হয়।

প্রতিটি পরিস্থিতিতে যতই উসকানি থাকুক না কেন, আইন-শৃঙ্খলা, নাগরিক শৃঙ্খলা ও সংবিধান মেনে চলা বাধ্যতামূলক। একটি স্বাধীন দেশে এই আচরণকে দেশপ্রেমের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। মিডিয়াকে ব্যবহার করে করা উসকানিমূলক অপপ্রচার এবং এর ফলে যে অভিযোগ ও পাল্টা অভিযোগের প্রতিযোগিতা হয় তাতে ফেঁসে যাবেন না। সমাজে সত্য ও অন্তরঙ্গতা ছড়িয়ে দিতে মিডিয়াকে ব্যবহার করতে হবে। হিংসা এবং গুন্ডামির সমাধান হল সংগঠিত শক্তিসম্পন্ন সমাজের আইন- শৃঙ্খলা সুব্যবস্থা রক্ষায় উদ্যোগ নেওয়ার সাথে সরকার ও প্রশাসনকে যথাযথ সহায়তা দেওয়া।

আগামী ২০২৪ সালের প্রথম দিকে লোকসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনী খেলায় আবেগ উস্কে দিয়ে ভোট সংগ্রহের চেষ্টা প্রত্যাশিত নয়, কিন্তু তা ঘটছেই। আসুন সমাজকে বিভক্ত করে এমন বিষয়গুলো পরিহার করি। ভোট দেওয়া প্রতিটি নাগরিকের কর্তব্য। তা পালন করতে হবে। দেশের ঐক্য, অখণ্ডতা, স্বাভিমান ও উন্নয়নের বিষয় বিবেচনা করে ভোট দিন।

২০২৫ থেকে ২০২৬ সাল হল সংঘের শতবর্ষ পূর্তির বছর। পূর্বোক্তা সমস্ত বিষয়ে ও দেশের প্রয়োজনে সংঘের স্বয়ংসেবকরা এগিয়ে যাবে, ছেঁবিষয়ে তারা প্রস্তুতি নিয়ে চলেছে। সমাজিক আচার- আচরণ ও কথা বার্তায় দেশের প্রতি সমগ্র সমাজের আনুগত্যের অনুভূতি প্রকাশ পাক। মন্দির, জলাশয়, শ্মশানে প্রবেশে কোনো বৈষম্য থাকলে তার অবসান ঘটাতে হবে। পরিবারের সকল সদস্যের মধ্যে প্রতিদিন আলাপ আলোচনা, সংস্কারিত আচরণ এবং সংবেদনশীলতা অব্যাহত রাখা এবং সেসব গুনের বিকাশ অব্যাহত রাখা উচিত। এরকম আদর্শ পরিবারের দ্বারা সমাজের সেবা অব্যাহত রাখা উচিত। নিজের বাড়ির জল সংরক্ষণ করে, প্লাস্টিক অপসারণ করে এবং আপনার আঙ্গিনার চারপাশে সবুজায়ন বৃদ্ধি করে প্রকৃতির সাথে সম্পর্ক বজায় রাখুন। স্বদেশী আচারের মাধ্যমে আত্মনির্ভরশীলতা ও আত্মনির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পাক।

অনর্থক ব্যয় বন্ধ করতে হবে। দেশের কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে এবং দেশের অর্থ দেশের মধ্যেই ব্যবহার করতে হবে। তাই স্বদেশীর আচার-আচরণও পরিবার থেকেই শুরু করা উচিত। আইন-শৃঙ্খলা ও নাগরিকত্বের নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং সমাজের সর্বত্র পারস্পরিক সম্প্রীতি ও সহযোগিতার পরিবেশ বিরাজ করতে হবে। এই পাঁচটি আচরণগত বিষয় বিকশিত হোক তা সবাই চায়। কিন্তু ছোটখাটো বিষয় থেকে শুরু করে সেগুলোর চর্চা করে, আমাদের প্রকৃতিতে এই আচরণ গ্রহণ করার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা প্রয়োজন। আগামী দিনে, সংঘের স্বয়ংসেবকরা সমাজের অভাবী বন্ধুদের সেবা করার পাশাপাশি, এই পাঁচ ধরণের সামাজিক উদ্যোগ চালিয়ে সমাজকে এতে অংশীদার এবং সহযোগী করার চেষ্টা করবে। সরকার, প্রশাসন এবং সমাজের সম্মানশক্তি সমাজের স্বার্থে যা কিছু করছে বা করতে চাইছে, সংঘের স্বয়ংসেবকদের সেই কাজে সহযোগিতা নিয়ত পূর্ববত্ চলতে থাকবে।

সমাজের ঐক্য, সতর্কতা ও সর্বক্ষেত্রে নিঃস্বার্থ প্রয়াস, জনকল্যাণকারী সরকার ও জনমুখী প্রশাসন যখন নিজের স্ব-এর ভিত্তির ওপর উত্থিত হয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা পূর্বক প্রচেষ্টা চালায়, তখনই রাষ্ট্র সমৃদ্ধ হয়। শক্তি ও গৌরবে পূর্ণ রাষ্ট্রের কাছে যখন আমাদের সনাতন সংস্কৃতির সবাইকে তার একই পরিবার অন্তর্ভূক্ত হিসাবে বিবেচনা করার মতো একটি সংস্কৃতি থাকে, যা অন্ধকার থেকে আলোতে, ও অসত্য থেকে সত্যের দিকে নিয়ে যায় এবং যা আমাদের নশ্বর জীবন থেকে সার্থকতার অমৃতময় জীবনের দিকে নিয়ে যায়, তখন সেই রাষ্ট্র, পৃথিবীর হারানো ভারসাম্য ফিরিয়ে আনে এবং বিশ্বকে একটি সুখী ও শান্তিপূর্ণ নতুন জীবনের বরদান প্রদান করে। বর্তমান সময়ে আমাদের অমর জাতির পুনরুজ্জীবনের/পুনরুত্থানের/নবজাগরণের উদ্দেশ্য এটাই।

“चक्रवर्तियों की संतान, लेकर जगद् गुरु का ज्ञान, बढ़े चले तो अरुण विहान करने को आए अभिषेक, प्रश्न बहुत से उत्तर एक”

“ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারীরা জগত গুরুর জ্ঞান সম্বল করে, এগিয়ে চললেই অরুণ প্রভাত আসবে, অভিষেকের সময় আসন্ন, প্রশ্ন অনেক হলেও উত্তর এক।”

“भारत माता की जय”

https://www.youtube.com/watch?v=4u4y-boEYAc

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.