একটা রাষ্ট্র বা জাতির পক্ষে এমন কোন একটা সময় থাকে, যেটি বহু বছর যাবৎ সেই রাষ্ট্র বা জাতির সমষ্টিগত স্বপ্নে কাঙ্খিত, বা আকাঙ্খিত এমন কোন একটি মুহূর্ত যা অতি সযত্নে লালিত হয়ে আসছে বা লালন করা হয়েছে নির্দিষ্ট একটি লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নিয়ে। অযোধ্যায় পবিত্র রামমন্দিরের ভূমি পূজনের আজকের এই দিনটিও সেরকমই একটি বহুকাঙ্খিত মুহূর্ত যা সমগ্র হিন্দু সমাজ বহু বছর ধরে সত্যি হওয়ার স্বপ্নে লালন করে আসছে নিজের মনের গভীরে।
ভারতবাসী তথা সারা বিশ্বের হিন্দু সমাজ প্রায় অর্ধ সহস্রাব্দ যাবৎ এই দিনটির অপেক্ষায় ছিলেন, যেদিন বহিরাগত, আক্রমণকারী জাহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবরের নামাঙ্কিত অনাকাঙ্খিত সৌধটির অপসারণ ঘটিয়ে সেই স্থানে মর্যাদা পুরুষোত্তম শ্রীরামচন্দ্রের ভব্যমন্দির নির্মিত হবে।
রামমন্দিরের ভূমি পূজনের প্রাক মুহূর্তে যখন সমগ্র হিন্দু সমাজ আনন্দে উচ্ছসিত, উদ্বেলিত, সমগ্র অযোধ্যা নগরী দীপাবলির ন্যায় সৌম্য আলোকমালায় সুসজ্জিত হয়ে হিন্দু সমাজের নবজাগরণের বার্তা দিচ্ছে, সেই সময় দাঁড়িয়ে আমরা দেখছি জাতীয় কংগ্রেসের কিছু নেতা নেত্রী এই বিষয়ে কৃতিত্ব নিতে মাঠে নেমে পড়েছেন! এমনকি তাদের কেউ কেউ এর জন্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে কৃতিত্ব দিতেও পিছপা নন! যদিও প্রকৃত সত্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।
মধ্যপ্রদেশের ইন্দোরের ৬২ বছরের এক ‘তালাকপ্রাপ্ত’ মুসলিম মহিলা, ৫ সন্তানের মা শাহ বানোর ‘খোরপোষের মামলা’য় সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে তৎকালিন প্রধানমন্ত্রী রাজিব গান্ধী সেই সময়কার আইনমন্ত্রী আরিফ মহম্মদ খানের শত আপত্তি উপেক্ষা করেও একপ্রকার মোল্লাতন্ত্রের চাপেই বদলে ‘মুসলিম ওম্যান অ্যাক্ট(প্রোটেকশান অফ রাইট অন ডিভোর্স) ১৯৮৬’ প্রণয়ণ করেন। সেই ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় উত্তর ভারতের ‘হিন্দু ভোটের চিরস্থায়ী ড্যামেজ কন্ট্রোলে’ বিতর্কিত রাম মন্দিরের তালা খুলে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় রাজীব গান্ধীর নেতৃত্বাধীন তৎকালীন কেন্দ্র সরকার। এই সিদ্ধান্তের পিছনে একফোঁটাও হিন্দু প্রেম ছিল না, বরং ছিল শুধুমাত্র রাজনৈতিক বাধকতাই। ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত অযোধ্যায় রামজন্মস্থলে বছরে মাত্র একবার পূজারির প্রবেশের অধিকার ছিল, রাজীব গান্ধী হিন্দু ভোটের ড্যামেজ কন্ট্রোলে সেই ক্ষেত্রে কিছুটা ঢিল দেন শুধু। এর বেশি আর কিছুই নয়।
কংগ্রেসি সরকার ও দল আসলে এই সিদ্ধান্তের দ্বারা হিন্দু সমাজকে কৃতার্থ করেছে এমন একটি মনোভাব দেখালেও বাস্তব চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন।
ভারতের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী বিশ্বনাথ প্রতাপ সিং বা ভি পি সিং যিনি মাত্র ৩৪৩ দিনের জন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে আসীন ছিলেন ও হিন্দু সমাজকে বিভাজিত করতেই ‘মন্ডল কমিশন’কে ব্যবহার করেছিলেন এবং যার ফলশ্রতিতেই বিজেপি সেই সরকারের থেকে সমর্থন তুলে নিয়ে ‘কমন্ডল’ রাজনীতি চালু করতে ভারত জুড়ে রথ যাত্রার সূচনা করেন বলে অনেকে প্রচার করেন, বাস্তব চিত্র কিন্তু সম্পূর্ণরূপে শুধুমাত্র সেটাই ছিল না।
জাহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবরের সেনাপতি মীরবাকির দ্বারা রামজন্মস্থলের আরাধ্য মন্দির ধ্বংস করে মসজিদ নির্মাণ ও তার পুনরুদ্ধারে হিন্দু সমাজের শতাধিক সংগ্রাম ও প্রচেষ্টার কাহিনী আমরা আগেও বহুবার পড়েছি ও জেনেছি।
এই প্রসঙ্গে বর্তমানে আমাদের যেটা জানা দরকার সেটা হল ১৯৮৬ সালের রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের প্রতিনিধি সভায় একটি সংকল্পপত্রে দেশব্যাপী রামজন্মভূমি নিয়ে প্রচারের জন্য সিদ্ধান্ত হয় ও তার পরবর্তীতেই বিজেপির তৎকালিন সভাপতি শ্রী লালকৃষ্ণ আডবাণি রামরথ যাত্রার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। অর্থাৎ ভারতের রাজনীতিতে ভি পি সিং বা তার মন্ডল রাজনীতির প্রারম্ভের বহু পূর্বেই রামমন্দির আন্দোলনের ভূমিকা রচনা শুরু হয়েছিল বলা যায়।
উত্তরপ্রদেশের তখতে আসীন তখন মুলায়ম সিং যাদব। তিনি পরিস্কার ঘোষণা করেন যে অযোধ্যায় আডবাণি কেন, একটি পাখিও প্রবেশ করতে পারবেন না! অযোধ্যার পথে বিহারেই লালকৃষ্ণ আডবাণিকে লালু প্রসাদ যাদব গ্রেপ্তার করলেও, অযোধ্যায় করসেবকদের একটি বড় জমায়েত হয় এবং মুলায়মের পুলিশ সেখানে গুলি চালালে অনেক করসেবকের মৃত্যুও হয়! যার ভিতর কলকাতার দুজন যুবক, রাম কোঠারি ও শরদ কোঠারি ও ছিলেন।
তীব্র থেকে তীব্রতর রামমন্দির আন্দোলন, বহু করসেবকের মৃত্যু ও দেশব্যাপী রামরথ যাত্রায় ভর করে তারপর ভারতের রাজনীতিতে বিজেপির উত্থান হয়েছে অনেক। দিনে দিনে আসন বৃদ্ধি ও সরকার গঠনও হয়েছে রাজ্যে রাজ্যে ও কেন্দ্রে। একসময় লোকসভাতে ‘হাম দো অওর হামারে দো’র বিজেপি পার্টি এখন লোকসভাতে ৩০৩টি আসন দখল করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছেছেই শুধু নয়, রাজ্যসভাতেও বর্তমানে প্রায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পথে। দেশের অর্ধেকের বেশি রাজ্যে আজ তাদের সরকার। কিন্তু তবুও বিজেপি এখনও তার ঘোষিত লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য থেকে একফোঁটাও সরে আসেনি। আজও দলটি হিন্দুত্বের প্রতি ঠিক ততটাই দায়বদ্ধ যতটা তারা ১৯৮৫ সালেও ছিল! ১৯৯০ সালে রামজন্মভূমি আন্দোলনের ফলে করসেবকদের মৃত্যু ও তার পরর্বতীতে সেই রাজ্যে কল্যাণ সিংয়ের সরকার হলেও ১৯৯২ সালে বিতর্কিত বাবরি কাঠামো ধ্বংসের ক্ষেত্রে কোনরূপ আপোষ কিন্তু তাদের তরফে কেউ কখনও করেননি। সরকারের পতন ঘটেছে, তবু কল্যাণ সিং, উমা ভারতী, মুরলিমনোহর যোশি, লালকৃষ্ণ আডবানিরা তাদের লক্ষ্য থেকে সরেননি একফোঁটাও! এখনও তাঁদের নিয়ম করে আদালতের সামনে হাজিরা দিতে হচ্ছে প্রায় প্রায়ই!
আমরা কমবেশি সকলেই এটা জানি যে একদা বহু বিতর্কিত বাবরি মসজিদের স্থানটি ১৯৪০ সাল পর্যন্ত ‘মসজিদ-ই-জন্মস্থান’ বলে পরিচিত ছিল অযোধ্যার স্থানীয় অধিবাসী ও আশেপাশের নাগরিকদের কাছে। ১৯৪৯ সালের বহু বিতর্কিত ২২-২৩ ডিসেম্বরের যে রাতে ঐ স্থানে ‘রামলালা’র আবির্ভাব হয় বলে কথিত আছে, সেই সময় থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত স্থানটি ছিল একপ্রকার তালা বন্ধই! তারপর রামজন্মভূমি আন্দোলন ও বাবরি ধ্বংস, এলাহাবাদ কোর্টের ‘দৌত্যমূলক রায়’ – সরযূর বুক দিয়ে জল গড়িয়েছে বহু!
২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের পূর্বে কপিল সিব্বালের সুপ্রিম কোর্টের কাছে রায় পিছোনোর আবেদন ও বহুদিন ধরে চলে আসা বামাতি ও জামাতি মিডিয়ার মসজিদের পক্ষে ও মন্দিরের বিপক্ষে মিথ্যা প্রোপাগান্ডায় দেশের কারও কারও মনে ঐ স্থানে প্রাচীন কালে মন্দিরের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ থাকলেও আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার খননের পর প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রী ও প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ থেকে আজ এটা দিনের আলোর মতোই পরিস্কার হয়ে গেছে যে বহু বিতর্কিত ঐ স্থানে প্রাচীন কাল থেকে মন্দির ব্যাতীত আর অন্য কোন কিছুই ছিল না।
বর্তমান রাম মন্দিরের স্থলই মর্যাদা পুরুষোত্তম রামের জন্মস্থান কি না, সেই প্রশ্নর থেকেও আমার কাছে এটা গুরুত্বপূর্ণ যে ১০০ কোটি হিন্দুর আরাধ্য দেবতার জন্মনগরীর কোন একটি স্থানে রামের জন্ম হয়েছিল বলে সমগ্র হিন্দু সমাজের বিশ্বাস আছে ও ছিল। অকস্মাৎ কোন এক সকালে জাহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবরের সেনাপতি মীর বাকি সেখানে এসে কোটি কোটি হিন্দুর আরাধ্য দেবতা রামের জন্মস্থল বলে পরিচিত সেই পুণ্য ক্ষেত্রকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে মসজিদ নির্মাণ করেছেন! একথা স্বীকার করতে কংগ্রেস, বামপন্থী সহ সকল রাজনৈতিক দলগুলোর বাধে কোথায়? কেন? কিসের স্বার্থে? হিন্দু সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, বিশ্বাসের কি কোন মূল্যই নেই এদের কাছে!?
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে হিন্দু ভাবাবেগ ও বিশ্বাসেরই যদি মর্যাদা না থাকে, তবে সেই দেশের সংবিধান ও আইন সভার কি মূল্য আছে!? ইরাক, আফগানিস্থান, পাকিস্তান, বাংলাদেশের অমুসলিমদের মতই যদি এই দেশের হিন্দুদেরও একই দশা হয় তবে গালভরা এই ধর্মনিরপেক্ষতা কিসের ও কোথায়!? তবে এই সংখ্যাগরিষ্ঠতার অর্থ কি!? কেন সংখ্যাগুরুকেই তার বিশ্বাস ও মর্যাদার বারংবার বলি দিতে হবে!? এই দেশে সংখ্যাগুরুদের যদি কোন অধিকারই না থাকে, তবে সব দায়গুলো কেন শুধু তাকেই পালন করতে হবে!?
বর্তমান সময়ে সারা দেশজুড়ে হিন্দুর যে নবজাগরণ ঘটেছে, রাজনৈতিক সত্তায় হিন্দুত্বের ছোঁয়া লেগে যে ‘রাজনৈতিক হিন্দু’র জন্ম হয়েছে, সেই হিন্দু শৈশব পার করে যৌবনে পদার্পণ করুক। কারণ, সামনে আরও বৃহৎ লড়াইয়ের ক্ষেত্র পড়ে আছে। কাশী বিশ্বনাথ থেকে মথুরায় কৃষ্ণ জন্মস্থান সহ আরও বহু ক্ষেত্র পুনরুদ্ধার এখনও বাকি।
আজও যদি আমরা ঐক্যবদ্ধ হতে না পারি, সমাজের সমস্ত বিভেদ ভুলে সার্বিকভাবে ‘একক সত্তা’ বিশিষ্ট ‘হিন্দু’ হয়ে উঠতে না পারি তাহলে আগামীতে ভারতভূমি আরও ক্ষন্ডিত হবে এটা আজ একপ্রকার নিশ্চিত।
আজ ৫ই আগষ্ট ২০২০, যেদিন রামমন্দিরের ভূমিপূজন হচ্ছে, গত বছর ঠিক এই দিনেই ভারতীয় সংবিধানের ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা বিলুপ্ত করে জম্মু কাশ্মীরকে একটি ও লাদাখকে আর একটি কেন্দ্র শাসিত রাজ্যের মর্যাদা প্রদান করা হয়েছিল। ৫ই আগষ্ট ২০১৯ পূর্ববর্তী ভারতে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিগুলির সক্রিয়তা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের কোন কোন অংশের মদতে দেশের ভিতরই কম করে ৫০০রও অধিক কাশ্মীর তৈরী হয়েছে! এখনও সেই জায়গা গুলোতে বহু অপশক্তি সমানভাবে সক্রিয়!
যতদিন আমরা জাত-পাত, ভাষা-বর্ণ, আর্য-অনার্যের লড়াইয়ে ক্ষতবিক্ষত থাকবো, ততদিন এই শক্তিগুলোও সমানভাবে সক্রিয় থাকবে! বর্তমান পশ্চিমবঙ্গেই যেমন বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী, বাঙ্গালী-গোর্খা-লেপচা এরকম বহু বিভেদ তৈরী করা হচ্ছে একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যকে সামনে রেখেই! দেশের বাইরের একটি বৃহৎ চক্র এই লক্ষ্যেই নীরবে ও সুপরিকল্পিতভাবে কাজ করে চলেছে। হিন্দু সমাজ বিভক্ত হবে, ক্ষতবিক্ষত হবে আর অপর দিকে একের পর এক জেলার জনবিন্যাসে বদল ঘটতে থাকবে! এরকম চললে আদৌ কি আমরা শুধুমাত্র ‘রামমন্দির’ নির্মাণ করেই আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছতে পারবো!? এই দেশকে রক্ষা করতে পারবো? হিন্দু সংস্কৃতিকে বাঁচাতে পারবো!?
এর উত্তর আমাদেরই খুঁজতে হবে। হিন্দু যদি রাজনৈতিক হিন্দু, ঐক্যবদ্ধ হিন্দু না হয় তবে অযোধ্যার এই মন্দিরও বেশিদিন রক্ষা পাবে না। আবার কোনও না কোন জাহিরউদ্দিন মহম্মদ বাবর বা মীরবাকি সেই মন্দির ভেঙ্গে দেবে। সেই সময় কোন কল্যাণ সিং, লালকৃষ্ণ আডবাণি, নরেন্দ্রভাই দামোদরদাস মোদী বা অমিত শাহ, যোগী আদিত্যনাথ যে থাকবেনই এর নিশ্চয়তা কিন্তু নেই।
তাই, বিভেদ ভুলে সংকল্পবদ্ধ হোন। আত্মকেন্দ্রিকতা ছেড়ে রাজনৈতিক হিন্দু হয়ে উঠুন৷ নিজের আত্মমর্যাদা ও আত্মসম্মানকে জাগিয়ে তুলুন। না হলে বিলুপ্তি ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই।