“একদা শাক্যরাজপুত্র গভীর রাতে মানুষের দুঃখ দূর করবার সাধনায় রাজপ্রাসাদ ত্যাগ করে বেরিয়েছিলেন… সে তপস্যা সকল মানুষের দুঃখ-মোচনের সংকল্প নিয়ে। এই তপস্যার মধ্যে কি অধিকারভেদ ছিল? কেউ ছিল কি ম্লেচ্ছ? কেউ ছিল কি অনার্য? তিনি তাঁর সব-কিছু ত্যাগ করেছিলেন দীনতম মূর্খতম মানুষের জন্যে। তাঁর সেই তপস্যার মধ্যে ছিল নির্বিচারে সকল দেশের সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা।” ১৩৪২ বঙ্গাব্দের ৪ ঠা জৈষ্ঠ্য, বৈশাখী পূর্ণিমার দিন রবীন্দ্রনাথ ‘বুদ্ধদেব’ বিষয়ক প্রবন্ধে তাঁকে ‘অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব’ রূপে চিহ্নিত করেছেন, যাঁর মন্দির দর্শনে বুদ্ধগয়ায় গিয়েছিলেন তিনি। সেই পবিত্র তীর্থে পৌঁছে মনে হয়েছিল, “যাঁর চরণস্পর্শে বসুন্ধরা একদিন পবিত্র হয়েছিল, তিনি যেদিন সশরীরে এই গয়াতে ভ্রমণ করেছিলেন, সেদিন কেন আমি জন্মাই নি, সমস্ত শরীর মন দিয়ে প্রত্যক্ষ তাঁর পুণ্যপ্রভাব অনুভব করি নি?”

বুদ্ধদেব তাঁর জন্মমুহূর্তে মহাযুগে আপন স্থান করে নিয়েছিলেন। প্রাবন্ধিক বলছেন, “সেদিন যদি তিনি প্রতাপশালী রাজরূপে, বিজয়ী বীররূপেই প্রকাশ পেতেন, তা হলে তিনি সেই বর্তমান কালকে অভিভূত করে সহজে সম্মান লাভ করতে পারতেন; কিন্তু সেই প্রচুর সম্মান আপন ক্ষুদ্র কালসীমার মধ্যেই বিলুপ্ত হত। প্রজা বড়ো করে জানত রাজাকে, নির্ধন জানত ধনীকে, দুর্বল জানত প্রবলকে”, কিন্তু মানুষ জানতে পারতেন না সেই মহামানবকে যিনি মনুষ্যত্বের পূর্ণতাকে সাধনা করেছেন। রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে, তিনি ক্ষুদ্র স্বার্থ ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন বলেই আজ মহাযোগের বেদীতে, মানবমনের মহাসিংহাসনে অধিষ্ঠিত। মনে হয়েছে মনুষ্যত্বের বিশ্ব-ব্যাপী এই অপমানের যুগে আজ বলবার দিন এসেছে, “বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি।”

ভগবান বুদ্ধের শরণ আমরা কেন নেবো? নেবো একারণেই, তাঁর মধ্যে বিশ্বমানবের এক শাশ্বত সত্যরূপ প্রকাশিত হয়েছে। যিনি বলতে পারেন, অক্রোধের দ্বারা ক্রোধকে জয় করতে হবে, “অক্কোধেন জিনে কোধং”। যিনি সদর্থক মুক্তির কথা বলতে পারেন, যে মুক্তি কর্মত্যাগে নয়, সাধুকর্মের মধ্যে আত্মত্যাগের মধ্যে, যে মুক্তি সর্বজীবের প্রতি অপরিমেয় মৈত্রীসাধনায়। রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিভঙ্গী হচ্ছে, বাহুবল মানুষের চরম বল নয়; এই বলে বলীয়ান হয়ে যে জয় আসে তা একান্তই নিষ্ফল, কারণ এক যুদ্ধের জয় দ্বিতীয় যুদ্ধের বীজ বপন করে দেয়। বুদ্ধদেবের অহিংসার বাণীকে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বিশ্ববাসীকে বললেন, “বাহুবলের সাহায্যে ক্রোধকে প্রতিহিংসাকে জয়ী করার দ্বারা শান্তি মেলে না, ক্ষমাই আনে শান্তি, এ কথা মানুষ রাষ্ট্রনীতিতে সমাজনীতিতে যতদিন স্বীকার করতে না পারবে ততদিন অপরাধীর অপরাধ বেড়ে চলবে; রাষ্ট্রগত বিরোধের আগুন কিছুতে নিভবে না; জেলখানার দানবিক নিষ্ঠুরতায় এবং সৈন্যনিবাসের সশস্ত্র ভ্রূকুটিবিক্ষেপে পৃথিবীর মর্মান্তিক পীড়া উত্তরোত্তর দুঃসহ হতে থাকবে — কোথাও এর শেষ পাওয়া যাবে না।”

রবীন্দ্রনাথের বক্তব্যে মনে হয় না, কেবলমাত্র ভারতবর্ষের জন্য এই নিদান তিনি দিয়ে গেছেন; কারণ ভারতবর্ষ তো এই আদর্শই চিরকাল অনুসরণ করে এসেছে, আজও অনুসরণ করছে! কিন্তু যে বৃহৎ রাষ্ট্র, যে বৃহৎ ধর্ম সম্প্রদায়গুলি হিংসা, পাশবতা এবং সমর-কুশলতার সাহায্যে সিদ্ধিলাভের ভয়ঙ্কর দুরাশা করে এসেছে এতকাল, এই বাণী তাদের জন্যও তিনি রেখেছেন। আজ সেই মহামানবকে ডাকার দিনে বিশ্ববাসীও যেন ভারতবর্ষের এই অমৃতের সন্তানকে প্রকাশের দ্বারা আপন মনুষ্যত্বকে প্রকাশ করে। ভারতবর্ষের মধ্যে লুকিয়ে থাকা এবং ভারতবর্ষের বাইরে আস্ফালন করা যাবতীয় ক্রোধী, হিংস্র, পশুবৎ মানুষের ভীড়ে মানবতার পরত লাগানোর মতো জনগোষ্ঠীর উদয় যত দ্রুত আসবে, পৃথিবী ততই মঙ্গলের পথে এগিয়ে যাবে। বিশ্ববাসীর এই বোধিলাভ কবে হবে?

চিত্র-ঋণ: হিন্দু শিল্প-সুষমা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে পরিবেশিত শীর্ষ আচার্যের ষষ্ঠ শ্রেণীতে পাঠকালীন আঁকা ছবি (১) এবং দিল্লী নিবাসী ড. গোপী ঘোষের আঁকা ছবি (২)।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.