ভারতের বিদেশনীতি, সুরক্ষানীতি ও অর্থনীতির মৌলিক পরিবর্তনের জন্য ভারতবাসী-সহ সমগ্র বিশ্ব এক নতুন ভারতকে অনুভব করছে। কারণ আজ বৈদেশিক ও প্রতিরক্ষানীতি পরিবর্তনের জন্য ভারতীয় সেনার মনোবল ও শক্তি বেড়ে গেছে। ভারতের বিশ্বাসযোগ্যতা বিশ্বে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। অধিক থেকে অধিকতর দেশ ভারতকে সমর্থন করছে এবং সহযোগিতা করতে আগ্রহী। ভারত রাষ্ট্রসঙ্ঘের সুরক্ষা কাউন্সিলের অস্থায়ী সদস্য হওয়ার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো ১৯৩ জন সদস্যের মধ্যে ১৮৪ জন সদস্যের ভারতকে সমর্থন করা। আন্তর্জাতিক যোগ দিবসের জন্য ভারতের প্রস্তাবটিও রাষ্ট্রসঙ্ঘের সকল সদস্যের অনুমোদন পেয়েছে। সৌরশক্তি-সহ অন্যান্য অনেক বিষয়ে বিশ্বের অধিকাংশ দেশকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে ভারতের উদ্যোগ ও ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ক্রমবর্ধমান, শক্তিশালী ও সমৃদ্ধিশালী ভারত সমগ্র মানবতা ও পরিবেশের জন্য এক পৃষ্ঠপোষক হিসেবে প্রমাণিত হবে। কারণ ভারতের বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গি কোনো প্রতিযোগিতা বা দ্বন্দ্ব নয়, আলাপআলোচনা; সঙ্ঘর্ষ নয়, সমন্বয় এবং কেবল মনুষ্যজগৎ নয়, সমগ্র বিশ্বচরাচরের সম্পর্কে একাত্ম ও সর্বাঙ্গীণ ভাবনা সমন্বিত। এটি বিশ্বের এমন একটি অনন্য দেশ যা কেবল নিজের সম্পর্কেই চিন্তা করে না। আমাদের সাংস্কৃতিক দর্শন সম্পূর্ণরূপে অন্যরকম।
অর্থনীতিতে প্রচুর পরিবর্তন প্রয়োজন, তবে দ্রুত চলমান অর্থনৈতিক চক্রের কারণে এ জাতীয় মৌলিক পরিবর্তনগুলি করা সহজ কাজ নয়। বর্তমানে করোনামহামারীর কারণে অর্থনৈতিক চাকা থেমে যাওয়ার মতো হয়ে পড়েছে। এই সময়ে ভারত সরকার অর্থনৈতিক নীতিগুলির সংশোধন করার ইচ্ছা দেখিয়েছে। কিন্তু ৭০ বছরের অর্থনীতির পুনর্যোজিত (realignment) করার জন্য সাহস, দুরদৃষ্টি এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের পাশাপাশি ধৈর্যসহ, সতত সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন। এই সমস্ত প্রচেষ্টায় নিজের একাত্ম, সর্বাঙ্গীণ, সর্বসমাবেশক মৌলিক বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির আলোকে বর্তমান প্রসঙ্গটি বিবেচনা করে যুগোপযোগী নতুন গতিবিধিকে স্বীকার করে যোজনা তৈরি করতে হবে। ভারত এখন এই দিকেই এগিয়ে চলেছে। এখন ভারত নিজেকে ‘ভারত’ হিসেবে অভিব্যক্ত করছে আর অবিচলিত ভাবে অগ্রসর হচ্ছে। বিশ্ব এটিকে দেখেছে। এবং অনুভব করছে। এই পরিবর্তন ভারতকে বিশ্বের কাছে কিছুটা নতুন করে অনুভব করাচ্ছে এবং ভারতকেও নিজের কাছে নতুন। বলে মনে হচ্ছে।
কয়েক দশকের প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ যে জাতীয় জাগরণ ঘটেছে তার এই মৌলিক পরিবর্তনের ফল বামপন্থী এবং তাদের দ্বারা অনুপ্রাণিত, লালিত সাংবাদিক ও তথাকথিত লিবারেল, বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের রাষ্ট্রবাদী হিসেবে জাহির করে নিরন্তর এর বিরোধিতা করে চলেছে। আসলে এটি রাষ্ট্রীয় আন্দোলন; ‘রাষ্ট্রবাদী’ নয়। রাষ্ট্রবাদ’ শব্দ ভারতীয় নয়, এর ধারণাও ভারতীয় নয়। এর উৎপত্তি পশ্চিমের জাতি-রাষ্ট্র (nationstate) থেকে। সেই কারণে ওখানে ন্যাশনালিজম্ অর্থাৎ রাষ্ট্রবাদ। পশ্চিমের এই রাষ্ট্রবাদ বিশ্বে দুটি বিশ্বযুদ্ধ উপহার দিয়েছে। এদের জাতীয়তাবাদ পুঁজিবাদের ফসল। এই উগ্র-জাতীয়তাবাদ সাম্যবাদের শ্রেণীভুক্ত। রাশিয়া দীর্ঘ অভিজ্ঞতা ছাড়াই নিজের কমিউনিস্ট মতাদর্শ মধ্য এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলুি ওপর জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল, তা সর্বজনবিদিত। একই ভাবে চীন কীভাবে জোর করে নিজের আগ্রাসী প্রবৃত্তি হংকং ও দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলিতে চীনা সাম্রাজ্যবাদের পরিচয় দিচ্ছে তা বিশ্বের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। অনুমান করা যায় যে চীন তার সীমান্তবর্তী ৬টি দেশের ৪১ লক্ষ বর্গকিলোমিটার এলাকা বেআইনিভাবে দখল করেছে এবং ২৭টি দেশের সঙ্গে তাঁর বিবাদ রয়েছে সীমানা নিয়ে। এইজন্য বিশ্বের বেশিরভাগ দেশকে চীনের সাম্রাজ্যবাদ বা সুপার ন্যাশনালিজমের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তৈরি হতে দেখা যাচ্ছে।
ভারতীয় চিন্তায় রাষ্ট্রবাদ নয়; রাষ্ট্রীয়তার ভাব রয়েছে। আমরা রাষ্ট্রবাদী নই, আমরা রাষ্ট্রীয়। সেই কারণে সঙ্ঘের নাম রাষ্ট্রবাদী স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ নয় , রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। আমাদের কোনো রাষ্ট্রবাদ আনার দরকার নেই। ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয়তার ধারণা ভারতের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গির উপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়ে আছে। এখানে স্টেট নয়, পিপল(মানুষ)-কে রষ্ট্রের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। ভারতের জনগণ বিভিন্ন ভাষায় কথা বলে, বহু জাতপাত রয়েছে, বহু দেব-দেবীর উপাসনা হয়। তাঁরা অধ্যাত্মভিত্তিক একাত্ম ও সর্বাত্মক জীবন দর্শনকে নিজের বলে বিবেচনা করে। এর মাধ্যমে আমরা নিজেদের সম্পূর্ণ সমাজ এবং এই ভূমির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে নিজেদের বিবেচনা করি। সত্যকে তার প্রাচীন বৈদিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখা এবং বর্তমান দৃষ্টিভঙ্গিতে আচরণ করা ভারতে জাতীয়তার প্রকাশ। আমাদের এই অভিন্ন পরিচয় ও আমাদের পারস্পরিক ভ্রাতৃভাব প্রকাশের মাধ্যমে সমাজকে স্নেহের সঙ্গে প্রদানের সংস্কার জাগ্রত করার এক জাতীয় অনুভতি জাগ্রত করার প্রয়াস। সমাজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে এই জাতীয়তার ভাব প্রকট হওয়াই জাতীয় পুনর্গঠন। এটি জাতীয় আত্মার জাগরণ ও প্রকাশ।
চীনের সম্প্রসারণবাদী আক্রমণাত্মক মনোভাবের প্ররিপ্রেক্ষিতে ভারতের জবাব ও প্রতিক্রিয়ার সাম্প্রতিক কয়েকটি ঘটনা নিয়ে বামপন্থীরা প্রচার করেছে যে ,এটি ভারতের ‘সুপার ন্যাশনালিজম্। বাস্তবে বামপন্থীরা কখনোই ভারতবর্ষের আত্মাকে বুঝতে পারেনি। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যা দেখা যাচ্ছে। তা এখনও পর্যন্ত ভারতকে দমন করা, অস্বীকার করা। ভারতবর্ষের ভাবনাই ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’ ও ‘সর্বেপি সুখিনঃ সন্তু। তাই এই আত্মজাগরণ ও আত্মনির্ভরতার ভিত্তিতে শক্তিসম্পন্ন হওয়ার যোজনা কারও ভয়ের কোনো কারণ হতে পারে না, কারণ ভারত জেগে উঠছে।
ভারতের মধ্যেই ভারতের ‘আত্মা’ প্রকাশের বিরোধিতা করা কোনো নতুন বিষয় নয়। স্বাধীনতার পরে জুনাগড় রাজ্য ভারতের মধ্যে বিলীন হয়ে যাওয়ার কাজটি সম্পন্ন করার পর ভারতের তদানীন্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল সোমনাথ গিয়েছিলেন। সোমনাথ মন্দির ১২টি জ্যোতির্লিঙ্গের অন্যতম মন্দির। তিনি এই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখে গভীরভাবে ব্যথিত হয়েছিলেন। যেহেতু দেশ ইতিপূর্বেই স্বাধীনতা পেয়েছে সেজন্য তিনি মনের মধ্যে ভারতের এই গর্বের স্থানটি পুনরুদ্ধারের সংকল্প করেছিলেন। এই পুনরুদ্ধারের কাজের দায়িত্ব তিনি কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভার সদস কে এল মুন্সীকে অর্পণ করেছিলেন। সর্দার যখন মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে এই সমস্ত তথ্য নিয়ে আলোচনার করেন, তখন গান্ধীজী এটি নীতিগতভাবে সমর্থন করেছিলেন। তবে তিনি শর্ত দেন যে, মন্দিরের পুনর্নির্মাণ সরকারি অর্থের সাহায্যে না হয়ে জনগণের দ্বারা সংগৃহীত তহবিলের মাধ্যমে হবে। এই প্রস্তাব সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত হয়। তৎকালীন ভারতের প্রথম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ এই মন্দিরের দ্বারোদঘাটন করেন। সেই অনুষ্ঠানে ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদের বক্তব্য উল্লেখযোগ্য।
কিন্তু পণ্ডিত নেহর এতে ঘোরতর আপত্তি জানান। তিনি এটাকে হিন্দুর। পুনরুত্থান (Hindu revivalism) বলে বিরোধিতা করেন। যদিও সর্দার প্যাটেল, কে এল মুন্সী, ড. রাজেন্দ্রপ্রসাদ ও মহাত্মা গান্ধী সোমনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণকে ভারতের গৌরব পুনরুদ্ধার হিসেবে দেখেছিলেন। এই ঘটনায় স্পষ্ট যে, ভারতের আত্মাকে অস্বীকার করা, তাকে প্রকাশে হতে না দেওয়া ইত্যাদি বিরোধিতা তখনও ছিল। এর জন্য সুসংহত প্রয়াস করা হয়েছিল। তবে সে সময় কংগ্রেসের রাষ্ট্রীয় বিচারধারা মনোভাবাপন্ন। প্রচুর লোক ছিলেন, সেজন্য মন্দির পুর্নির্মাণের কাজটি সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিল। পরে ক্রমশ যোজনাবদ্ধ পদ্ধতিতে রাষ্ট্রীয় বিচাসম্পন্ন নেতৃত্বকে প্রান্তিক করা হচ্ছিল এবং কংগ্রেসের মধ্যে বামপন্থী ভাবধারার প্রভাব বৃদ্ধি পাচ্ছিল। কমিউনিজম আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাস করে না শুধু নয়, তারা ‘রাষ্ট্র’ভাবনাকে গ্রহণই করেনি। কমিউনিজম প্রকারান্তরে পুঁজিবাদের মতো এক ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রতিনিধি। প্রথমে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং এখন চীন এই সম্প্রসারণবাদী ও সর্বগ্রাসী মানসিকতার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। বামপন্থীরা ভারতের ‘আত্মা’কে বুঝতে অসমর্থ বা ইচ্ছাকৃত ভাবে এর বিরোধিতা করছে যাতে এই দেশটি এক সূত্রে গ্রথিত না হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে দুর্বলভাবে হয়ে পড়ে।
তাহলে বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের আশু কর্তব্য কী? ১৯০৪ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুস্পষ্ট ও দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাঁর স্বদেশী সমাজ’ প্রবন্ধে একটি রূপরেখা এঁকেছেন। এটা সত্য যে তিনি জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে ছিলেন। এর কারণ পশ্চিমি উপনিবেশবাদ ও বিশ্বযুদ্ধের পরিণতি। স্বদেশী সমাজ’ নিবন্ধে তিনি ভারতের আত্মা ও জাতীয়তার প্রতি তার পক্ষপাত তিনি প্রমাণিত করেছেন। এতে তিনি লিখেছেন— “আজ আমরা ইহা উত্তমরূপেই বুঝিয়াছি যে, তফাতে গা-ঢাকা দিয়া বসিয়া থাকাকেই আত্মরক্ষা বলে না। নিজের অন্তর্নিহিত শক্তিকে সর্বতোভাবে জাগ্রত করা, চালনা করাই আত্মরক্ষার প্রকৃত উপায়। ইহা বিধাতার বিধান।ইংরাজ ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের চিত্তকে অভিভূত করিবেই যতক্ষণ আমাদের চিত্ত জড়ত্ব ত্যাগ করিয়া তাহার নিজের উদ্যমকে কাজে না লাগাইবে। সকল বিষয়ে ইংরাজের অনুকরণ করিয়া ছদ্মবেশ পরিয়া বাঁচিবার যে চেষ্টা তাহাও নিজেকে ভোলানো মাত্র। আমরা প্রকৃত ইংরাজ হইতে পারিব না, নকল ইংরাজ হইয়াও আমরা ইংরাজকে ঠেকাইতে পারিব না।
আমাদের বুদ্ধি, আমাদের হৃদয়, আমাদের রুচি যে প্রতিদিন জলের দরে বিকাইয়া যাইতেছে তাহা প্রতিরোধ করিবার একমাত্র উ পায় — আমরা নিজে যাহা তাহাই সজ্ঞানভাবে, সবলভাবে, সম্পূর্ণভাবে হইয়া উঠা।
… আমাদের দেশে তাপসেরা তপস্যার দ্বারা যে শক্তি সঞ্চয় করিয়া গিয়াছেন তাহা মহামূল্য, বিধাতা তাহাকে নিষ্ফল করিবেন না। সেইজন্য উপযুক্ত সময়েই তিনি নিশ্চেষ্ট ভারতকে সুকঠিন পীড়নের দ্বারা জাগ্রত করিয়াছেন।
বহুর মধ্যে ঐক্য-উপলব্ধি, বিচিত্রের মধ্যে ঐক্যস্থাপন—ইহাই ভারতবর্ষের অন্তর্নিহিত ধর্ম। ভারতবর্ষ পার্থক্যকে বিরোধ বলিয়া জানে না, সে পরকে শত্রু বলিয়া কল্পনা করে না। এই জন্যই ত্যাগ না করিয়া, বিনাশ না করিয়া, একটি বৃহৎ ব্যবস্থার মধ্যে সকলকেই সে স্থান দিতে চায়। এই জন্য সকল পন্থাকেই সে স্বীকার করে, স্বস্থানে সকলেরই মাহাত্ম্য সে দেখিতে পায়।
ভারতবর্ষের এই গুণ থাকাতে, কোনো সমাজকে আমাদের বিরোধী কল্পনা করিয়া আমরা ভীত হইব না। প্রত্যেক নব নব সংঘাতে অবশেষে আমরা আমাদের বিস্তারেরই প্রত্যাশা করিব। হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিস্টান ভারতবর্ষের ক্ষেত্রে পরস্পর লড়াই করিয়া মরিবে না— এইখানে তাহারা একটা সামঞ্জস্য খুঁজিয়া পাইবে। সেই সামঞ্জস্য অহিন্দু হইবে না, তাহা বিশেষভাবে হিন্দু। তাহার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যতই দেশ-বিদেশের হউক, তাহার প্রাণ, তাহার আত্মা ভারতবর্ষের।
আমরা ভারতবর্ষের বিধাতৃনির্দিষ্ট এই নিয়োগটি যদি স্মরণ করি তবে আমাদের লক্ষ্য। স্থির হইবে, লজ্জা দূর হইবে, ভারতবর্ষের মধ্যে যে একটি মৃত্যুহীন শক্তি আছে তাহার সন্ধান পাইব। আমাদিগকেইহা মনে রাখিতেই হইবে যে, য়ুরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞানকে যে চিরকালই আমরা শুদ্ধমাত্র ছাত্রের মতো গ্রহণ করিব তাহা নহে, ভারতবর্ষের সরস্বতী জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমস্ত দল ও দলাদলিকে একটি শতদল পদ্মের মধ্যে বিকশিত করিয়া তুলিবেন— তাহাদের খণ্ডতা দুর করিবেন।
ঐক্যসাধনাই ভারতবর্ষীয় প্রতিভার প্রধান কাজ। ভারতবর্ষ কাহাকেও ত্যাগ করিবার, কাহাকেও দূরে রাখিবার পক্ষে নহে। ভারতবর্ষ সকলকেই স্বীকার করিবার, গ্রহণ করিবার, বিরাট একের মধ্যে সকলেরই স্ব স্ব প্রধান প্রতিষ্ঠা উপলব্ধি করিবার পন্থা এই বিবাদনিরত ব্যবধানসংকুল পৃথিবীর সম্মুখে একদিন নির্দেশ করিয়া দিবে।
সেই সুমহৎ দিন আসিবার পূর্বে—‘একবার তোরা মা বলিয়া ডাক! যে একমাত্র মা দেশের প্রত্যেককে কাছে টানিবার, অনৈক্য ঘুচাইবার, রক্ষা করিবার জন্য নিয়ত ব্যাপৃত রহিয়াছেন—যিনি আপন ভাণ্ডারের চিরসঞ্চিত জ্ঞানধর্ম নানা আকারে নানা উপলক্ষ্যে আমাদের প্রত্যেকেরই অন্তঃকরণেরমধ্যে অশ্রান্তভাবেসঞ্চার করিয়া আমাদের চিত্তকে সুদীর্ঘ পরাধীনতার নিশীথরাত্রে বিনাশ হইতে রক্ষা করিয়া আসিয়াছেন—মদোদ্ধত ধনীর ভিক্ষশালার প্রান্তে তাঁহার একটুখানি স্থান করিয়া দিবার জন্য প্রাণপণ চীৎকার না করিয়া, দেশের মধ্যস্থলে সন্তানপরিবৃত যজ্ঞশালায় তাঁহাকে প্রত্যক্ষ উপলব্ধি করো।”
ভারতের আত্মাকে জাগ্রত করে ভারতের আত্মপ্রকাশের সময় এসেছে। এই প্রক্রিয়া ঈশ্বরের পরিকল্পনা এবং তাঁর আশীর্বাদে শুরু হয়ে গেছে। ভারতবিরোধী বিদেশি শক্তি ভারতের এই আত্মাকে অস্বীকার করার যতই প্রচেষ্টা করুক না কেন তা ব্যর্থ হবে। কারণ ভারতের জনগণের সংকল্প এখন দৃঢ় হয়েছে। ভারতের জাতীয়তা জাগ্রত করার বিশ্বজুড়ে এই কর্মকাণ্ডকে কয়েক দশক ধরে কয়েক প্রজন্ম খ্যাতি ও প্রশংসা থেকে দুরে থেকে ‘বিশ্ব মঙ্গলের সাধনায় আমরা এক নীরব পূজারি’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বিশ্ব মঙ্গল সাধনার পূজারিদের এই তপস্যা ও পরিশ্রম সফল হবেই।
ভারতের আত্মাকে শক্তি ও গৌরবের সঙ্গে পুনস্থাপিত করার এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে সমস্ত ভারতবাসী তাদের রাজনীতি ও অন্য সব স্বার্থ একধারে রেখে দিয়ে একতার পরিচয় দিন এবং স্বাভিমানী আত্মনির্ভর ভারত নির্মাণে সহভাগী হন— এটাই প্রার্থনা।
ড. মনমোহন বৈদ্য
(লেখক রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের সহ-সরকাৰ্যবাহ। ভাষান্তর রিঙ্কু রায়)