ভূত চতুর্দশীচৌদ্দশাক গ্রহণ ও চৌদ্দবাতি প্রজ্জ্বলনের বারোয়ারী অনুষ্ঠান হালিশহরে

সুমন কুমার রায়ের প্রতিবেদন, নৈহাটি; ১৯ অক্টোবর, ২০২৫।। বাঙালি সংস্কৃতির ভুলে যাওয়া অধ্যায়গুলিকে একের পর এক প্রাসঙ্গিক এবং যুগোপযোগী করে তুলছে ‘দেশের মাটি কল্যাণ মন্দির’ নামক একটি জনপ্রিয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। শাস্ত্রীয় মর্যাদায় হিন্দু পাল-পার্বণগুলিকে সমবেতভাবে পালন করে সমাজে এক সংহতির বার্তা যেমন দিচ্ছে প্রতিনিয়ত, তেমনই আচার অনুষ্ঠানগুলির পশ্চাতে থাকা বিজ্ঞানভাবনাগুলিকেও তুলে আনছে যত্ন সহকারে৷

এদিন (১৯ অক্টোবর) ছিল ভূত চতুর্দশী। আর তাকে কেন্দ্র করেই আয়োজিত হল এক মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান। হালিশহরের গঙ্গাতীরে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দির প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় চৌদ্দশাকের ভেষজগুণের উপর এই আলোচনা এবং চৌদ্দ প্রদীপ প্রজ্বলনের সান্ধ্যকৃত্য। এই উদ্যোগকে অনুষ্ঠানের অন্যতম সহ-আয়োজক ‘স্বামী বিবেকানন্দ ফাউন্ডেশনে’র কার্যকর্তা শামিত লাহিড়ী বর্ণনা করেছেন, সনাতনী জীবনচর্যার প্রবাহে বিঘ্ন দূরীকরণ এবং সনাতনী হিন্দু পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে শাস্ত্রীয় আলোকমালা প্রজ্জ্বলন। মহতী এই উদ্যোগে মঞ্চ আলোকিত করেন মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গৌতম বর্মন, রাষ্ট্রীয় স্বয়ং-সেবক সঙ্ঘের উত্তর ২৪ পরগণা জেলার সেবা-প্রমুখ মদন বিশ্বাস, বিশিষ্ট সাংবাদিক তথা ‘দেশের মাটি মাতৃ মিলন মন্দির’-এর বিশিষ্ট প্রতিনিধি সুমনা মুখার্জি প্রমুখ। অনুষ্ঠানে সঞ্চালনা করেন দেশের মাটি কল্যাণ মন্দিরের সম্পাদক মিলন খামারিয়া। প্রদীপ প্রজ্বলনের সাঙ্গীতিক নেতৃত্ব দেন সংস্কার ভারতীর প্রতিনিধি দোলন চক্রবর্তী। তিনটি সংগঠনের মিলিত অনুষ্ঠান ছিল এদিনের আলোচনা সভা ও আলোকমালা।

এদিন মধ্যাহ্নে সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে সমবেতভাবে প্রসাদ গ্রহণ করে সদস্যরা শুরু করেন অনুষ্ঠান। ঐতিহ্য মেনে আয়োজকদের তরফ থেকে উপস্থিত দর্শক-শ্রোতামণ্ডলীকে চৌদ্দশাকান্নের প্যাকেটও পরিবেশন করা হয়। শাকান্ন গ্রহণ করেই সম্পন্ন হয় আলোচনা সভা তথা চৌদ্দশাকের গুণাগুণ বার্তার কার্যক্রম। কথিত আছে — ভূতচতুর্দশীর দিনে অর্থাৎ দীপান্বিতা অমাবস্যার পূর্বদিনে যিনি চৌদ্দশাক খান, যমের আলয় তাঁর কাছ থেকে অনেক দূরে চলে যায়। চৌদ্দটি শাকের নাম হচ্ছে (১) ওল ( Amarphophallus campanulatus ), (২) কেঁউ ( Costus speciosus ), (৩) বেতো ( Chenopodium album ), (৪) কালকাসুন্দে ( Cassia sophera ), (৫) সরিষা ( Brassica campestris ), (৬) নিম ( Azadirachta indica ), (৭) জয়ন্তী ( Sesbania sesban ), (৮) শালিঞ্চ (শাঞ্চে) ( Alternanthera sessilis ), (৯) গুড়ুচী (গুলঞ্চ) ( Tinospora cardifolia ), (১০) পটুক (পটোল পত্র) ( Trichosanthes dioica ), (১১) শেলূকা ( Cordia dichotoma ), (১২) হিলমোচিকা (হিঞ্চে) ( Enhydra fluctuans ), (১৩) ভণ্টাকী (ঘেঁটু বা ভাঁট) ( Clerodendrum infortunatum ), এবং (১৪) সুনিষণ্ণক (সুষুনী শাক) ( Marsilea quadrifolia )। এদিন রান্না করে সমবেত সকলকে চৌদ্দশাকান্ন সহ মোড়ক তুলে দেন রূপা চক্রবর্তী এবং শামিত লাহিড়ী।।

পুরাণের প্রসঙ্গ অবতারণা করে চৌদ্দশাক গ্রহণ ও ভূত চতুর্দশী পালনের বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন মহাত্মা গান্ধী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. গৌতম বর্মন। সাংবাদিক সুমনা মুখার্জির আলোচনায় উঠে আসে, এই ধরনের সনাতনী সংস্কৃতি চর্চার প্রয়োজন ঠিক কোনখানে। বাঙালি হিন্দুর ঐতিহ্যকে কীভাবে পরবর্তী প্রজন্মে সাংস্কৃতিক সৌকর্যে সঞ্চালিত করা যাবে। সমাজসেবী মদন বিশ্বাস বলেন, শাস্ত্রীয় ও লোকায়ত ঐতিহ্যানুযায়ী খাদ্যগ্রহণের উপকারিতা বিষয়ে। ক্ষতিকারক বিদেশী সংস্কৃতির ছোঁয়া এড়িয়ে দেশীয় ও সনাতনী সংস্কৃতির পরিমণ্ডলে রয়ে যাওয়া বিজ্ঞান-ভাবনার প্রতি পরবর্তী প্রজন্মকে আকৃষ্ট করতে হবে সাংস্কৃতিক উদ্যোগের যথাযথ প্রচেষ্টায়। লক্ষ্য রাখতে হবে আমাদের শিশু-কিশোর-তরণেরা কী করছে; কোথায় সামাজিক উদ্যোগ দরকার; কোথায় বার্তা ও কর্মসূচী জরুরি।

এদিনের অনুষ্ঠানের পশ্চাতে যে বার্তার প্রাবল্য ধ্বনিত হয়েছে, সেই বিষয়ে টেলিফোনে যোগাযোগ করা হলে, দেশের মাটি কল্যাণ মন্দিরের প্রধান পরামর্শদাতা ড. কল্যাণ চক্রবর্তী বলেন, ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় জীবনের পথে যে বিবিধ বিঘ্ন আমাদের সম্মুখে আপদের মতো উপস্থিত হয়, প্রতি পদে বাঁধা দিতে থাকে, অগ্রগতি রোধ করে, তা প্রাসঙ্গিক-পার্বণ ভূত-চতুর্দশীর ভূতের মতোই। ভূত নামক একটি বিঘ্নকে সামাজিক-রাজনৈতিক জীবনে দূর না করলে যাবতীয় স্বচ্ছ এবং সদর্থক সংস্কৃতি বিনষ্ট হবে। হিন্দু সংস্কৃতি গভীর সংকটের মধ্যে পড়বে। এই বিতাড়ণের কাজ যে একা সম্ভব নয়, তা সমবেতভাবেই করতে হবে, তাই বারোয়ারী উদ্যোগে চৌদ্দশাক খেয়ে চৌদ্দবাতি জ্বালানো হল। পূর্বপুরুষের উদ্দেশ্যে চৌদ্দবাতি দিতে হয়। এদিন সমবেতভাবে পরলোকগত সকল সনাতনী হিন্দুর আত্মার প্রতি আলো জ্বালিয়েছে দেশের মাটি। বার্তাটি এই, আমরা সনাতনী সংস্কৃতি রক্ষার জন্য সমবেত প্রয়াস করছি, হিন্দু সংস্কৃতিকে রক্ষা করছি। বিচ্ছিন্নভাবে নয়; একসঙ্গে শাকান্ন খেয়েছেন তারা, একসঙ্গেই চৌদ্দবাতি নিবেদন করেছেন পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে। সঙ্ঘশক্তিই সবচেয়ে বড় শক্তি। এদিনের অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী সঙ্গীত পরিবেশন করেন ছন্দা হালদার। আবৃত্তি করেন পিয়াসা বিশ্বাস, পুতুল দে এবং তুহিন চক্রবর্তী। সভা সমাপ্তি ঘটে তুহিন চক্রবর্তীর কণ্ঠে শান্তিমন্ত্র উচ্চারণের মাধ্যমে। অনুষ্ঠানের আয়োজক ছিল দেশের মাটি কল্যাণ মন্দির, দেশের মাটি মাতৃ মিলন মন্দির এবং বিবেকানন্দ ফাইন্ডেশন( মোক্ষ গুরুকুল)।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.