সফল সাংবাদিক রাজা কৃষ্ণনাথের ২০০ বছর

আলোড়ণ-আলোচনা ছাড়া প্রায় চোখের আড়ালেই কেটে গেল এক মহান শিক্ষাব্রতীর ২০০ বর্ষপূর্তি। অনেকের জানা নেই, রাজা হয়েও সাংবাদিকতার প্রসারে তিনি কীভাবে ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েছেন। কলম ধরেছিলেন সেকালের শাসকদের বিরুদ্ধে।  কৃষ্ণনাথ রায়ের স্বপ্নের প্রতিষ্ঠান আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন মহলের দাবি সত্বেও প্রতিষ্ঠানটি তাঁর নামে চিহ্ণিত হয়নি। মাত্র মাত্র বাইশ বৎসর বয়সে আত্মহত্যা করেছিলেন রাজা কৃষ্ণনাথ। 

১৮২২ খ্রিস্টাব্দের ১২ ই মার্চ কাশিমবাজার রাজ পরিবারে কৃষ্ণনাথ রায়ের জন্ম হয়। পিতা রাজা হরিনাথ রায় এবং মাতা রাণী হরসুন্দরী দেবী। কৃষ্ণনাথের দশ বৎসর বয়সে রাজা হরিনাথ পরলোক গমন করেন। কৃষ্ণনাথ সেসময় নাবালক হওয়ার ইংরেজ সরকারের নিয়ম অনুসারে ১৮৩২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কোর্ট অব ওয়ার্ডসের অধীনে প্রতিপালিত হন। মেধাবী কৃষ্ণনাথ ফরাসী ও ইংরাজী ভাষা অতি সহজেই শিখে যান। সেজন্য হিন্দু মুসলমান ও খ্রিষ্টান সকল ধর্মেরই শিক্ষক নিয়োজিত ছিলেন। 

সরকার নিযুক্ত অভিভাবক উইলিয়াম স্টিফেন ল্যামব্রিক তাঁকে ইংরেজি , ইতিহাস , জ্যামিতি, ভূগোল, রসায়ন ও জ্যোতির্বিদ্যা শেখাতেন। সংস্কৃত কলেজের ছাত্র পণ্ডিত শিবপ্রসাদ সংস্কৃত ও বাংলা শেখাতেন। ডিরোজিয়োর ছাত্র দিগম্বর মিত্রের সংস্পর্শে আসার পর তাঁর মুক্তচিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সংস্কারমুক্ত উদারনৈতিক মনোভাবে উজ্জীবিত হন। কৃষ্ণনাথও অত্যন্ত খুশি হয়ে রাজা দিগম্বর মিত্রকে এক লক্ষ টাকা দান করেন। 

১৮৩৬ খ্রিস্টাব্দে পূর্ব বর্ধমান জেলার ভাতার থানার অন্তর্গত ভাটাকুল গ্রামের এক তিলি সম্প্রদায়ের অতি দরিদ্র পরিবারের অপরূপ সুন্দরী স্বর্ণময়ীকে (পূর্বের নাম সারদাসুন্দরী) বিয়ে করেন। অল্প বয়স থেকেই কৃষ্ণনাথ দেশে শিক্ষা প্রসারের সচেষ্ট ছিলেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে মাত্র তেরো বৎসর বয়সে নবপ্রতিষ্ঠিত কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের প্রথম পাঁচজনকে এক হাজার টাকা করে পুরস্কার ঘোষণা করেন। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে ১৫ বৎসর বয়সেই তিনি সৈদাবাদে একটি ইংরাজী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। 

১৮৩৮ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনাথের উদ্যোগে তার সরকার নিযুক্ত অভিভাবক ও গৃহশিক্ষক উইলিয়াম স্টিফেন ল্যামব্রিকের সম্পাদনায় মফস্বল বাংলার প্রথম ইংরাজী পত্রিকা ‘মুর্শিদাবাদ নিউজ’ প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটি নির্ভীকভাবে শাসকের সমালোচনা করত বলে পত্রিকার মুদ্রাকর সরকারের রোষে জরিমানা সহ নির্যাতন ভোগ করেন এবং ফলত, ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দের জুলাই মাসে পত্রিকাটির প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। 

এই ঘটনার দশ মাস পরে কৃষ্ণনাথের ঐকান্তিক আগ্রহ ও পৃষ্ঠপোষকতায় ১৮৪০ সালের ১০ মে গুরুদয়াল চৌধুরীর সম্পাদনায় মুর্শিদাবাদ থেকেই প্রকাশিত হয় বাংলা ভাষার সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘মুর্শিদাবাদ সম্বাদপত্রী’। সংবাদপত্রটি মাত্র এক বৎসর চলে। নির্ভীক ও নিরপেক্ষ মতামতের জন্য কোম্পানির আমলাদের অসহযোগিতাযর মুখে পড়ে।জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কোপে এর প্রকাশ বন্ধ হয়ে যায়। 

১৮৪১ খ্রিস্টাব্দে কৃষ্ণনাথ সাবালক হন এবং পরের বছর লর্ড অকল্যান্ড ‘রাজা’ উপাধি দেন। রাজা কৃষ্ণনাথের পরিকল্পনা ছিল মুর্শিদাবাদ জেলায় একটি পূর্ণাঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের। সেই মত তিনি ওই বৎসরে উনিশ বছর বয়সে একটি উইল করেছিলেন। পাশ্চাত্য শিক্ষার আলোকে কৃষ্ণনাথ প্রগতিশীল ও স্বাধীনচেতা ছিলেন। সেই সাথে তার মধ্যে কিছু দোষ ও গুণের দৃষ্টান্ত ধরা পড়েছিল। অপব্যয়ে ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি হয়। পারিবারিক অশান্তি ও শেষে এক মিথ্যা অপবাদে নিজের আত্মসম্মান বজায় রাখতে ভাবপ্রবণ কৃষ্ণনাথ মাত্র বাইশ বৎসর বয়সে ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দের ৩০শে অক্টোবর আত্মহত্যা করেন।

১৮৫৩ সালে মহারাণী স্বর্ণময়ী দেবী একটি কলেজ প্রতিষ্ঠিত করেন। নামকরণ করা হয়েছিল কৃষ্ণনাথ রায়ের নামে। স্বামীর মৃত্যুর পর, স্বর্ণময়ী কলেজটিকে আর্থিক সংকট থেকে বাঁচিয়ে জমি এবং অর্থ উভয়ই উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। মিঃ হ্যারিসন কলেজের প্রথম অধ্যক্ষ হন। কলেজের অবকাঠামো তৈরি করেন বিখ্যাত পণ্ডিত এবং লেখক ব্রজেন্দ্র নাথ শীল। 

২০১৮-র ১ অক্টোবর কলকাতা গেজেটে ‘দি মুর্শিদাবাদ ইউনিভার্সিটি অ্যাক্ট’ প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়, বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় গড়া হবে। ওই আইনের ৬৪ নম্বর ধারার ৫ নম্বর উপধারা অনুসারে ২০১৮ সালের ১ অক্টোবর খাতায়-কলমে কৃষ্ণনাথ কলেজের অবলুপ্তি ঘটে। সেই মতো কয়েক মাস আগে কৃষ্ণনাথ কলেজের যাবতীয় সম্পত্তি রাজ্য সরকারের নামে হস্তান্তরিত করা হয়। তবে, আইন পাশ হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয়ের নামকরণ ও স্থান নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়।

সাংসদ অধীর চৌধুরীর মতে, ‘‘ওই বিশ্ববিদ্যলয়ের সঙ্গে কৃষ্ণনাথের নাম না জুড়লে একটি ইতিহাস হারিয়ে যাবে। নাম হোক মুর্শিদাবাদ কৃষ্ণনাথ বিশ্ববিদ্যালয়।’’ তাঁর এই প্রস্তাবের পক্ষে কংগ্রেস স্বাক্ষর সংগ্রহে নামে। তৃণমূলের প্রাক্তন জেলা সভাপতি সুব্রত সাহাও ‘মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়’ নামের সঙ্গে ‘কৃষ্ণনাথ’ শব্দটি যুক্ত করার পক্ষপাতী। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যের কাছে সেই প্রস্তাব তিনি ইতিমধ্যেই দিয়েছেন বলে জানান ২০১৮-র নভেম্বর মাসে। তিনি বলেন, ‘‘বিধানসভায় বিল পাশ হওয়ার পরই ঐতিহাসিক কারণে মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়-এর সঙ্গে কৃষ্ণনাথের নাম সংযুক্ত করার জন্য শিক্ষামন্ত্রীর কাছে প্রস্তাব দিয়েছি।’’ কলেজ পরিচালন সমিতির সভাপতি মৃণাল চক্রবর্তী বলেন, ‘‘নামকরণের বিষয়ে প্রাক্তনীর দাবি মেনে ‘মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়’ নামের সঙ্গে ‘কৃষ্ণনাথ’ শব্দটি যুক্ত করার প্রস্তাব পরিচালন সমিতির পক্ষ থেকে উচ্চশিক্ষা দফতরে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে এখনও তার কোনও উত্তর আসেনি।’’

কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক কামাখ্যাপ্রসাদ গুহ কৃষ্ণনাথ কলেজের প্রাক্তনী। তিনি বলেন, ‘‘১৬৫ বছরের মধ্যে ১০৩ বছর ওই কলেজের আর্থিক ও অন্য দায় বহন করেছে কাশিমবাজার রাজ পরিবার। ফলে ‘মুর্শিদাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়’ নামের সঙ্গে ‘কৃষ্ণনাথ’ শব্দটি যুক্ত করা হোক।’’ না কলেজ, না বিশ্ববিদ্যালয়— এই ত্রিশঙ্কু অবস্থার অবসান চেয়ে প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে উচ্চশিক্ষা দফতরে আবেদন করা হয়। ২০১৯-এর জুন মাসে মৃণাল চক্রবর্তী বলেন, ‘‘পরবর্তী নির্দেশিকা না পাওয়া পর্যন্ত কলেজ পরিচালন সমিতিকেই কাজ চালিয়ে যেতে বলেছে উচ্চশিক্ষা দফতর। সেই মতো কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক স্তরে ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি চলছে।’’
সূত্র— উইকিপিডিয়া, অনল আবেদিন (আনন্দ বাজার পত্রিকা)।

অশোক সেনগুপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.