নতুন বছরে কি ঘুরে দাঁড়াবে অর্থনীতি?

২০২০ সালটা আমাদের জীবনে না এলেই ভাল হত। অতিমহামারীতে এবছর লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকেরই আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব চলে গিয়েছেন না ফেরার দেশে। বছর শেষ হতে চলল। করোনার প্রকোপ কমতির দিকে। আশা করা হচ্ছে, জানুয়ারিতেই ভ্যাকসিন দেওয়া শুরু হবে। এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হল, আগামী বছর কেমন কাটবে? অর্থনীতি কি আবার বিকশিত হতে পারবে? কলকারখানা পুরোদমে চালু হবে? মানুষ চাকরি পাবে? বেতন কি বাড়বে? ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা কি লাভ করতে পারবে?

এই প্রশ্নগুলোর জবাব দেওয়া খুব শক্ত। আমাদের অর্থনীতির হাল আগে থেকেই খারাপ হয়ে আসছিল, করোনা এসে তার ওপরে দিয়েছে জোর ধাক্কা। পরিসংখ্যান বলছে, অর্থনীতিতে তেজি ভাব কাটতে শুরু করেছে ২০১৮ সালের মার্চ থেকে। ওই বছর জানুয়ারি থেকে মার্চের ত্রৈমাসিকে অর্থনীতির বিকাশ হয়েছিল ৮.১৮ শতাংশ হারে। তারপর থেকেই বিকাশের হার কমতে থাকে। ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বিকাশের হার হয়েছিল ৪.০৮ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যে, অর্থাৎ করোনা অতিমহামারী হওয়ার ঠিক আগে বিকাশের হার আরও কমে হয়েছিল ৩.০৯ শতাংশ। অনেকে বলছেন ঠিকঠাক পরিকল্পনা ছাড়া নোটবন্দি ও জিএসটি চালু করার জন্যই অর্থনীতিতে এই ধাক্কা।

মার্চের শেষে এসে পড়ল লকডাউন। চার ঘণ্টার নোটিশে সবকিছু স্তব্ধ হয়ে গেল।

১৮৯৭ সালের এপিডেমিক ডিজিজ অ্যাক্ট অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার দেশ জুড়ে লকডাউন জারি করে। পরে মানুষের নানা সুবিধা-অসুবিধার কথা চিন্তা করে একাধিকবার লকডাউনের নিয়ম-কানুন বদলানো হয়।

প্রথম থেকেই জরুরি পণ্য ও পরিষেবাকে লকডাউনের বাইরে রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরে বোঝা গেল, সহায়ক শিল্পগুলির ঝাঁপ বন্ধ থাকায় অত্যাবশ্যকীয় পণ্য উৎপাদিত হতে পারছে না। মানুষ অতি প্রয়োজনীয় পরিষেবাও পাচ্ছেন না। সবচেয়ে বড় কথা, যানবাহন বন্ধ থাকার জন্য অত্যাবশ্যকীয় শিল্পের কর্মীরা অফিসে পৌঁছতেই পারছেন না।

এই অসুবিধার কথা চিন্তা করে ই পাস চালু করা হয়। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে পণ্য পৌঁছে দেওয়ার জন্য ও পরিযায়ী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরানোর লক্ষ্যে চালু হয় স্পেশাল ট্রেন। অর্থনীতিকে খানিক চাঙ্গা করার জন্য মে মাসের মাঝামাঝি সরকার একটি প্যাকেজ ঘোষণা করে। তার পরিমাণ ছিল ২০ লক্ষ কোটি টাকা। প্যাকেজের নাম ‘আত্মনির্ভর ভারত অভিযান’।

এপ্রিল থেকে জুনের ত্রৈমাসিকে অর্থনীতি সংকুচিত হয় ২৪ শতাংশ। ১৯৯৬ সাল থেকে অর্থনীতির ত্রৈমাসিক বিকাশের হিসাব রাখা শুরু হয়। তখন থেকে একটি ত্রৈমাসিকে অর্থনীতির এতদূর সংকোচন কখনও হয়নি। ২০১৯ সালের প্রথম ত্রৈমাসিকের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, এবছর ওই একই সময়ে ম্যানুফ্যাকচারিং-এ উৎপাদন কমেছে ৪০ শতাংশ। পরিষেবা ক্ষেত্র সংকুচিত হয়েছে ২০ শতাংশ। নির্মাণক্ষেত্রে সংকোচন হয়েছে সবচেয়ে বেশি, ৫০ শতাংশ।

জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ধাপে ধাপে আনলকিং করা হয়। একটু একটু করে খুলে দেওয়া হয় অর্থনীতির নানা ক্ষেত্র। জনপরিবহণ চালু হয়। যদিও ওই সময় দৈনিক সংক্রমণের হার ছিল সবচেয়ে বেশি।

এই সময় থেকেই সবাইকে অবাক করে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়াতে থাকে ভারতের অর্থনীতি। অর্থনীতিবিদরা বলেছিলেন, যতই আনলক করা হোক, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের ত্রৈমাসিকে অর্থনীতির সংকোচন হবে অন্তত ১০ শতাংশ। পরে দেখা গেল, অত খারাপ অবস্থা হয়নি। সংকোচন হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তা ৭.৫ শতাংশ। অর্থনীতিবিদদের আশঙ্কার চেয়ে কম।

রেটিং এজেন্সি ক্রাইসিল বলেছে, লকডাউনের কয়েক মাসে কেউ কিছু কেনাকাটা করতে পারেননি। আনলক শুরু হওয়ায় বাজারে নানা পণ্যের চাহিদা বেড়েছে। তার ওপর ভর দিয়েই ধাক্কা খানিক সামলে উঠেছে অর্থনীতি।

পরপর দু’টো ত্রৈমাসিকে অর্থনীতির সংকোচন হওয়ায় ভারতের অর্থনীতি আনুষ্ঠানিকভাবে মন্দার পর্বে প্রবেশ করেছে। সরকার চাইছে, অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের ত্রৈমাসিকে অন্তত সংকোচন বন্ধ হোক। সেজন্য অক্টোবর-নভেম্বরে আরও কয়েকটি আর্থিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ধারণা, অর্থনীতিকে নেতিবাচক বিকাশের পথ থেকে সরিয়ে আনা অসম্ভব নয়। এমনকি অক্টোবর-ডিসেম্বরের ত্রৈমাসিকে খুব সামান্য, প্রায় ০.১ শতাংশ বৃদ্ধি হলেও আশ্চর্যের কিছু নেই।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের মতে ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে অর্থনীতির বিকাশ হতে পারে ১৪.২ শতাংশ।

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের অর্থনীতিবিদরা যখন নতুন বছরে বিকাশের কথা বলছেন, তখন নিশ্চয় আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে। কিন্তু একটা কথা মনে রাখতে হবে। করোনা অতিমহামারী যত দ্রুত বিদায় নেবে, তত বেশি চাঙ্গা হবে অর্থনীতি। ‘২০ সালের শেষদিকে ব্রিটেনে দেখা গিয়েছে করোনার এমন এক স্ট্রেন যা আগের চেয়েও দ্রুত সংক্রমিত হতে পারে। শোনা যাচ্ছে, ভারতেও এসে পড়েছে সেই স্ট্রেন। নতুন বছরে যদি ভ্যাকসিন ও সামাজিক সচেতনতার মাধ্যমে নতুন স্ট্রেনকে রুখে না দেওয়া যায়, তাহলে আরও একটা জোর ঝটকা লাগবে অর্থনীতিতে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.