হিমসাগর জাতের আম দক্ষিণবঙ্গের সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য, অর্থকরী আম। দক্ষিণবঙ্গের আম বাগিচার প্রায় ৩০ শতাংশ হিমসাগর দখল করে আছে। বোম্বাই জাতের আম চয়ন করবার পর বাগানী হিমসাগর চয়নের দিকে নজর দেন, আম বিলাসীরাও থাকেন প্রত্যাশায়। আমটির উৎস কোথায় সে বিষয়ে লোকায়তিক চিন্তনের অবতারণা এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য।
নদীয়া জেলার চাকদহ থানার ঘোষপাড়ায় একটি বড় পুষ্করিণী রয়েছে, নাম ‘হিমসাগর’। সেখানে দোল পূর্ণিমায় সতীমায়ের উৎসব ও মেলা বসে৷ দীর্ঘদিন ধরে এই মেলা হয়ে আসছে দোলযাত্রা উপলক্ষে। সতীমা হচ্ছেন ঘোষপাড়া নিবাসী কর্তাভজা সম্প্রদায়ের (একটি গৌণ ধর্ম সম্প্রদায়) একজন বিশিষ্ট পুরুষ শ্রীরামশরণ পালের সহধর্মিণী, জাতিতে সদগোপ। শ্রীআউলচাঁদ তাঁদের পরমারাধ্য গুরু। লোকবিশ্বাস এই, শ্রীআউলচাঁদ ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের পরবর্তী অবতরণ সন্ন্যাসী, যাঁর দেহরক্ষা হয় ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে। শ্রীআউলচাঁদ যে ২২ জন প্রখ্যাত শিষ্যকে নির্বাচন করেছিলেন, শ্রীরামশরণ পাল তাদের অন্যতম। তাঁরই সহধর্মিণী শ্রীসতীমা ভক্তদের কাছে পরমা প্রকৃতি যোগমায়ারূপে আরাধ্য। সতীমা ও রামশরণের আদিভিটার পিছনে ‘হিমসাগর’ নামে এই দিঘির জল ভক্তদের কাছে গঙ্গাজলের মতোই পূত, পবিত্র। এরই পাশে সেই সময় থেকেই ছিল একটি প্রাচীন আমবাগান। বাগিচার অভ্যন্তরে প্রতি বছর মেলা বসে (সিংহরায়, ২০১৪)। কিংবদন্তি এই, বাগানের একটি প্রাচীন গুটিআম (Seedling mango) গাছ থেকে নির্বাচিত হয়েছে ‘হিমসাগর’ জাতের অপূর্ব আম।
সোমপ্রকাশ পত্রিকার ২৯ সংখ্যায় (২৩ চৈত্র, ১২৭০) ‘ঘোষপাড়ার মেলা’ শীর্ষক প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে ঘোষপাড়া কলকাতার প্রায় ১৬ ক্রোশ উত্তরে, যেখানে সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদক দোলের চাঁচরের দিন (১০ চৈত্র) লোকারণ্য স্থানে উপস্থিত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি দেখেছেন গ্রামের দক্ষিণাংশে ‘হিমসাগর’ নামে একটি পবিত্র পুষ্করিণী আছে, যাত্রীদের সকলকেই ঐ জল স্পর্শ করতে হয়৷ তিনি আরও লেখেন, “১০০ বৎসর হইল জাতিতে সদগোপ আউলেচাঁদ নামে এক ব্যক্তি পূর্ব অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন।”
বাংলা সাহিত্যের একজন প্রখ্যাত কবি নবীনচন্দ্র সেনের (১৮৪৭-১৯০৯) ‘নদীয়ার স্মৃতি’-তে পাওয়া যায়, ঘোষপাড়ার ‘কর্তা’ রামশরণ পাল ও তাঁর সহধর্মিণী ‘সতী মাই’-এর সমাধি-বাড়ির সামনে রয়েছে একটি সুন্দর বিস্তৃত আম্রকানন। তারই পাশে তার চাইতে আধুনিক একটি লিচুবন। এই আম্রকাননে দোলপূর্ণিমার সময় তিন দিন ব্যাপী মিলন মেলা বসে৷ আম্রকাননের আর এক দিকে একটি পুষ্করিণী, যার নাম ‘হিমসাগর’। এটি কর্তাভজাদের গঙ্গা।
শতঞ্জীব রাহা (২০০৩) লিখেছেন ইদানীং ঘোষপাড়ায় সতীমায়ের মেলায় জনসমাগম বেড়ে যাওয়ায় ঘোষপাড়ায় রাত্রিবাস না করে ভক্তরা ফিরে যান নিজ নিজ আশ্রয়ে। কারণ আগে আমবাগান এলাকা বড়ো ছিল, বাগানে ছিল বড়ো বড়ো প্রচুর গাছ। রোদ-জল-ঝড়ে লোকে বাটির গাছতলায় আশ্রয় নিতে পারত। সেসব বড়ো বড়ো গাছ কাটা পড়েছে, উদ্বাস্তু আগমনে বসতি চারপাশে বেড়েছে, ফলে বাটির আশ্রয় হারিয়েছেন কর্তাভজা সম্প্রদায়ী মানুষেরা । ঘোষপাড়া সতীমা মন্দিরের পাশে হিমসাগর সরোবর৷ ভক্তদের কাছে অতি পবিত্র এর জল। ঘোষপাড়া বাটির গাছতলায় বসত করার জন্য খাজনা দেওয়া হয় গুরু পরিবারের গদিতে।
স্থানীয় মানুষের বিশ্বাস, বিংশ শতকের শেষ দশকে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেছে, ঘোষপাড়ার এই আমবাগানের একটি বিশেষ গাছের ফল ছিল খুবই সুস্বাদু ও উপাদেয়। সেই গাছটির ফল লৌকিক বিচারে আদৃত হয়ে নির্বাচিত হয়েছে এবং তাই পরবর্তীকালে ‘হিমসাগর’ জাত হিসাবে সন্নিহিত উত্তর ২৪ পরগণা, মুর্শিদাবাদ ও মালদায় ছড়িয়ে পড়েছে। লৌকিক হিসাব অনুযায়ী সেই পুরাতন হিমসাগর গাছটির অস্তিত্ব ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ভাগ থেকে উনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত। অষ্টাদশ ও উনবিংশ শতাব্দীতে আমের জোড়কলমের প্রচলন বাড়তে থাকায় বাংলার ‘আমের বৈকুন্ঠ’ মুর্শিদাবাদ ও মালদা জেলার কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ভক্তেরা যথাসময়ে কলম করে তা সেখানেও ছড়িয়ে দেয়।
কারো কারো মতে উত্তর ২৪-পরগণা, হুগলি, নদীয়া প্রভৃতি জেলার হিমসাগর জাতের আমটিই মুর্শিদাবাদে নাম হয়েছে ‘স্বাদওয়ালা’/’শাহদুল্লা’/’শাদৌলা’ এবং মালদহে গিয়ে হয়েছে ‘ক্ষীরসাপতি’ (রহমান, ২০০৭)। তবে অনেকে তা মানেন না, তারা আলাপচারিতায় জানিয়েছেন, ঘোষপাড়ার সুনির্দিষ্ট গাছটির কলমের চারাই ‘হিমসাগর’। স্বাদওয়ালা কিংবা ক্ষীরসাপাতি আম দু’টি হিমসাগরের সদৃশ আম যা সতীমায়ের মন্দিরের পাশের বাগানে পাওয়া গেছিল, কিংবা হতে পারে হিমসাগর আমের বীজের চারা থেকে তৈরি আমের দুটি সিলেকশন বা নির্বাচন।
হিমসাগর পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদা ও ২৪ পরগণার পছন্দের এবং জনপ্রিয় জাত (জানা ও ঘোষ, ১৯৯১)। পশ্চিমবঙ্গ থেকে এই জাতটি উদ্ভাবিত হলেও বিহার, ঝাড়খণ্ড, উত্তর প্রদেশ এবং ওড়িশাতে তা ভাল ফলন দেয় (সিং এবং সহ গবেষকবৃন্দ, ২০০৮)। ফলের আকার বোঁটার দিকে চওড়া। নিচের দিকে সামান্য সরু। গড় ওজন ২৫০-৩০০ গ্রাম। হলদে মেটে সবুজ রঙের হয়। গন্ধ ভালো, খুব মিষ্টি, ফলনও ভালো হয়। মরশুমের প্রথম দিকে পাকে (জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে)। তবে এক বছর অন্তর ফলন দেয়। শাঁস বেশ মজবুত গড়নের, শাঁসের রঙ হলদেটে কমলা। আমটি বেশ রসালো, মিষ্টি গন্ধযুক্ত। খোসা মসৃণ কিন্তু শক্তপোক্ত, খোসার পুরুত্ব মাঝারি, তা শাঁসের সঙ্গে লেগে থাকে না। শাঁসে আঁশের পরিমাণ খুব কম। আমের সংরক্ষণ কাল ভালো। পাকা আমের মোট দ্রবণীয় কঠিন (TSS) ১৮.৫-১৯.৫° ব্রিক্স, মোট শর্করা ১৩.৭০%, অম্লত্ব ০.২৩%, ফলের ওজন মোট ওজনের ৭১-৭২%, ভিটামিন C-এর মাত্রা প্রতি ১০০ গ্রাম শাঁসে ২৪.৮০ মিলিগ্রাম (ঘোষ, ২০১৪)
বিধানচন্দ্র কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফল গবেষণা প্রকল্পের (ICAR-AICRP on Fruits)-এর গবেষণায় জানা গেছে নদীয়ার ঘোষপাড়ার অদূরে গয়েশপুরের গবেষণা খামারে ২০০০-২০০২ সাল নাগাদ যে হিমসাগরের কলমের চারা রোপণ করা হয়েছিল, তাতে ১৩-১৫ বছরের গাছে হিমসাগর আমের নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়েছে —
১৫ বছর বয়সে গাছের উচ্চতা ৭.৮ মিটার, গাছের গোঁড়ার পরিধি ৯৬ সেন্টিমিটার। ফলের ওজন ২৪৯. ৯৪ গ্রাম। আঁঠির ওজন ১৬.৭৫ শতাংশ, খোসার ওজন ১৫.৮৮%, শাঁস ৬৭.৩৭ % খোসার ওজন। গাছ প্রতি আমের সংখ্যা ৩৩৪.৪৮ টি। জানা গেছে, গাছ প্রতি ফলন ৮৩. ৬০ কেজি, মোট দ্রবণীয় কঠিন (TSS) ১৯.৪২° ব্রিক্স, অম্লত্ব ০.৩০%, TSS:Acid অনুপাত ৬৪.৭৩, সংরক্ষণ কাল ৫.৬৬ দিন।
ঘোষপাড়া তথা কল্যাণীর সন্নিহিত এলাকা এবং হরিণঘাটার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অর্থকরী আমবাগানগুলির ফল নদীয়ার চাকদহ, রাণাঘাট এবং উত্তর ২৪ পরগণার গাদামারা, বারাসাত হাটে এবং কাঁচড়াপাড়া বাজারে বিক্রি হয়। বিক্রি হয় নদীয়ার নগরউখড়া হাটে এবং হরিণঘাটা বাজারে। চাকদহ হাটটি মূলত স্থানীয় ফলের জন্য বিখ্যাত, যেমন – আম, লিচু এবং অন্যান্য মৌসুমি ফল। গাদামারা ফলের হাটে স্থানীয় আম, লিচু, পেয়ারা, কলা, পাইকারি দামে বিক্রি হওয়া ছাড়াও, বাজারের চাহিদা অনুযায়ী চালানি ফল যেমন আপেল, কমলালেবু, আঙুর ইত্যাদি মৌসুমী ফলও এখানে পাইকারি রেটে বিক্রি হয়। অনেক ভেণ্ডার ভালো মানের আম স্থানীয়ভাবে সংগ্রহ করে এক লপ্তে সরাসরি কলকাতার মেছুয়া ফল পট্টিতে ম্যাটাডোর, ট্রাকে পৌঁছে দেয়। এর মধ্যে মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত উন্নত মানের হিমসাগর জাতের আমই প্রধান।
তথ্যসূত্র:
১. বিমলাকিঙ্কর জানা ও অরবিন্দ ঘোষ, ১৯৯১, আধুনিক পদ্ধতিতে ফল চাষ — দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃষ্ঠা ৭৯-৮০//
২. সমীরেন্দ্রনাথ সিংহরায়, ২০১৪, নদিয়ার পূজা, মেলা, পালপার্বণ — (নদীয়া চর্চা, সম্পাদনা মৃত্যুঞ্জয় মণ্ডল)৷ অমর ভারতী, কলকাতা, পৃষ্ঠা ২০৬- ২২৭ (২২০)//
৩. কার্তিকেয়চন্দ্র রায় ও নবীনচন্দ্র সেন (সম্পাদনা: কমল চৌধুরী) ২০১২, নদিয়ার ইতিহাস, দ্বিতীয় পর্ব — দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১২৭//
৪. রাধাগোবিন্দ মাইতি, ২০০৭, সফল চাষের চাবিকাঠি, ভারতী বুক স্টল, পৃষ্ঠা: ১৮৯-১৯০
৫. Singh, H.S., Nath, V., Singh, A., Mandal, S. 2008. Mango: Preventive practices and curative measures. Satish Serial Publishing House, Delhi, p. 31.
৬. Ghosh, S. N. 2014.Tropical and sub tropical fruit crops: Crop improvement and varietal wealth, Part – II, Jaya Publishing House, Delhi, p. 465.
৭. মহম্মদ গোলাম রহমান ২০০৭, পশ্চিমবঙ্গের ফলচাষ, অশোক পুস্তকালয়, কলকাতা, পৃষ্ঠা ১৫//
৮. Chakraborti, K., Shah, N. I., Patil, P. 2022 Juxtaposition of morpho-qualitative traits of mango varieties grown in Mohanpur, West Bengal and Paria, Gujarat. J. Crop and Weed, 18(3): 64-70.
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী






