আমন ধানঃ আমন ধানে দ্বিতীয় দফায় চাপান সার নাইট্রোজেন প্রয়োগ করা না হয়ে থাকলে ধানের বয়স ৪০ থেকে ৫০ দিনের মধ্যে হলে বা গাছে কাঁচা-থোড় আসার সময়ে তা প্রয়োগ করুন। রোগ-পোকার তীব্রতা অনুযায়ী আশ্বিনমাসে আমনধানে দমন ব্যবস্থা নিন। এই সময় মাজরাপোকা, পাতা মোড়ানো পোকা, ধানের বিয়ান ছাড়ার সময় ভেঁপু পোকা, বাদামি শোষক পোকা, গন্ধীপোকা, যে সমস্ত স্থানে জল দাঁড়ায় সেখানে চুঙ্গিপোকা, খরা প্রবণ এলাকায় ডাঙ্গা জমিতে দৈয়ে পোকা দেখা দেয়। এছাড়া ধানের ঘোড় দশায় ও ফলন্ত গাছে ঝলসা রোগ, পাশকাঠি থেকে থোড় আসা অবস্থায় চিটে বা বাদামি দাগ রোগ, টুংরো রোগ, খোলাপচা রোগ, ভিজে আবহাওয়ায় ব্যাক্টেরিয়া জনিত ধ্বসা রোগ দেখা দিতে পারে। যথাযথ ব্যবস্থা নিন।
জারবেরা ফুল ঃ আশ্বিনমাসে অর্থাৎ বর্ষার শেষে পলি হাউসে জারবেরা লাগানো যাবে। টিস্যুকালচার পদ্ধতিতে তৈরি চারাই উত্তম। চারা রোপিত হবে ৪০x৩০ সেমি কিংবা ৩০x৩০ সেমি দূরত্বে; এইভাবে পলি-হাউসে প্রতি হাজার বর্গমিটারে ছয় হাজার চারা লাগবে। পশ্চিমবঙ্গের জন্য ডাবল জাতের জারবেরা লাগানো উচিত; যেমন – রোজালিন, ভ্যানালিন, প্রাইমারো, স্যাগ্রিয়া, স্যাজাও, কোবানা, স্যালভেডর, পিঙ্ক এলিগেন্স, রুবি রেড, গ্যালিয়েথ ইত্যাদি।
পলিহাউসের মাটি শোধন করার জন্য ৪ শতাংশ ফরমালডিহাইড মিশ্রণ প্রয়োগ করতে হবে। ফরম্যালডিহাউড ব্যবহারের পর পলিথিনে কয়েকদিন ঢেকে রাখার পর সেচের জলে মাটির রসায়ন বার করে দিতে হবে। এরপর মাটি চাষের জন্য তৈরি করে নিতে হবে। জমি তৈরির জন্য লাগবে হেক্টর প্রতি ২.৫ টন নিম কেক, ১৬ কেজি ফসফরাস আর ২০ কেজি ম্যাগনেসিয়াম সালফেট। পরে চাপান সার হিসাবে ক্যালসিয়াম অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট আর মিউরিয়েট অফ পটাশ (৫ঃ৩) গাছপ্রতি ২.৫ গ্রাম। হাজার বর্গ মিটারের পলি হাউসে জারবেরা লাগিয়ে তিন বছরে নিট লাভ প্রায় তেরো লক্ষ টাকা আসা অসম্ভব নয়।
গ্ল্যাডিওলাস ঃ আশ্বিন-কার্তিক মাস গ্যাডিওলাসের কন্দ লাগানোরও সময়। বিঘা প্রতি কন্দ লাগবে পঁচিশ হাজার, কন্দ রোপণ করা হবে ২০x২০ সেন্টিমিটার দূরত্বে। গ্ল্যাডিওলাসের উন্নত জাত হল আমেরিকান বিউটি, মেলোডি, ভিঙ্কস গ্লোরী, ট্রপিক সী, অগ্নিরেখা, সুচিত্রা, মোহিনী, শোভা, মনীষা, স্বপ্না, অপ্সরা, পুনম, মুক্তা ইত্যাদি। গ্ল্যাডিওলাসের জমি তৈরি করতে বিঘা প্রতি ১৫-২০ বস্তা গোবরসার আর ২৫-৩০ কেজি সরষের খোল প্রয়োগ করতে হবে। শেষচাষের সময় দিতে হবে ১০, ২০ এবং ৬ কেজি হারে নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ। গ্ল্যাডিওলাস চাষ করে বিঘা প্রতি ৬৫ হাজার টাকা নিট লাভ হতে পারে।
গাঁদা ঃ আশ্বিনমাস শীতকালীন গাঁদা লাগানোরও সময়। এ মাসের প্রথমেই বীজ ফেলুন অথবা আগের মা-গাছের ৭-৮ সেন্টিমিটার ডগা কেটে চারা তৈরি করে নিন। বীজের চারা একমাস বয়স হলে মূল জমিতে লাগান। চারা লাগাতে হবে ৪৫x৪৫ অথবা ৬০x৬০ সেন্টিমিটার দুরত্বে। আফ্রিকান গাঁদার উন্নত জাতগুলি হল পুসাবাসন্তী, পুসানারাঙ্গি, গোল্ড কয়েন, ইয়েলো কয়েন ইত্যাদি; এছাড়া হাইব্রিড ইনকা এবং রক্তগাঁদার নানান জাত। গাঁদার জমি তৈরি করতে বিঘা প্রতি ১০-১২ বস্তা গোবর সার, ২০ কেজি খোল, ১০ কেজি করে ইউরিয়া, সিঙ্গল সুপার ফসফেট ও মিউরিয়েট পটাশ সার দিতে হবে। পরে চাপান সার হিসাবে এক বা দু’বার ইউরিয়া প্রয়োগ করতে হবে।
শাঁকালু : আশ্বিনমাসের প্রথমার্ধ শাঁকালুর বীজ বোনার আদর্শ সময়। এইসময় বীজ ফেললে উপযোগী উষ্ণতা ও আর্দ্রতার কারণে শাঁকালুর লতার ঠিকমতো ওজন বাড়ে। অনেকে ভাদ্রমাস থেকেই শাঁকালু বোনার কাজ শুরু করলেও, দেখা যায়, জলদি বুনলে অঙ্গজ বৃদ্ধি বেশি হয়, আবার অগ্রহায়ণ মাসে বুনলে তারপর শীত পরে যাওয়ায় অঙ্গজ বৃদ্ধি বাধা পায়। তবে শাঁকালুর বীজ উৎপাদন করতে হলে বোনার সময় দু-এক মাস এগিয়ে আনতে হবে। ৩০x৩০ সেন্টিমিটার দূরত্বে ২ সেন্টিমিটার গভীরতায় বীজ বুনতে হবে। মাঝারি সাইজের কন্দ নিতে হলে দূরত্ব ১৫x১৫ সেন্টিমিটার রাখতে হবে। হেক্টরে বীজ লাগবে ২০-৬০ কেজি। শাঁকালুর উন্নত জাত হল রাজেন্দ্র মিসরিক-১ (ফলন ক্ষমতা হেক্টরে ৪০-৫৫ টন, ফসল দৈর্ঘ্য ১১০-১৪০ দিন, কন্দের ওজন ০.৬-০.৭ কেজি, কন্দ ফাটার সমস্যা নেই)।
মিষ্টি আলু ঃ আশ্বিন-কার্তিক মাস মিষ্টি আলুর লতা বসানোর প্রকৃষ্ট সময়। আগে লাগালে ফসলের বৃদ্ধি বেশি হয়ে ফলন কমে, দেরিতে লাগালে উইভিল পোকার আক্রমণ বাড়ে। জমি তৈরির জন্য বিঘা প্রতি ২০ কুইন্টাল গোবর সার, ১৫ কেজি ইউরিয়া, ২৩ কেজি সিঙ্গল সুপার ফসফেট ও ২০ কেজি মিউরিয়েট অফ পটাশ দিতে হবে। লতা ব্যাভিস্টিনের দ্রবণে (লিটারে ১ গ্রাম) শোধন করা উচিত। মিষ্টিআলুর উন্নত জাতগুলি হল : বিধান জগন্নাথ, শ্রীভদ্র, পুসা সফেদ, কালমেঘ, সম্রাট, শঙ্কর প্রভৃতি হালকা হলুদ বা সাদা শাঁসের আলু; কমলা সুন্দরি; গৌরী প্রভৃতি কমলা শাঁসের আলু, এস.টি-১৩, ক্রশ-৪ প্রভৃতি বেগুনি শাঁসের আলু। বিঘাতে দশ-এগারো হাজার লতার কাটিং বসাতে হবে। লতার ডগার টুকরোর দৈর্ঘ্য হবে ২০ সেন্টিমিটার, লতার ২-৩টি পর্ব বা গাঁট মাটির নীচে পুঁতে দিতে হবে। ৬০x২০ সেন্টিমিটার দূরত্বে লতা বসানো উচিত। লতা বসিয়ে ৩০-৩৫ দিন পর সারিতে চাপান সার সহ মাটির ভেলি তুলে দিতে হবে।
পান ঃ আশ্বিনমাস পান লাগানোর উপযুক্ত সময়, পান কার্তিক মাসেও লাগানো চলবে। পানের উন্নত জাত হচ্ছেঃ কালীঢল, বেনারসি, ভবানী প্রভৃতি বাংলা পান; এছাড়া সাঁচী ও মিঠাপান। পানের লতা শোধন করে লাগাতে হবে। বোরোজের মাটিও ফরমালিন দিয়ে পলিথিন ঢেকে শোধন করা দরকার। মাটির ক্ষারাম্লমান ৭-এর কাছে হলেই ভাল। বরোজের উচ্চতা সামান্য একটু বেশি হলে জল জমে পানের পচন হবে না। পানের চারা বা লতা লাগানো হবে ভাটি বা পিলিতে ৬০-৬৫x১৫ সেন্টিমিটার দূরত্বে।
আলু : আশ্বিনমাসে জলদি আলু লাগানোর আদর্শ সময়। ভাদ্রমাসে এই নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
শীতকালীন সবজিঃ গাজর, ফুলকপি, বীট, ওলকপি, পেঁয়াজ, রসুন, মটরপুঁটি, টমেটো, মেথিশাক, ফরাসী বিন প্রভৃতি ফসল এই মাস থেকে বোনা বা রোপণ করা যাবে।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী