চতুর্থ পর্ব
‘হলডোমোর’ — বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আসল রূপ
১৯৩৩ সালের জুন মাসে একজন মহিলা ডাক্তার তার বন্ধুকে চিঠিতে লিখছেন যে তিনি এখনো পর্যন্ত নরখাদক হননি কিন্তু এই চিঠি তার বন্ধুর কাছে পৌঁছানো পর্যন্ত তিনি নরখাদক হয়ে যাবেন কিনা সে বিষয়ে কোনো নিশ্চয়তা দেওয়া যাচ্ছে না।যারা ক্ষুধা নিবৃত্তির জন্য চুরি করতে চাননি তারা ইতিমধ্যেই মারা গিয়েছেন, অন্যদেরকে খাদ্য দিয়ে বাঁচাতে গিয়ে অনেকে অনাহারে মরেছে। যারা মৃত মানব শরীর কে খাদ্য হিসেবে বেছে নেয় নি তারা নিজেরাই মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিয়েছে।
এ হচ্ছে ১৯৩৩ এর সোভিয়েত রাশিয়ার ইউক্রেনের চিত্র — যা কিনা বিশ্বের প্রথম সাম্যবাদী রাষ্ট্র !
১৯৩৩ সালে ইউক্রেনে অনাথ শিশুদের সংখ্যা হঠাৎ করে বেড়ে গিয়েছিল।সে সময় ইউক্রেনে যাওয়া নিষিদ্ধ হলেও সাংবাদিক গ্যারেথ জোন্স ১৯৩৩ এর ৭ই মার্চ খারকিভের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন আর মাঝ পথেই একটি গ্রামে নেমে গিয়ে ইউক্রেনের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ স্বচক্ষে দেখেছিলেন। ক্ষুধার্ত শিশুদের সাথে নিজের খাবার ভাগ করার সময় তাদের আর্তনাদ শুনেছিলেন। গ্যারেথ জোন্স ট্রেনে দেখতে পান একজন কৃষকের কাছ থেকে কিভাবে পুলিশ চুরি করা রুটি বাজেয়াপ্ত করেছিল। সে সময়ের ‘স্ট্যালিনো’ স্টেশনে একজন কৃষকের ট্রেন থেকে লাফ দিয়ে আত্মহত্যা করার ঘটনা জোন্সের স্মৃতিচারণ থেকে জানা যায়। ‘স্ট্যালিনো’ শহর যাকে আমরা বর্তমানে ‘ডোনেস্ক’ (Donetsk) নামে জানি একসময়ের শিল্পসমৃদ্ধ শহর ছিল।১৯৩৩ এর ইউক্রেন ছিল ক্ষুধার শহর। ইউক্রেনের কিভ, খারকিভ, ডনেস্ক হাজার হাজার মানুষ একটা মাত্র রুটি জন্য সারাদিন অপেক্ষা করতো। সাংবাদিক জোন্সের মতে রাত্রি দুটোর সময় খাওয়ার কেনার জন্য দোকানের সামনে লাইনে দাঁড়ানো মানুষের দোকানের কপাট খোলা দেখতেই সকাল ৭ টা হয়ে যেতো। লাইনে দাঁড়ানো ক্ষুধার্ত দুর্বল মানুষেরা সামনের জনের কোমরের সাথে নিজেকে বেঁধে রাখতেন যাতে তারা দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন। কোন কোন সময় এই অপেক্ষা একদিন বা দুদিনেরও হতো। খারকিভের ব্যারাকে প্রায় কুড়ি হাজার শিশু মৃত্যুর অপেক্ষায় রত। পুলিশের কাছে শিশুদের কাতর প্রার্থনা — মৃত্যু অবধারিত, কিন্তু তারা যেন ব্যারাকের বন্দীদশার থেকে বেরিয়ে খোলা হাওয়ায় মরতে পারে। সোভিয়েত লেখক ভ্যাসিলি গ্ৰসমানের লেখাতেও উঠে এসেছে সেই ক্ষুধার্ত শহরের কথা।
পৃথিবীর ইতিহাসে এই দুর্ভিক্ষ ‘হলডোমোর’ (Holdomor) নামে পরিচিত , ইউক্রেনের ভাষায় যার অর্থ ‘ক্ষুধার মাধ্যমে মৃত্যু’ বা ‘ক্ষুধার মাধ্যমে হত্যা’। ১৯৫৬ সালে ‘ডিস্ট্যালিনাইজেশন’ অর্থাৎ স্তালিনের পলিসি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষিত নীতির পরেও সোভিয়েত রাশিয়ায় ‘হলডোমোর’ নিয়ে কথা বলা নিষিদ্ধ ছিল আর ‘হলডোমোর’ কে অস্বীকার করা হতো। সরকারিভাবে সোভিয়েত রাশিয়ায় এই দূর্ভিক্ষের কথা প্রথম বলা হয় ১৯৮৭ সালের ডিসেম্বরে , বলেন ইউক্রেনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির ফাস্ট সেক্রেটারি ভ্লদিমির সচারবিটস্কি। ২০০৮ সালে ইউক্রেনে ‘National Museum of the Holdomor-Genocide’ উদ্বোধন করা হয় , কমিউনিস্ট রাষ্ট্র প্রসূত এই দুর্ভিক্ষে নিহত মানুষদের শ্রদ্ধার উদ্দেশ্যে।
আলেকজান্ডার উইনারবার্গার একজন অস্ট্রিয়ান কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার , যিনি সোভিয়েত রাশিয়ায় ১৯ বছর কাজ করেছিলেন। খারকিভে কাজ করার সময় ১৯৩২ থেকে ৩৩ এর মধ্যে তিনি হলডোমোর-এর যে ছবিগুলো তুলেছিলেন সেগুলোই এখন বিশ্বের কাছে প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃত। কমিউনিস্ট জমানার সোভিয়েত রাশিয়ার শেষ রাষ্ট্রপতি মিখাইল গর্বাচভের নিজের দুই বোন আর কাকাও এই দুর্ভিক্ষে মারা যায় , এমনকি তার গ্ৰামের অর্ধেক মানুষ প্রাণ হারায়। ইউক্রেনের সংসদ ২০০৩ সালে ‘হলডোমোর’কে গণহত্যা হিসেবে ঘোষণা করে এবং ২০০৬ সালে ‘হলডোমোর’ কে অস্বীকার করাকেও অপরাধের শ্রেণীতে অন্তর্ভুক্ত করে।
১৯৩২-৩৩ সালে সমগ্ৰ সোভিয়েত রাশিয়াতেই খাদ্যের জন্য হাহাকার দেখা দেয় কিন্তু সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল ইউক্রেন।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে , যে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ এর দোহাই কমিউনিস্টরা দেন , যে কমিউনিস্টরা দাবি করেন তারা কৃষক-শ্রমিকদের সবথেকে বড় দরদী আর সোভিয়েত রাশিয়াকে বিশ্বের প্রথম কমিউনিস্ট রাষ্ট্র হিসেবে মহিমান্বিত করেন , সেই সোভিয়েত রাশিয়ায় লক্ষ লক্ষ কৃষকদের অনাহারে মরতে হলো কেন ? যে স্তালিন কে সামনে রেখে তারা ভারতবর্ষের সংসদীয় গণতন্ত্রে অংশ নেন , সেই গণহত্যাকারী ‘স্তালিন’ কি একটি গণতান্ত্রিক দেশের যে কোন দলের কাছে ‘আদর্শ’ হতে পারেন ? এই প্রশ্ন এই কারণেই উঠছে তার কারণ ইউক্রেনের লক্ষ লক্ষ কৃষকের, সাধারণ মানুষের এই মৃত্যুর কারণ ছিল স্তালিনের নীতি আর সোভিয়েত রাশিয়াকে মার্ক্সবাদে প্রদর্শিত এক সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার পাগলামি।

একটি মতাদর্শ আর তার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা নীতি কিভাবে সাধারণ মানুষের জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে তার উদাহরণ ১৯২৮ থেকে ১৯৩২ এর মধ্যে করা স্তালিনের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা।
এই পরিকল্পনার উদ্দেশ্য সোভিয়েত রাশিয়াকে এক শিল্পভিত্তিক সমাজে পরিণত করা। কারণ কি ?
কারণ মার্ক্স বলে গিয়েছেন , একটি শিল্পভিত্তিক সমাজেই সাম্যবাদের বীজ লুকিয়ে আছে। যত বেশি শিল্প হবে তত বেশি শ্রমিক আর তাদের মধ্যে বঞ্চিত শ্রেণী হিসেবে একতার সৃষ্টি হবে। মালিক শ্রেণীর বঞ্চনা তাদের ভেতরে বিপ্লবের বীজ পুঁতে দিবে আর তার থেকেই জন্ম নিবে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। এই বিপ্লব ঘটাতে হলে দরকার শিল্পায়ন — যে কোনো মূল্যে। আর শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ আসবে, যৌথ কৃষি ব্যবস্থার মাধ্যমে। মার্ক্সবাদের মতে , শ্রমিকদের বিপ্লবই সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করবে কিন্তু তাতে কৃষকদের অবদান কি হবে স্তালিন ঠিক করলেন। সোভিয়েত রাশিয়া মূলত কৃষিভিত্তিক একটি রাষ্ট্র আর তাকে শিল্পভিত্তিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে কৃষকদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে । ইউক্রেনের কৃষকরা এই ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে’র অংশ হতে অস্বীকার করেছিল। তাই স্তালিনের সিদ্ধান্ত, এই শ্রেণী শত্রু কৃষক তথা কুলাকদের নিকেশ করাই সমাজতন্ত্রের দাবি। ইতিহাসকে শ্রেণী সংগ্রাম হিসেবে ব্যাখ্যা করা মার্ক্সবাদে দীক্ষিত স্তালিনের এই সিদ্ধান্ত নিতে তাই বেশি ভাবতে হয় নি — পিছনে মহান মার্ক্সের অকাট্য যুক্তি আছে যে !
১৯৩০ এর মার্চের মধ্যে সমগ্ৰ সোভিয়েতের ৭১ শতাংশ জমি যৌথ খামারের আওতায় চলে এসেছিল ; কোন কৃষকের নিজের জমি নিজের জন্য ব্যবহারের অধিকার ছিল না। যৌথ খামারের সদস্য হিসেবে তারা খাদ্য , বেতন , চাকরির জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল ছিল।
যৌথ খামার ব্যবস্থায় কমিউনিস্ট সরকারের ঠিক করা নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্যশস্য সরকার কে দিতে বাধ্য থাকতো কৃষকেরা। প্রত্যেক বছর খাদ্যশস্য সংগ্ৰহ কে সরকার যেন নিজের শক্তি পরীক্ষণে নামতো। যত উর্বর অঞ্চল , তত বেশি দাবি।১৯৩০ সালে ইউক্রেনের কৃষিজ উৎপাদনের ৩০% সরকারি খাতে দিতে হয় । উৎপাদিত খাদ্যশস্যের কিছু অংশ গবাদি পশুর জন্য , কিছুটা পরের বছর বীজ বপনের জন্য আর কিছুটা নিজেদের জীবন ধারণের জন্য রেখে দিতে হত কৃষকদের। কিন্তু স্তালিনের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে বাড়তে থাকে খাদ্যশস্য আদায়ের পরিমাণ। ১৯৩২ সালে গতবছরের তুলনায় সরকার সংগ্ৰহের লক্ষ্যমাত্রা ৩২ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়। কৃষকদের একটা সমাজতন্ত্রের বিরোধী শ্রেণী হিসেবে দেখার জন্য তাদের আরো বেশি করে নিষ্পেষিত করছিল কমিউনিস্ট রাশিয়া। জোরপূর্বক যৌথ খামার ব্যবস্থা চালু করে একদিকে সমাজতন্ত্রে শত্রুদের যেমন জব্দ করা যাচ্ছিল আবার তাদের দ্বারা উৎপাদিত খাদ্যশস্যের বলে বলীয়ান হচ্ছিল সোভিয়েত রাশিয়া। কিন্তু যৌথ খামারগুলিতে উৎপাদনের অবস্থা বিবেচনা না করে যথেচ্ছভাবে জোরপূর্বক খাদ্যশস্য সংগ্ৰহের প্রক্রিয়া কৃষকদের মধ্যে আত্মরক্ষার বোধ তৈরি করে। পরের বছরের বীজ বপনের অংশটুক রক্ষা করা ও নিজেদের জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য বাঁচানোর চেষ্টায় গ্ৰেফতার হতে হয় কৃষকদের। আর বন্দী হলেই যেতে হবে সাইবেরিয়ার হীমশিতল গুলাগ ক্যাম্পে। কৃষকদের কাছে তখন মৃত্যুর দুইরকম পথ খোলা ছিল — হয় খাদ্যশস্য বাঁচানোর চেষ্টায় গুলাগ ক্যাম্পে গিয়ে বন্দীদশায় হাড়ভাঙা খাটুনির জন্য মৃত্যু নয়তো বাড়ির কাছে থেকে অনাহারে মৃত্যু। খারাপ আবহাওয়া, প্রয়োজনের তুলনায় ট্র্যাক্টরের অনেক কম যোগান আর অভিজ্ঞ কৃষকদের গুলাগ ক্যাম্পে নির্বাসনের ফলে ১৯৩১ সালেই যৌথ খামার ব্যবস্থার ব্যর্থতা চোখে পড়ে। সরকারি অত্যাচারের ফলে পরের বছরের জন্য সংরক্ষিত বীজটুকুও হাতছাড়া করতে হয়।১৯৩১ এর শেষের দিক থেকেই কৃষকরা অর্ধাহারে – অনাহারে থাকতে শুরু করে কিন্তু স্তালিনের ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে’র ক্ষুধা আরো বেশি !
১৯৩২ এর শুরুতেই ইউক্রেনের কমিউনিস্ট পার্টির উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে সাহায্যের আর্জি জানানো হয়। ১৯৩২ এর জুনে খারকিভের সমস্ত অঞ্চলেই অনাহারে থাকার রিপোর্ট আঞ্চলিক কমিউনিস্ট পার্টি তে জানানো হয়। আঞ্চলিক পার্টির কোনো ব্যক্তি বা যৌথ খামারের (kolkhoz) কোনো আধিকারিক এই অভুক্ত কৃষকদের প্রতি সদয় হলে তাকেও প্রতিবিপ্লবী, অন্তর্ঘাতে যুক্ত অভিযোগ দিয়ে নির্বাসিত করা হতো। ২২ শে অক্টোবর পলিটব্যুরো উত্তর ককেশাস ও ইউক্রেনের জন্য মলোটভ ও কাগানোভিচের নেতৃত্বে একটি কমিশন পাঠায় যাতে খাদ্যশস্য সংগ্ৰহের পরিমাণ বাড়ানো যায়। তারা উত্তর ককেশাস অঞ্চলের পার্টির জেলা সম্পাদকের মিটিং-এর রেসুলিউশনে বলে —- Following the particularly shameful failure of the grain collection plan, all local Party organizations are to be obliged to break up the sabotage networks of kulaks and counterrevolutionaries, and to crush the resistance of the rural Communists and kolkhoz presidents who have taken the lead in this sabotage.। এমনকি যৌথ খামারের ম্যানেজারদের কম উৎপাদনের জন্য দায়ী করে গুলাগ ক্যাম্পে নির্বাসিত করা হয়। যে অঞ্চলগুলোতে উৎপাদনের পরিমাণ ভালো সেখানেও সরকারি খাতে শস্য জমা দেওয়ার জন্য দুর্ভিক্ষের সম্ভাবনা জানা থাকলেও মলোটভ কৃষকদের জীবন বিপন্ন করেও স্তালিনের কল্পিত ‘সমাজতন্ত্র’কেই এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। স্তালিনবাদী হিসেবে পরিচিত ইউক্রেনের কমিউনিস্ট পার্টির ফার্স্ট সেক্রেটারি কসিয়র(Kossior) মলোটভকে সরকারি সংগ্ৰহের পরিকল্পনা পুনর্মূল্যায়নের পরামর্শ দেয়। কিন্তু ‘সর্বহারার সরকার’ অভুক্ত কৃষকদের দুরাবস্থাতেও বিচলিত না হয়ে কৃষকদের প্রাণহারা করতেই বদ্ধপরিকর থাকে।
কৃষকরা গ্ৰাম ছেড়ে শহরে পালাতে শুরু করে।২৭ শে ডিসেম্বর গ্ৰাম থেকে শহরে কৃষকদের পলায়ন রোধ করতে নাগরিকদের জন্য পরিচয়পত্র জারি করা হয় আর বাধ্যতামূলক পঞ্জীকরণের নিয়ম চালু হয়। দুর্ভিক্ষ কবলিত অঞ্চলগুলো থেকে রেলের সমস্ত টিকিট বাতিল করা শুরু হয়।প্রায় ২ লক্ষ কৃষকদের যাত্রাপথে আটকে তার নিজের অঞ্চলে ফেরত পাঠানো হয়। কিছু কৃষক পরিবার নিজের সন্তানদের এই আশাতে শহরে ছেড়ে আসে যে কোনো সহৃদয় ব্যক্তি তাদের সন্তানদের জীবনরক্ষা করবে কারণ গ্ৰামে ফেরত গেলে শিশুদের অনাহারে মৃত্যু নিশ্চিত। শহর এইরকম মৃতপ্রায় শিশু, বৃদ্ধদের ভীড়ে ভরে যেতে থাকে।
১৯৩৩ সালে যখন লক্ষ লক্ষ কৃষক অনাহারে মৃত্যুর অপেক্ষায় আছে, তখনও শিল্পায়নের প্রয়োজনে প্রায় ১০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য রপ্তানি করে। একদিকে খাদ্যশস্য সংগ্ৰহের জন্য অত্যাচার বাড়াতে থাকে সোভিয়েত সরকার আর অন্যদিকে খাদ্যের অভাবে মৃত্যু , মৃতদেহ ভক্ষণ, এমনকি মানুষ কে নরখাদকে পরিণত করে স্তালিনের ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে’র ক্ষুধা। যে ইউক্রেন কে ‘ইউরোপের রুটির ঝুড়ি’ বলা হয়, সেই ইউক্রেনের উর্বর জমির চাষীদের অনাহারে মরতে বাধ্য করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নায়করা ! সাইবেরিয়ার জনমানবহীন অঞ্চলে কনকনে ঠান্ডায় কৃষকদের গণহারে নির্বাসিত করে শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমিকের চাহিদা পূরণ করতে থাকে ‘সর্বহারার সরকার’। যে তত্ত্ব মানুষ কে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক জীব হিসেবে দেখে, বিশ্বের ইতিহাস কে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখা করে আর সমাজ গঠন কে শ্রেণী সংগ্রামের ফল হিসেবে বিবেচনা করে সেখানে মানবাধিকারের মূল্য কোথায় ? সোভিয়েত রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পথে ছিল অসংখ্য শিশুর মৃতদেহ, শ্রমিকের কান্না, অভুক্ত কৃষকের হাহাকার।
স্তালিন এই কয়েক লক্ষ মৃত্যু কে এড়াতে পারতো যদি নিজের পলিসি থেকে বেরিয়ে আসতো বা বিদেশ থেকে সাহায্য নিতো বা সঞ্চিত ৩০ লক্ষ টন খাদ্যশস্যের ভান্ডার কে কাজে লাগাতো। মনে রাখতে হবে ইউক্রেনের এই দুর্ভিক্ষ খাদ্যের অভাবের জন্য হয় নি বরং খাদ্য কেড়ে নেওয়ার জন্য হয়েছে। ‘ক্ষুধা’ কে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে কৃষক শ্রেণী কে যে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যায় এই আবিষ্কার অবশ্যই ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে’র দান ! পোল্যান্ড – সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে হওয়া ‘অনাক্রমণ চুক্তি’র মর্যাদা রক্ষা করে পোল্যান্ড চুপ করে দেখতে থাকে স্তালিনের হত্যালীলা। ইতালি আর সোভিয়েত রাশিয়ার ‘অনাক্রমণ চুক্তি’ ইতালির মুখ বন্ধ করে রাখে আর ওদিকে জার্মানির উত্থানে ভীত ফ্রান্স সোভিয়েত রাশিয়া কে চটাতে চায় নি। এইভাবেই সমসাময়িক ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি এক গণহত্যাকারীর অপরাধ কে দেখেও না দেখার ভান করে।
কিন্তু তার থেকেও আশ্চর্যের বিষয় ‘হলডোমোর’ এর প্রায় শতবর্ষ পরেও স্তালিনের ছবি সামনে রেখে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কৃষক দরদীর হওয়ার নাটক করে কমিউনিস্ট পার্টি।
তথ্যসূত্র:
১) The Black Book of Communism – Harvard University Press
২) Bloodlands — Timothy Snyder
৩) More than a grain – Siriol Colley
৪) The Harvest of Sorrow — Robert Conquest
পিন্টু সান্যাল

