কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দীনেশচন্দ্র সেনের ‘রামায়ণী কথা’ গ্ৰন্থের ভূমিকায় লিখেছিলেন — “… বাল্মীকির রামচরিতকথাকে পাঠকগণ কেবলমাত্র কবির কাব্য বলিয়া দেখিবেন না, তাহাকে ভারতবর্ষের রামায়ণ বলিয়া জানিবেন। তাহা হইলে রামায়ণের দ্বারা ভারতবর্ষকে ও ভারতবর্ষের দ্বারা রামায়ণকে যথার্থভাবে বুঝিতে পারিবেন।….”
ভারত যখন ব্রিটিশের শাসনাধীন তখনও ভারত নিজেকে প্রকাশ করেছে রামায়ণের মাধ্যমে, এশিয়া মহাদেশ ছাড়াও সেইসময়ের বৈভবশালী ইউরোপের সাহিত্য আর সাহিত্যের মাধ্যমে রামায়ণ তথা ভারতের প্রভাব পৌঁছে গেছে।
১৮৬৭ সালে প্যারিস থেকে ইতালিয় সংস্কৃতজ্ঞ ডঃ গরেসিও দীর্ঘ ৩০ বছরের পরিশ্রমের পর ১২ টি খন্ডের সম্পূর্ণ সংস্কৃত রামায়ণ ও তার ইতালিয় অনুবাদ প্রকাশ করেন।তারও আগে শ্রীরামপুরের মিশনারী উইলিয়াম ক্যারে ১৮০৬ সালে জশুয়া মার্শমানের সহায়তায় রামায়ণের কয়েকটি খন্ডের অনুবাদ প্রকাশ করেন। পরাধীন অবস্থাতেও ভারতের জ্ঞানসূর্য রামায়ণের মাধ্যমে আলো ছড়িয়েছে। তাই রামায়ণ চিরন্তন আর তাঁর রচয়িতাও। ভারতীয় মহাকাব্য রামায়ণ-এর রচয়িতা মহর্ষি বাল্মীকির মুখ দিয়ে বিশ্বকবি ‘ভাষা ও ছন্দ’ কবিতায় ঘোষণা করিয়েছেন —
“মহাম্বুধি যেইমত ধ্বনিহীন স্তব্ধ ধরণীরে
বাঁধিয়াছে চতুর্দিকে অন্তহীন নৃত্যগীতে ঘিরে
তেমনি আমার ছন্দ ভাষারে ঘেরিয়া আলিঙ্গনে
গাবে যুগে যুগান্তরে সরল গম্ভীর কলস্বনে
দিক হতে দিগন্তরে মহামানবের স্তবগান,
ক্ষণস্থায়ী নরজন্মে মহৎ মর্যাদা করি দান।”
মহর্ষি বাল্মীকি “আদিকবি” , কারণ তাঁর রচিত রামায়ণই ভারতীয় সাহিত্যের প্রথম মহাকাব্য। বাল্মীকির নাম মূলত ছিল রত্নাকর। একসময় তিনি জীবিকা নির্বাহের জন্য ডাকাতি করতেন। পরবর্তীতে নারদ মুনির প্রভাবে তিনি তপস্যায় প্রবৃত্ত হন এবং দীর্ঘ সাধনার পর ঋষি রূপে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। তপস্যার সময় তাঁর শরীরে পিঁপড়েরা বাসা বেঁধেছিল, যাকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় বল্মীক— সেই থেকেই তাঁর নাম হয় বাল্মীকি।
ভারতে বিভিন্ন স্থানে “বাল্মীকি সমাজ” নামে এক বৃহৎ সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে, যারা মহর্ষি বাল্মীকিকে তাঁদের আদি গুরু ও আধ্যাত্মিক প্রেরণার উৎস বলে মানেন।পাঞ্জাব, হরিয়ানা, দিল্লি, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান প্রভৃতি রাজ্যে এই সমাজ প্রধানত বিস্তৃত। দক্ষিণ ভারতেও আংশিক উপস্থিতি রয়েছে।
মহর্ষি বাল্মীকি তাঁদের ধর্মগুরু হিসেবে পূজিত।
রামায়ণ পাঠ, ভজন, কীর্তন, ও আখণ্ড পাঠ তাঁদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ।
বিভিন্ন জায়গায় বাল্মীকি মন্দির প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
বাল্মীকি জয়ন্তী আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতে পালন করা হয়।মন্দিরে মহর্ষি বাল্মীকির মূর্তিতে বিশেষ পূজা হয়।রামায়ণ পাঠ ও সন্ধ্যা আরতি অনুষ্ঠিত হয়।শোভাযাত্রা বের করা হয়, যেখানে ভক্তরা গানে, বাদ্যযন্ত্রে বাল্মীকির মাহাত্ম্য প্রচার করেন।সমাজে দান-ধ্যান, প্রসাদ বিতরণ, ও গরীবদের আহার করানো হয়।এই উৎসব বাল্মীকি সমাজকে শুধুমাত্র সামাজিক ও সাংস্কৃতিকভাবে একত্রিত করে না , এটি তাঁদের আত্মপরিচয় ও গৌরবের প্রতীক।
‘আদিকবি’র চিরন্তন রচনার অনুবাদের ফলেই মহাকবি তুলসীদাস, কৃত্তিবাস ওঝা সহ বিভিন্ন কবিরা রামভক্তি আর রামভক্তির মাধ্যমে অপসংস্কৃতির ভয়াবহ নৃশংসতার মাঝেও ভারতের স্বকীয়তা কে বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছিলেন। মহাকবি ভাস, আচার্য শঙ্কর, রামানুজ, মহাকবি কালিদাস প্রত্যেকেই নিজের রচনায় আদি কবির প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন। শ্রী তুলসীদাস গোস্বামী রামচরিতমানস-এ বলেছেন — ‘বাল্মীকি ভে ব্রহ্ম সমানা’।
আদিকবি বাল্মীকি রামায়ণে শ্রী রামের চরিত্রের মাধ্যমে ভারতীয় ধর্মের মূর্ত রূপ দেখিয়েছেন, তার সাথে কাব্যের মাধ্যমে গভীর রাজনীতি ও সমাজনীতিও বুঝিয়েছেন , ভারতসহ বিশ্বের ভৌগলিক পরিচয় আর ভারতের জীববৈচিত্র্য বিশেষভাবে বলেছেন। এখন রামায়ণে উল্লিখিত গ্ৰহ নক্ষত্রের অবস্থানের সাহায্যে ও প্রত্ন-জ্যোতির্বিদ্যার সাহায্যে ভারতীয় ইতিহাসের অজানা অধ্যায়গুলো জানার চেষ্টা হচ্ছে। ভারতীয়রা যে জাতি ও সংস্কৃতি হিসেবে বিশ্বের মাঝে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারছে তার কৃতিত্ব আদিকবির রচনাশৈলী কে দিতে হয়।
আদিকবি বাল্মিকী রামায়ণের মাধ্যমে যে গভীর দার্শনিক জ্ঞান, মানব জীবনের উত্তরণের যে পথ দেখিয়েছেন তা বিভিন্ন ইউরোপীয় দার্শনিকদের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। এই কারণেই বাল্মিকী জয়ন্তী’র অপর নাম ‘প্রগত উৎসব’ অর্থাৎ যা প্রগতির পথ দেখায়।
মহর্ষি বাল্মীকির পরম্পরা কে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পালন করছে যে সমাজ, তারা এইভাবে সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীতে পরিণত হল কি করে তা গভীর অধ্যয়নের বিষয়। বাল্মীকি জয়ন্তী কে কেন্দ্র করে যে সমাজ ভারতের অমরত্বের মূল কেন্দ্রবিন্দু কে চিনিয়ে দিতে তৎপর থাকে, তাদের সেই প্রয়াসের তুলনায় বাকি তথাকথিত ‘শিক্ষিত’ সমাজের উদাসীনতা প্রতিবছর আমাদের প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়।
কাব্য কে যদি ললিতকলার এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ ধরা যায়, তাহলে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ আদিকবির প্রতি ঋণী। আমাদের প্রয়াস এমন হোক যাতে বাল্মীকি জয়ন্তী তথা ‘প্রগত উৎসব’ কে কেন্দ্র করে সামাজিক সদ্ভাবের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় এবং পিছিয়ে পড়া ‘বাল্মীকি সমাজ’ -এর সামাজিক অগ্ৰগতির ক্ষেত্র প্রস্তুত হয় আর বাকি সমাজ উপলব্ধি করুক যে মহর্ষি বাল্মীকি শুধুমাত্র বাল্মীকি সমাজের আত্মপরিচয়ের অংশ নয় বরং প্রত্যেক ভারতবাসীর, ভারতীয় হিসেবে অস্তিত্বের সঙ্গে জড়িত একটি ‘অমর’ নাম।
পিন্টু সান্যাল
