আগস্ট মাসের ৫ তারিখ শুধুমাত্র রামমন্দিরের জন্যই নয়‚ এছাড়াও বিভিন্ন কারণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট‚ অর্থাৎ যেদিন ভারত ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীন নয়‚ সেইদিনই সে সমস্ত ধরনের ঔপনিবেশিক বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারতো। আর বহু শতাব্দী পূর্বে বিদেশী হানাদারদের হাতে পরাধীন হওয়ার পূর্বকালীন জাতীয়তাবোধের ধারণা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে পারত।
কিন্তুক দুর্ভাগ্যবশত তা হয়নি। আমাদের শেখানো হয়েছিল যে ভারত কখনোই কোনো জাতি ছিলো না। ব্রিটিশরাই নাকি আমাদের একটি জাতিতে পরিণত করে আর নেহেরু তাতে নতুন ধারণা যোগ করেছিলেন। এইজন্যই নাকি এখন আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারছি। এই অদ্ভুত যুক্তির সাহায্যেই আমাদের ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছিল জ্ঞান-বিজ্ঞান-ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে তৈরী হওয়া বিগত ৮০০০ বছরের গৌরবময় ইতিহাস।
স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের জন্য ৫ই আগস্ট চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে নিম্নলিখিত কারণগুলির জন্যে-
১) পূর্বের রাম মন্দিরটি যেখানে ধ্বংস করা হয়েছিল সেখানেই এটির পুননির্মান হওয়া।
২) ভারতের সুপ্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সম্পর্কে আমাদের গর্ব ফিরিয়ে আনা।
৩) আমাদের ইতিহাস খুঁজে বের করা ও তার ব্যাখ্যা করার অধিকার ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিক ও তাদের অনুগামী মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়া।
৪) আমাদের মনের উপর চাপিয়ে দেওয়া ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণা থেকে মুক্ত হওয়া।
আপনি যদি মথুরায় যান তো দেখতে পাবেন কৃষ্ণজন্মভূমি মন্দিরটি ধ্বংস করে আওরঙ্গজেব কিভাবে একটি বিশালাকার মসজিদ বানিয়ে রেখেছে। কৃষ্ণের জন্মস্থান সেই মসজিদের তলাতেই চাপা পড়ে আছে। আপনি কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে যান। সেখানে আপনি অহল্যাবাই হোলকারের দ্বারা পুননির্মিত পবিত্র জ্যোতির্লিঙ্গকে তো দেখবেনই‚ সাথে পবিত্র নন্দী ষাঁড়টিকেও দেখবেন যে অসহায়ের মতো সেইদিকে তাকিয়ে আছে যেখানে আছে মূল শিবলিঙ্গটি ছিলো‚ মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব বহু আগেই যাকে ভেঙ্গে মসজিদ বানিয়ে দিয়েছে। এইসব দেখে আপনার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতে বাধ্য।
মোগলদের হাতে ধ্বংস হওয়া রামজন্মভূমি মন্দিরের পুনরুদ্ধারের জন্য হিন্দুরা বিগত ৪৯২ বছর ধরে লড়াই চালিয়ে আসছে। আইনী লড়াই ছাড়াও‚ এই সংগ্রামে আমরা দীর্ঘকালীন গণআন্দোলন দেখেছি। অন্য কোনো সংগ্রাম‚ এমনকি স্বাধীনতা সংগ্রামেও এই ধরনের ধারাবাহিকতা লক্ষ্য করা যায়নি।
লাখ লাখ মানুষ রাস্তায় নেমে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন করে ১৯৮৬ সালে যে লড়াইয়ের সূচনা করেছিল‚ ২০২০ সালে এসে তা সমাপ্ত হচ্ছে। আদালতে আইনী লড়াইয়ের চরম পর্যায়ে উপনীত হওয়ার আগে তা বিভিন্ন পর্যায়ে টিকে ছিলো ৩০ বছর ধরে। মন্দিরটির পুনঃস্থাপনের জন্যে হিন্দু সমাজের এই আন্দোলন জাত-বর্ণ‚ ধনী-দরিদ্র‚ আর্য্যাবর্ত-দাক্ষিণাত্য সহ আপামর ভারতবাসীর লড়াই হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এবং অবশেষে তারা বিজয়ী হয়েছে।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের পেছনে অনেকগুলো কারণ ছিলো। যখন সমস্ত কারণগুলো একসাথে মিশে গেল তখনই আমরা স্বাধীনতা পেলাম। কিন্তু এই জয়ের জন্য আমাদের অনেক বড়সড় মূল্য দিতে হয়েছে‚ আমাদের দেশের এক তৃতীয়াংশ ভূখন্ড ও বহু মানুষের জীবনের বিনিময়ে এসেছে এই জয়। ভারত ছেড়ে যাওয়ার সময় ব্রিটিশদের দেওয়া আঘাতের ফলে এখনো আমাদের রক্ত ঝড়ছে। ঔপনিবেশিক আইনব্যস্থা ও শ্রীরামচন্দ্রের সম্পর্কে তাদের মতামত উপেক্ষা করেই হিন্দুরা নিজেদের লড়াই চালিয়ে যায় ও ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার সমস্ত ধরনের প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গিয়ে তারা জয়লাভ করে। বামপন্থী বা সেকুলারদের হিন্দু বিরোধী মতামত মানুষ মেনে নেয়নি বা কাশী মথুরাতে মন্দির ধ্বংস করে তৈরী মন্দির দেখে হতাশায় হতোদ্যমও হয়ে পড়েনি।
ঔপনিবেশিক ঐতিহাসিক ও তাদের অনুগামীদের তৈরী করা গল্প অনুযায়ী এইদেশে হিন্দুদের কোনো গৌরবময় ইতিহাস ছিলো না। বরং ভারত ছিলো অসংখ্য গোঁড়া ধর্মান্ধ‚ বর্ণবাদী, মূর্খ ও কুসংস্কারগ্রস্থ মানুষের প্রাকৃতিক আবাসস্থল। তাদের নিজেদের না আছে কোনো জ্ঞান‚ না আছে কোনো ইতিহাস – যাকে তারা নিজেদের বলে দাবি করতে পারে। এইধরণের মতামতের প্রচারের মূল উদ্দেশ্য ছিলো ভারতীয়দের থেকে তাদের আত্মসম্মান‚ অহংকার ও জ্ঞানবিজ্ঞানকে ভুলিয়ে দিয়ে তাদের হীনমন্যতায় ডুবিয়ে দেওয়া।
ভারতীয় দর্শন‚ কলা ও বিজ্ঞানের প্রতিটি সম্ভাব্য শাখার সমস্ত জ্ঞান হয় ধ্বংস করা হয়েছে নয়তো তার ভারতীয় শিকড়কে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। মুসলমান হানাদাররা তাদের নাগালের মধ্যে থাকা অসংখ্য বিশ্ববিদ্যালয়, মন্দির এবং জ্ঞানচর্চার পথকে ধ্বংস করে দিয়েছিলো। ধ্বংস করেছিলো আমাদের আরাধ্য মূর্তিগুলোকে‚ যাতে আমাদের আত্মবিশ্বাস নষ্ট হয়ে যায়। জানা যায় যে‚ নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় পুড়িয়ে দেওয়ার পরেও‚তক্ষশিলা এবং বিক্রমশিলাকে ধ্বংস করার পরেও এবং অসংখ্য মন্দিরের গ্রন্থাগার পুড়িয়ে দেওয়ার পরেও সংস্কৃত‚ পালি ও প্রাকৃত ভাষায় লেখা ৩ মিলিয়ন পুঁথি এখনো রয়ে গেছে। প্রাক ঔপনিবেশিক ভারতের জ্ঞানচর্চার ব্যাপ্তি ও গভীরতা সম্পর্কে ভালোভাবেই ধারার পাওয়া যায় এই তথ্য থেকে।
মুসলমান হানাদারদের হাতে আমাদের অর্থনীতির যে ধ্বংসের সূচনা হয়েছিল ব্রিটিশদের হাতে তা আরও শৈল্পিক হয়ে ওঠে। আমাদের নিঃস্ব করে তারা সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছিলো। যখন ব্রিটিশরা আমাদের তরফ থেকে বিপদের আভাস পেলো‚ তারা কেরানি তৈরির শিক্ষায় শিক্ষিত কিছু বাদামী চামড়ার সাহেব তৈরী করে দিয়েছিলো‚ যাদের কাছে ভারতীয়রা ছিলো মেধাহীন এক পিছিয়ে পড়া‚ অশিক্ষিত‚ বর্ণবাদী সমাজ। আমাদের বলা হতো কালীদাস হলেন ভারতের শেক্সপিয়ার‚ অথচ কালিদাস জন্মেছিলেন শেক্সপিয়ারের বহু শতাব্দী পূর্বে। আমাদের বলা হয়েছিল চাণক্য হলেন ভারতের মেকিয়াভেলি‚ কিন্তু চাণক্য যখন রাষ্ট্রনীতির ভেলকি দেখাচ্ছেন‚ মেকিয়াভেলির জন্মাতে তখন কয়েক হাজার বছর বাকি। এবং আমরা তাদের কথা মেনেও নিয়েছি।
রামমন্দিরের এই পুননির্মাণ অনেক ভুলে যাওয়া স্মৃতিকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। ইসলামী আগ্রাসন ও অত্যাচারের বহু স্মৃতি মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকরা আমাদেরকে ভুলিয়ে দিয়েছে। ভুলিয়ে দিয়েছে আমাদের সেই জাতীয় পরিচয়‚ যা যেকোনো ভারতীয়কেই গর্বিত করে তুলবে। সেইসব ভুলিয়ে দেওয়া ইতিহাস ও পরিচয়ও মানুষের মনে জেগে উঠতে শুরু করেছে এই রামমন্দির আন্দোলনের ফলে।
হঠাৎ করেই‚ বিভিন্ন মন্দির ও তাদের ইতিহাস আমাদের যুবকদের জন্য আকর্ষণ ও বিষ্ময়ের কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। তাজমহলই ভারতের একমাত্র বিষ্ময় নয়। এমন বিষ্ময় ভারতে হাজার হাজার আছে। ভারতীয়রা আবিষ্কার করেছে কিভাবে তাদের মন্দিরগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল‚ লুঠ করা হয়েছিল‚ সাধারণ মানুষদের ধর্মান্তকরণ ও হিন্দু মহিলাদের ধর্ষন করা হয়েছিলো। এই ইতিহাসগুলোকে ভুলিয়ে দিতে চায় বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ ঐতিহাসিকরা। রামমন্দির পুনরুদ্ধারের আন্দোলন এইভাবেই ক্রমশ আমাদের আত্মপরিচয় পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে পরিণত হয়েছিলো।
গরিমা পুনরুদ্ধারের এই সংগ্রাম কখনোই কারও বিরুদ্ধে ছিল না, এটি ছিল আমাদের জমি ও আমাদের ইতিহাসের উপর নিজেদের অধিকার পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম। এই দীর্ঘমেয়াদি আমাদের বাধ্য করেছিলো ঔরঙ্গজেব ও টিপু সুলতানের আসল চেহারা খুঁজে বার করতে। টুপি সেলাই করে দিন গুজরান করা যে ঔরঙ্গজেবের ছবি আমাদের দেখানো হয় তার আসল কার্যকলাপ খুঁজে বার করতে। যেসব নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকরা ঔপনিবেশিক ও মার্ক্সবাদী ইতিহাসচর্চা না করতে চাওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে নিষিদ্ধ হয়েছিল‚ ধর্মপালের মতো সেইসব নিঃস্বার্থ গবেষক এবং বুদ্ধিজীবীদের ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। তরুন ঐতিহাসিকরা আমাদের ইতিহাসের শূন্যস্থানগুলি পূরণ করার জন্য প্রাণপণ খেটে গেছেন যাতে আমাদের ইতিহাস পুনরুদ্ধার ও ঐতিহ্যগুলিকে চিহ্নিত করা যায় এবং ব্রিটিশ আর তাদের ধামাধারী মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকদের তথ্যসমৃদ্ধ বিরোধিতা করে তাদের ভুল দেখিয়ে দেওয়া যায়। আর্য আক্রমণ তত্ত্বের বিরোধিতা প্রথম করেছিলেন যে ভারতীয়‚ তিনি হলেন বাবা সাহেব আম্বেদকর। তাকে এতদিন যেভাবে চিনিয়ে এসেছে নেহেরুভিয়ান ঐতিহাসিকরা‚ তা সরিয়ে আম্বেদকরকেও পুনরাবিষ্কার করা হয়েছে।
এইযে বৌদ্ধিক নবজাগরণ আমরা দেখতে পাচ্ছি‚ তারও পেছনে আছে রামমন্দির আন্দোলন। আর ঠিক এই কারণেই সমস্ত বামপন্থী ও সেকুলাররা এই আন্দোলনের বিরোধী ছিলো। এই আন্দোলনের ফলাফল তারা খুব ভালো করেই বুঝেছিলো। যেকারনে
আরএসএস আবার হয়ে উঠেছিল বামপন্থী বা লিবারেলদের ঘৃনার মূল লক্ষ্য। আরএসএস শুধুমাত্র এই পরিস্থিতিকে তৈরীই করেনি‚ বরং সম্পূর্ণ প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে গেছে ইতিহাস এবং ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার
করার কাজটি পূর্বোক্ত গোষ্ঠীটির থেকে ছিনিয়ে নিতে।
জ্ঞানের জন্য এই মন্থন অবশেষে আমাদের মনকে ঔপনিবেশিক ধ্যানধারণা থেকে মুক্ত করতে পেরেছে। এর আগে বিবেকানন্দ থেকে শুরু করে বহু নেতৃত্বই চেষ্টা করেছিলেন আমাদের মনের অব-ঔপনিবেশীকরণ করতে। তখন থেকেই ক্রমাগত এই প্রচেষ্টা চলে আসছে। কিন্তু তবে আদর্শিক বিরোধীদের একটা বড় সুবিধা ছিল যে‚ ব্রিটিশ আমল থেকেই ব্রিটিশদের শেখানো সফল কৌশলগুলি নেহেরু ও তার অনুগামীরা ব্যবহার করতে পারতো। তারা এই বৌদ্ধিক লড়াই মার্ক্সবাদী ঐতিহাসিকদের কাছে হস্তান্তর করে দেয় ও প্রয়োজনীয় ন্যারেটিভ নির্মানের যথাযথ তথ্যভান্ডার তাদের হাতে তুলে দেয়। অপরদিকে ভারতের মাটিতে শিকড়যুক্ত ঐতিহাসিকরা এই অভিজাত ক্ষমতাবলয়ের বাইরে পড়ে অবহেলিতই থেকে যায়। প্রয়োজনীয় তথ্যও তারা কখনোই পেতো না।
সৌভাগ্যক্রমে এখানেই এগিয়ে আসে আরএসএস ও মদন মোহন মালব্য, ডাঃ আম্বেদকর, কে এম মুন্সী, রাজা গোপালচারী সহ আরও অনেক মহান ব্যক্তি‚ যারা এই জ্ঞানের শিখাটিকে সঠিক সময়ের জন্যে প্রজ্বলিত রেখেছিলেন।
প্রবীণ আরএসএসের চিন্তাবিদ রঙ্গ হরি বলেছেন যে‚ আপনার দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর করে আপনি কোথায় দাঁড়িয়ে আছেন তার উপরে। গ্রীনিচের সময় ভিত্তিক পাশ্চাত্য অবস্থান থেকে উজ্জ্বয়িনীর সময় ভিত্তিক ভারতীয় অবস্থানে পরিবর্তিত হতে মহাকালের অনেক বছর লেগে যায়। আর অবস্থান পালটালে দৃষ্টিভঙ্গিও পালটাতে বাধ্য। এখন দৃষ্টিভঙ্গীটি রামমন্দিরের দ্বারা নির্ধারিত হবে। ভারতীয় মননের অব-ঔপনিবেশীকরণ হওয়ার এটাই হলো সঠিক সময়। ভারত তার অতীত সম্পর্কে বা তার গৌরব ফিরে পাওয়ার জন্য যে পথ বেছে নিয়েছিল সে সম্পর্কে আর লজ্জিত হবে বা বা কোনো ক্ষমা প্রার্থনাও করবে না।