শ্রীরামের মহিমার কি দিব তুলনা।
তাহার প্রমাণ দেখ গৌতম-ললনা।।
পাপীজন মুক্ত হয় বাল্মীকির গুণে।
অশ্বমেধ ফল পায় রামায়ণ শুনে।।
রামনাম লইতে না কর ভাই হেলা।
ভবসিন্ধু তরিবারে রামনাম ভেলা।।
অনাথের নাথ রাম প্রকাশিলা লীলা।
বনের বানর বন্দী জলে ভেসে শিলা।।
হ্যাঁ এই পাঁচালী ই আমার ঠাকুমা প্রতি বছর রাম নবমীর দিন পড়ত। অনেক কমিউনিস্ট সেকুলার ই তো বলে বেড়াচ্ছেন যে রাম নবমী বাঙালি উৎসব নয়।কিন্তু আমার ছিলাম বেহালার আদি বাসিন্দা।চিরকালই আমার পাঁচ পিসি, ঠাকুমাকে রামনবমী পালন করতে দেখতাম। সেখানে অবাঙালিত্ব আমার কোনো দিন চোখে পড়ে নি।
আমার ঠাকুমা এই পুজো ,উপবাস নিয়ম তার শাশুড়ির কাছ থেকে পেয়েছিলেন। প্রতি বছর বাসন্তী দুর্গা পুজোয় আমার বাড়ি সে এক হৈ হৈ কান্ড হত। আমি মফস্বলের মেয়ে। সেকুলারিজমের কালো বিষ তখন আমার এলাকায় ঢোকেনি। বাসন্তী পূজার সূচনার দিন থেকেই ঠাকুমা সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের বড় শরিকের বাড়ি অন্নপূর্ণা মন্দিরে পুজো পাঠাতেন।বলতেন,” এই পুজোয় ঘরে অন্নভাব হয় না”। বাড়িতে নিরামিষ রান্না হত।
আমি পুজো নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করলে ঠাকুমা রাজা সুরথ, দেবীমাহাত্মম, চণ্ডাল দের মাটঙ্গী পূজা, দেবীর অন্নপূর্ণার কথা এসব গল্প শোনাতেন।প্রতি ফি বছর আমি প্রশ্ন করতাম।উত্তর পেতাম অনেক প্রাচীন পুরান , শাস্ত্র কাহিনী।আসলে ভালো লাগত । আগ্রহ ছিল ভারী এসব জানার।
বাসন্তী অষ্টমীর দিন আমি ভোরে উঠে স্নান করে পিসীদের সাথে বড় বাড়ির অন্নপূর্ণা মন্দিরে যেতাম। ধুম ধাম করে পুজো হত। আমি ছোট বলে একদম সামনে বসার অধিকার পেতাম। সামনে বসে অষ্টধাতুর দেবী মূর্তি , রুপোর শিব সব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতাম।বাড়ি গিয়ে প্রশ্ন করতে হবে তো তাই।
ওই দিন নিমন্ত্রণ থাকত অনেক জায়গায় অন্নপূর্ণা পুজোর। আমি অপেক্ষা করতাম দিন কেটে কখন সন্ধ্যা হবে। পরেরদিন রামনবমী। অনেক জোগাড় করতে হবে।পিসিরা, ঠাকুমা পুজোর কাজ করবে, আমি বসে দেখব আর প্রশ্ন করে মাথা খাব।
সন্ধ্যায় কাকা বাজার করত রামনবমীর। খিচুড়ি হবে, লাবড়া হবে, রাবরী আস্ত , আর বড় বড় গুড়ের বাতাসা। ঠাকুমা পিটুলী গুলে বাটি আমার হাতে ধরিয়ে দিত উঠনে তুলসী মঞ্চ তে আলপনা দেবার জন্য।আমি আলপনা দিয়ে, ফুলের মালা দিয়ে মঞ্চ সাজাতাম। সারারাত সবজি কাটা হত লাবড়ার জন্য।
পরদিন ভোরে বাড়ির সবাই উঠে স্নান করে নিত। বাবা কাকারা কলতলায় স্নান করত। পিসিরা পুকুরে হুড়মুড় করে একটা ডুব দিয়ে নিত,অনেক কাজ করতে হবে।আমিও পুকুরে স্নান করার বায়না ধরতাম।বাবা, কাকার কড়া বারণ ছিল। তবুও যদি একটু অনুমতি পাওয়া যায়।
স্নান করে পিসিরা নতুন কাপড় পরে ঠাকুর ঘর, রান্না ঘরে ঢুকত।সেজ পিসি দারুন রান্না করত। রান্না ঘরের ডিপার্টমেন্ট সেজ পিসির ছিল।পায়েস ছোট পিসি রাঁধত যদিও। ঠাকুমা মেজ পিসিকে দিয়ে ভজনাশ্রমে পুজো পাঠাত। সেদিন পিসিরা, ঠাকুমা সবার উপোস থাকত। দুপুরে ঠাকুমা বসে রাম পাঁচালী পড়ত ঠাকুর ঘরে।ভোগ রান্না হয়ে ঠাকুর ঘরে পুজো পড়ত। পুজো হলে আমি রাম নবমীর কথা জিজ্ঞাসা করতাম। ঠাকুমা গল্প করে শোনাত।
দুপুরে মেরে ধরেও আমাকে ঘুম পাড়ানো যেত না। বিকেল চারটে তে ভজনাশ্রম থেকে মহারাজ, সন্ন্যাসীরা আসবে যে। বাড়িতে রামায়ন কথা পড়ার আসর বসবে । আমি গোঁ ধরে বসে থাকতাম।
বিকেল হলে সব সন্ন্যাসী ,মহারাজ আসতেন আমাদের বাড়ি।পিসিরা উলু দিয়ে ঘটির ধরা জলে পা ধুইয়ে দিতেন।আরও কত শত আত্মীয় ,বন্ধু, প্রতিবেশীরা আসতেন।ছাদে বা ঠাকুর ঘরে রামায়ন কথা পড়বার আসর বসত। ভারী সুন্দর সুর করে রামায়ন পড়া হত।সেই সুর আজও আমার কানে বাজে। কিছুটা গীতা পাঠ হত।
সবশেষে সেই বড় বড় গুড়ের বাতাসার হরি লুঠ হত উঠনে, তুলসী মঞ্চের সামনে।আমরা ছোটরা লাফিয়ে ছুটে বাতাসা কুরাতাম।কে কত বাতাসা নিতে পারে প্রতিযোগিতা। তারপর সবাইকে খিচুড়ি, লাবড়া, চাটনি, পায়েস, রাবাড়ি খাওয়ানো হত।সবাই খেয়ে চলে গেলে পিসিরা, ঠাকুমা খেতে বসত।
বিশ্বাস করুন রামনবমীকে আমি সর্বভারতীয় উৎসব হিসাবেই দেখেছি ছোট থেকে। তখন কেউ আমাকে বিষ দিতে আসেনি, বলে নি যে রাম বাঙালিদের নয়।আজ বিষাক্ত সেকুলারদের দল এসে কেন এই সব বিষ দিচ্ছে? এদের বধ কিন্তু আমাদের ঘরের রাম রাই করবে।সেই দিন খুব নিকটবর্তী ।
দুর্গেশনন্দিনী