ঔপনিবেশিক ভারতকে কেন্দ্র করে এই মুহুর্তের সবচেয়ে সাহসী নাটক ‘হে মৃত্যুঞ্জয়’। মহারাষ্ট্রের একটি নাট্যদলের উদ্যোগে প্রদর্শিত এই যগান্তকারী নাটকে বীর সাভারকরের জীবন ও আন্দামানে সেলুলার জেলে কাটানো দিনগুলি প্রদর্শিত হচ্ছে। ১৯১১ আর ২০১৯ এর মধ্যে সেতুবন্ধন করছে এই নাটক। দিল্লিতে প্রদর্শিত এই নাটক সংস্কৃতি ঐতিহ্য ও মতাদর্শ গত ভাবে এক শ্রেণীর মানুষকে নাড়িয়ে দিয়েছে। জটিল এক বাস্তব অতি সহজে তুলে ধরা হয়েছে ও সাভারকরের জীবন প্রদর্শিত করা হয়েছে। উচ্চ নান্দনিক সৌন্দর্যের বদলে সহজ সরল পরিবেশনের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। নাম হে মৃত্যুঞ্জয় হলেও মৃত্যু এখানে একটি চরিত্র হিসেবে প্রতিফলিত হয়েছে।
জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অনামিকার প্রযোজনায় ABVP এর উদ্যোগে নাটকটি হয়। নাটকে বাঙালি জেলবন্দি ইন্দুভূষণ রায়ের গলায় হে মৃত্যুঞ্জয় গানটি শুরু হলে তুমুল হর্ষধ্বনি ওঠে। সাভারকর নিজেও গানের সাথে গলা মেলান। এই সময়ে তাদের মুখে ভয়ের অভিব্যক্তি দেখা দিতে শুরু করে। এই গান বজ্রকঠিন যুবসমাজের বুকে আগুন জ্বেলে দেয়। সাভারকর বলেন।যুদ্ধ ছাড়া স্বাধীনতা আসবে না। জেলবন্দি দের ওপর অকথ্য অত্যাচারের দৃশ্য হৃদয়কে আর্দ্র করে। মৃত্যু একটি চরিত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়েছে এই নাটকে। অকথ্য অত্যাচারের মধ্যে জীবন ও মৃত্যুর মাঝামাঝি স্থানে দাঁড়িয়ে বাঁচার প্রতি আকর্ষণ পরিলক্ষিত হয়েছে। সাভারকরের তেজদ্দীপ্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত সংলাপের সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত JNU ‘ভারত মাতা কি জয়’, ‘বন্দেমাতরম’, ‘জয় শিবাজী জয় ভবানী’ ধ্বনিতে ফেটে পড়েছে। এইভাবে ABVP , JNU তে একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ করল।
সাভারকরের সেল থেকে সাময়িক বাইরে আসার দৃশ্যে রায় ও অন্যান্য বন্দীরা আনন্দে উদ্বেল হয়ে উঠেছে দেখা যায়। সাভারকর তাদের মুক্তির পথে উদ্বুদ্ধ করেছে। সেলে ফিরে যাওয়ার সময় রায় পালানোর চেষ্টা করলে ব্রিটিশ পুলিশের লাঠির আঘাত নেমে আসে। এরপর শোনা যায় রায় আত্মহত্যা করেছে এবং এই খবর শুনে সাভারকর বলছেন-”ইন্দুভূষণ তুমি এমন কেন করলে? এই কি সেই ইন্দুভূষণ যে SS মোরিয়ার পোর্ট হোল থেকে পলায়ন করেছিল, যে সর্বদা জেলবন্দিদের উদ্বুদ্ধ করত।”
এই নাটক মানুষকে নাড়িয়ে দেয়। সাভারকর মৃত্যুর সাথে কথোপকথনে লিপ্ত হয়। এইভাবে জীবনের প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা জেগে ওঠে। সাভারকরের চরিত্র সম্পূর্ণ রূপে ধর্মনিরপেক্ষ কারণ সে বেদের মন্ত্র পাঠ করে, বাহাদুর শাহ জাফরের কবিতা বলে। সে আমার আপনার সকলের কথা বলে। সে সহ্যশক্তি নিয়ে প্রশ্ন তোলে। অতিরিক্ত সহ্যশক্তি যেন দুর্বলতার প্রতীক না হয়ে যায়। বামপন্থীদের সাভারকর অ্যালার্জির মুখে এটি যোগ্য জবাব।
নাটকের মধ্যে রয়েছে বিশুদ্ধ মারাঠি নির্যাস। সাভারকর যে স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী তা প্রমাণ করা গেছে। বামপন্থীদের সাভারকরকে কালিমালিপ্ত করার প্রয়াসের এতে বিরোধিতা করা হয়েছে। জেলারের দেওয়া ‘ব্যারিষ্টার বাবু’ নাম সাভারকরকে উপহাস করত। সেই ব্যারিষ্টার বাবু কিভাবে বাগ্মীতা, বুদ্ধিমত্তা ও ভদ্রতা দিয়ে মানুষের হৃদয় জয় করেছেন তা দেখানো হয়েছে। ‘ যে মায়াবী কপট, তার মোকাবিলা কপটতা দিয়েই করা উচিত’ এই উক্তি JNU কে আলোড়িত করেছে।
বেশ কিছু বছরের অভিজ্ঞতায় এমন নাটক আর পাওয়া যায় না। ইতিহাসের ভিন্ন দিককে তুলে ধরেছে। শুধু কাহিনি নয় অভিনতা, নির্দেশক সকলেই মন কেড়ে নিয়েছেন। মৃত্যুর সাথে সাভারকরের নাটকীয় একোক্তি দৃড়তা প্রদান করেছে। মঞ্চের ওপর সমবেত সঙ্গীত আলোড়ন সৃষ্টিকারী। সঠিক আলোক প্রক্ষেপন, সঠিক সময়ে সঠিক রেকর্ডের বেজে ওঠা একটি সিন থেকে অন্য সিনে পৌঁছাতে সাহায্য করেছে।
অভিনেতাদের দৃপ্ত অভিনয় সাড়া জাগানোর মত। JNU মুগ্ধ হয়ে সাভারকরের স্লোগান শুনতে থাকে। সাভারকর শৃঙ্খলাবদ্ধ অবস্থায় চিৎকার করতে থাকেন। সমস্ত শৃঙ্খলে ঝংকার ওঠে। সাভারকর যেন মৃত্যুর সামনে প্রাচীর হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। সাভারকর মৃত্যুকে বলেন কুলি। তাঁর দৃপ্ত ঘোষণা নিজের মৃত্যু তিনি নিজে ঠিক করবেন। বেঁচে থাকার সংগ্রাম, স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং মাতৃভূমির প্রতি জীবন উৎসর্গের সাধনা মনোমুগ্ধকর। সাভারকর শত্রুর শক্তি বোঝার জন্য শিবাজীর এগোনোর আগে দুই পা পেছনোর সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানান। শিবাজী এই ভাবনা থেকেই ঔরঙ্গজেবের ফরমানকে সম্মান করেন। নাটকের শেষে সাভারকর গৈরিক পতাকা নিয়ে দৃপ্তভঙ্গিতে এগিয়ে যেতে থাকেন এমন সময় ভারত মাতার আবির্ভাব ঘটে এবং স্লোগান ওঠে “ শিলালেখ গড়ে যায়েঙ্গে অউর হামারে আক্রোশ কে আওয়াজ কী আরতিয়া হোঙ্গি।”
১৯১১ সালের ঘটনা আজও আমাদের দেশে প্রাসঙ্গিক। এই সময়ে JNU তে ABVP এর এই পদক্ষেপ একটি বৃত্তকে সম্পূর্ণ করল।