শ্রীময়ী উদ্ভিদ – হাউস প্ল্যান্ট

‘হাউস প্ল্যান্ট’ মানে এমন গাছ, যা ঘরের ভেতরে ছড়িয়ে থাকা সামান্য-স্বল্প বিক্ষিপ্ত আলোয় পালন করা যায়। পালন করা যায় গৃহ, আবাস, দেবালয়, বিপণী, অফিস-আদালতের সৌন্দর্য ও সৌকর্য বাড়াতে। এক চিলতে পরিসরে সম্ভব হয় শ্যামল শোভা। অনন্তের অসাধারণ উপস্থিতি নিয়ে এক একটি গাছ যেন আপন-গেহে মনোজ্ঞ মনোভূমি রচনা করে দেয়। যেন ইঁট-কাঠ-পাথর, লৌহ-লোষ্ট্রের মাঝেও শ্রীময়ী উদ্ভিদের এক দারুণ মনস্তাত্ত্বিক পরিবেশ! সে পরিবেশ আমরা রচনা করে নিই প্রকৃতি থেকে কোনোমতেই বিচ্ছিন্ন হবো না বলে। হয়তো আমাদের মনোজগতে রয়ে গেছে প্রাণের আকুতি; হয়তো রয়ে গেছে উদ্বাস্তু-মনের গহন অরণ্য। সীমার মাঝে এমন অসীমকে প্রতিষ্ঠিত করতে তাই কে না চাই! আপনিও কি তাই চান? আপনিও কী বিশুদ্ধ বায়ুর ঘরোয়া যোগান পেতে একান্তই উদগ্রীব? আর নিজেই তৈরি করে নিতে চান আপনার পছন্দের গাছ? তবে এই কলামে নিয়মিত চোখ রাখুন। আমরা আলোচনা করবো ঘরোয়া গাছের নানান ঘরোয়া খুটিনাটি আলোচনা। আর উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের এক অসাধারণ সৌকর্য পেতে থাকবো প্রতিটি পর্বেই। চেনাতে পারবো বৈচিত্র্যের অনন্ত সম্ভার।

হাউস প্ল্যান্ট হিসাবে কী কী লাগাবেন?
যদিও গাছের একটি তালিকা পরিবেশিত হল প্রস্তুত আলোচনায়, কিন্তু বিভিন্ন পর্বে ছবি সহ পরিবেশিত হবে তার বহিরাকৃতি ও বৈশিষ্ট্য। হাউস প্ল্যান্ট হিসাবে আমাদের পছন্দের গাছ হতে পারে এইগুলি —

অ্যাকালাইফা ( Acalypha ), অ্যাগ্লোনিমা, ( Aglaonema ), অ্যালোকেসিয়া ( Alocasia ), অ্যালপিনিয়া ( Alpinia ) , অ্যানানাস ( Ananas ) বা ভেরিয়েগেটেড পাইনাপেল, অ্যান্থুরিয়াম ( Anthurium ), অরোকেরিয়া ( Araucaria ), অ্যাসপারাগাস ( Asparagus ), অ্যাসপিডিসট্রা ( Aspidistra ) বা কাস্ট আয়রন প্ল্যান্ট (Cast iron plant, ব্রোমিলিয়া ( Bromelia ), ক্যালাডিয়াম ( Caladium ), ক্যালাথিয়া ( Calathea ), ক্যালিসিয়া ( Callisia ) বা টার্টেল ভাইন, ক্লোরোফাইটাম ( Chlorophytum ), কোডীয়াম ( Codiaeum ) বা ক্রোটোন ( Croton ), কোলিয়াস ( Coleus ), কর্ডিলাইন ( Cordyline ) বা গুড লাক প্ল্যান্ট (Good luck plant), কস্টাস ( Costus ) বা স্পাইরাল জিঞ্জার, ক্রিপট্যানথাস ( Cryptanthus ), টেনানথী ( Ctenanthe humilis ), সাইপেরাস ( Cyperus ) বা আমব্রেলা পাম, ডাইফেনবেচিয়া ( Dieffenbachia ) বা মাদার-ইন-ল প্ল্যান্ট (Mother-in-law plant), ড্রাসিনা ( Dracaena ), ড্রিমিওপসিস ( Drimiopsis ), দুরন্ত ( Duranta ), এপিপ্রেমনাম ( Epipremnum ), ইরেনথেমাম ( Eranthemum ), ইউনিমাস ( Euonymus ) বা স্পিণ্ডিল প্ল্যান্ট (Spindle tree), এক্সোকেরিয়া ( Excoecaria ), ফাইকাস ( Ficus ), উইপিং ফিগ (Weeping fig), রাবার প্ল্যান্ট (Rubber plant), উইলো লিফ ফিগ (Willow leaf fig), ক্লাইম্বিং ফিগ (Climbing fig), ইণ্ডিয়ান লোরেল (Indian laurel), ট্রায়াংগেল ফিগ (Triangle fig), গ্র্যাফ্টোফাইলাম ( Graptophyllum ), হেডেরা ( Hedera ), হেলিকোনিয়া ( Heliconia ), হোয়া ( Hoya ), ইরিসিন (Iresine), ম্যানিহট ( Manihot ), ম্যারান্টা ( Maranta ), মন্সটেরা ( Monstera ), নিওরেগেলিয়া ( Neoregelia ), ওফিওপোগোন ( Ophiopogon ), প্যাণ্ডানাস ( Pandanus ), পিলিওনিয়া ( Pellionia ), পিপারোমিয়া ( Peperomia ), ফিলোডেনড্রন ( Philodendron ), পিলিয়া ( Pilea ), প্লিওমেল ( Pleomele ), পলিসিয়াস ( Polyscias ), পোথস ( Pothos ), রিহিও ( Rhoeo ), স্যান্সেজিয়া ( Sanchezia ), সেন্সেভিয়েরিয়া ( Sansevieria ), স্কেফ্লেরিয়া ( Schefflera ), স্কিনড্যাপসিস ( Scindapsus ), সেটক্র্যাসিয়া ( Setcreasea ), ট্রাডেসক্যানটিয়া ( Tradescantia ), ভ্যানিল্লা ( Vanilla ), উকা ( Yucca ) জেব্রিনা ( Zebrina )

অ্যাকালাইফা
আজকের আলোচনা অ্যাকালাফা। ইউফরবিয়েসী পরিবারের অন্তর্গত অ্যাকালাইফার নানান প্রজাতির হাউস প্ল্যান্ট বাংলায় বাগানবিলাসীদের কাছে খুবই জনপ্রিয়। এর মধ্যে অ্যাকালাইফা হিসপিডা-কে বলা হয় ফক্স-টেইল বা রেড ক্যাট-টেইল। অর্থাৎ শেয়াল-লেজা কিংবা লাল রঙের বিড়াল-লেজা গাছ। এর পুষ্পবিন্যাসটি সত্যিই প্রাণীর লেজের মতোই লাগে। গাছের সবুজ পাতাগুলির মধ্যে যখন অসংখ্য উজ্জ্বল লাল অথবা লালচে গোলাপি রঙে ঝুলে থাকা অজস্র ঘন ফুলের গুচ্ছ ভরে থাকে, মনে হয় সত্যিই গাছে গাছে বসে আছে অসংখ্য অদৃশ্য কোনো প্রাণী, কেবল তাদের লেজই প্রকাশ পাচ্ছে বিটপের আড়ালে। গ্রীষ্ম বা বর্ষাকালে এই লেজ-সদৃশ ফুল ফোটে অবিশ্রাম। ফুলগুলি ২০ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার লম্বা। এই হিসপিডা প্রজাতিটি একটি দেখবার মতোই গুল্ম, উচ্চতায় প্রায় দেড় মিটার। টবেও পালন করা যাবে এই গাছ।
রয়েছে আরেকটি প্রজাতি অ্যাকালাইফা উইলকেসিয়ানা-র নানান জাত — অ্যাকালাইফা উইলকেসিয়ানা ‘সিলোন’, অ্যাকালাইফা উইলকেসিয়ানা ‘তাহিতি’ এবং অ্যাকালাইফা উইলকেসিয়ানা ‘ট্রাইকালার’। উইলকেসিয়ানা ‘সিলোন’-কে ফায়ার ড্রাগন প্ল্যান্টও বলে। এর পাতাগুলির সৌন্দর্য দেখবার মতো। বেশ বড়সড় পাতা, গোটানো, রঙ তামাটে-মেরুন। পাতার কিনারা খাঁজকাটা এবং উজ্জ্বল গোলাপি। গাছের উচ্চতা ২ থেকে ৩ মিটার।

‘তাহিতি’-র পাতাগুলিও একইভাবে কুঞ্চিত। তবে তার রঙ সবুজ, বিভিন্নতর হলুদ এবং সাদা রঙের মিশ্রণে তৈরি। ‘গডসেফিয়ানা’ বলে যে জাতটি আছে, তার পাতার রঙটি আবার সবুজ, সঙ্গে ক্রীম-সাদার কিনারা৷ অ্যাকালাইফা উইলকেসিয়ানা ‘ট্রাইকালার’ জাতটির পাতা সবার মন কেড়ে নেয় তার রঙের বিবিধতার জন্য। গোলাপি, কমলা, সাদা এবং লালের নানান পটি দিয়ে যেন পাতাটি কেউ রঙ করে দিয়েছে।

এমন গাছ কি আপনার পরিচিত বন্ধু-স্বজন-পড়শির বাড়িতে আছে? তার চারা কি আপনি নিজেই তৈরি করে নিতে চান? পারবেন। কারণ গাছের সৌন্দর্য বজায় রাখার জন্য তার ডালপালা সুবিধামতো ছেঁটে দিতে হয়। আর এই ছাঁটা ডাল-পালাগুলি নষ্ট না করে চারা তৈরির জন্য ব্যবহার করা যায়। বর্ষাকালে খুব সহজেই ছেদ কলম বা কাটিং করে চারা তৈরি হবে। মাঝারি শক্ত ডালের টুকরো এক একটি ১৫-২০ সেন্টিমিটার পরিমাণ কেটে নিন। তার পাতাগুলি অধিকাংশ ছেঁটে নিয়ে নার্সারীর চারাতলায় বা ভেজা বালির মধ্যে অথবা বালি মেশানো মাটির মধ্যে অনায়াসে প্রোথিত করে দিন। ছেদ কলমের নীচের কাট-টি একটু তেছড়া-ভাবে করতে হবে। কাটিংগুলি একটু কাত করে বালিতে বা মাটিতে পরপর বসাতে হবে।

যদিও পূর্ণ আলোয় অ্যাকালাইফা পাতা রঙের বাহার ঝিকমিক করে, তবুও করিডোর/ঘর-বারান্দার ভেতরে তা টবসুদ্ধ রাখা চলে। কিছুদিন ঘরে, কিছুদিন বাইরে — এইরকম পর্যায়কালীন টব সরানো হলে, পাতার ঔজ্জ্বল্য কিন্তু কমে না। বাগানবিলাসীরা ঠিক এই কাজটিই সঠিক সময়ে করে থাকেন। ঘরের ভেতরে অনেকসময় দইয়ে পোকা বা মিলিবাগ ডগার কাণ্ডে আক্রমণ ঘটায়। তা মোকাবিলার ব্যবস্থা প্রয়োজন অনুযায়ী অন্তর্বাহী কীটনাশকে করতে পারলে, আর সেচ প্রয়োজনমতো দিতে পারলে, এই গাছের সৌন্দর্য আস্বাদন করা খুবই সহজ।

সব ধরনের মাটি ব্যবহার করেই এর লালন-পালন করা সম্ভব। এরজন্য ৩:১ অনুপাতে বাগানের মাটি ও জৈবসারের মিশ্রণ প্রয়োজন হবে। শ্রাবারী বা গুল্ম-বাগিচার জন্য মাটিতেও লাগানো যায় এই গাছ। কেউ কেউ এই গাছ পরপর লাগিয়ে জীবন্ত বেড়া তৈরি করে নেন। কখনও কোনো বিশেষ পরিসরে এই গাছের আচ্ছাদন বা ঘোমটা টেনে দিয়ে তার কদর্যতা বা প্রাইভেসি রক্ষা করা সম্ভব।

ড. কল্যাণ চক্রবর্তী এবং পীযূষ দেব।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.