বাংলা সত্যিই সবথেকে আগে নিজের মেয়ের নিরাপত্তা চায়। এই কথাটা যে কতো গুরুত্বপূর্ণ তা আমাদের থেকে বেশী কেউ বোঝে না। আমি পূর্ববঙ্গ থেকে আসা উদ্বাস্তু পরিবারের ছেলে। আমার বেড়ে ওঠাও উদ্বাস্তু কলোনিতে। তাই আমরা বুঝি নিজের মেয়ের নিরাপত্তার বিষয়টি পেট্রোল ডিজেলের দামের থেকেও কত গভীর উদ্বেগের।
বাংলা মানে তো কেবল পশ্চিমবঙ্গ নয়। পশ্চিমবঙ্গ আর পূর্ববঙ্গ মানে আজকের বাংলাদেশ নিয়েই বাংলা। শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়রা না থাকলে পশ্চিমবঙ্গের জন্ম হত না। কলকাতা ভারতবর্ষে থাকতো না। সারা বাংলার হিন্দুদেরই আমাদের মতো উদ্বাস্তু হয়ে অন্য কোথাও যেতে হত।
পূর্ববাংলায় নারীদের সর্বনাশ শুরু হয়েছিল ১৯৪৬ সালে। মুসলিম লীগের সমর্থক ছিল কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া আর তথাকথিত দলিত নেতা যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল। ১৯৪৬ সালের ১৬ অগষ্ট লীগের ‘ডায়রেক্ট একশান ডে’ উপলক্ষে মনুমেন্টের নিচে সশস্ত্র মিটিং হয়েছিল। সেখান থেকে শুরু হল হিন্দু নিধন। নারী ধর্ষন, আর অবাধে হিন্দু সম্পত্তি লুঠ- “গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং”। সেই সাফল্যে অনুপ্রাণিত জেহাদির দল কোজাগরী পূর্নিমার দিনে নোয়াখালীতে দাঙ্গা শুরু করে। হাজারে হাজারে হিন্দু প্রান হারালেন, শত শত নারী গনধর্ষনের শিকার হলেন। সেই অত্যাচার সমানে চলছে। পূর্বপাকিস্তান আজ বাংলাদেশ হয়েছে, কিন্তু নারীধর্ষণ বন্ধ হয়নি।
এই নিরবিচ্ছিন্ন অত্যাচারের সবচেয়ে বেশী শিকার হয়েছেন নমশূদ্র, মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষেরা। যাঁরা পিছিয়ে পড়া তপশিলি জাতির মানুষ। যোগেন মন্ডল সাহেব পাকিস্তানের মন্ত্রী হয়ে ২বছরও টিকতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গের বাগনানে পালিয়ে এসেছিলেন।
২০০১ সালে যখন বাংলাদেশে ভয়াবহ দাঙ্গা হল, তখন ওদেশের দেওয়ালে দেওয়ালে লেখা হয়েছিল, “একটা একটা হিন্দু ধর/ সকাল সন্ধ্যা নাস্তা কর।” বাংলাতেই লেখা হয়েছিল আমাদের মৃত্যু পরোয়ানা। আমার বোনের ইজ্জত নিয়েছে বাংলায় কথা বলা জেহাদি জল্লাদেরা। তাই আমার আছে ‘বহিরাগত’ ভারতবর্ষের অন্য রাজ্যের গুজরাতি বা মারওয়ারি নয়, বাংলাদেশ থেকে অত্যাচার করে আবার এখানে সন্ত্রাস করতে আসা ‘শাকিল আহমেদ’ এর মতো অনুপ্রবেশকারী।
১৯৪৬ সালের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে ঠিক ৭৫ বছর পরে। এইবছর ৩ মার্চ ব্রিগেডে সমাবেশ হল। আবার সেই চরম মৌলবাদী জেহাদি শক্তির সঙ্গে হাতে হাতে ধরে বামপন্থীরা। আমরা উদ্বাস্তু পরিবারের ছেলে, ঘর পোড়া গরু তাই সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় হয়। আবার কি ফিরে আসছে ক্যালকাটা কিলিং, নোয়াখালী দাঙ্গা?
একটা কথা পরিষ্কার করে বলতে চাই। আমরা এখানে ২টাকা কেজি চাল খেতে আসি নি। ওপারে আমাদের খাওয়ার অভাব বিশেষ ছিল না। আমরা নিজেদের ধর্ম বাঁচাতে আর নিজের বাড়ির মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে এই পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলাম। কিন্তু আমাদের ঘরের মেয়েরা নিরাপত্তা পেল কোথায়?
গত দশ বছরে একের পর এক গনধর্ষিতা হয়ে খুন হয়েছে আমার ঘরে বোনেরা। কামদুনিতে আমার একুশ বছরের বোনটা কলেজে পড়ে মানুষ হতে চেয়েছিল। নদীয়ার হাঁসখালিতে ১৪ বছরের তপশিলি মেয়েটি ৫৫ বছরের মৌলবাদী লম্পটের কুপ্রস্তাবে সায় দেয় নি। পার্কস্ট্রিটের মেয়েটি মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত প্রতিবাদ করেছিল। জলপাইগুড়ির রাজবংশী মেয়েকে গতবছর লকডাউনের মধ্যে খুন করা হয়েছে। সব কিছু একটাই নিয়তিকে সূচিত করছে। পশ্চিমবঙ্গে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে ১৯৪৭ এর নোয়াখালী, ১৯৫০ সালের বরিশাল, ১৯৬৪ সালের ঢাকা। আর রাজনৈতিক শক্তি নিজেদের ক্ষুদ্রস্বার্থের বাইরে আর কিছুই ভাবছে না।
১৯৪১ সালে অখন্ড বাংলার জনসংখ্যার ৪১.৭ শতাংশ ছিল হিন্দু। তার মাত্র ৭০ বছর পরে ২০১১ সালের পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ২৩ কোটি ৩৬ লক্ষের মধ্যে মাত্র ৩২ শতাংশ হয়েছে হিন্দু। এই সংখাহ্রাসের প্রতিটি বিন্দুতে আছে ধর্ষিতা বাঙালি মেয়ের কান্না।
তাই আজ বাঙালি চিৎকার বলতে চায়, অন্য সবকিছুর থেকে বেশী গুরুত্বপূর্ণ কথা একটাই। “বাংলা নিজের মেয়ের নিরাপত্তা চায়!”

প্রকাশ চন্দ্র দাশ । সহ সভাপতি পশ্চিমবঙ্গের জন্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.