ভালিয়ার রাম ও মন্দির পর্ব ৩

পূজাহীন তব পূজারি

কোথা সারাদিন ফিরে উদাসীন

কার প্রসাদের ভিখারি!

গোধূলিবেলায় বনের ছায়ায়

চির-উপবাস-ভূখারি

ভাঙা মন্দিরে আসে ফিরে ফিরে

পূজাহীন তব পূজারি।

রঘুনাথ মন্দিরের ফলক গুলি পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে যে, বেস প্যানেলের ফলকের সাইজ অনুযায়ী মূর্তিগুলি এক নির্দিষ্ট অনুপাতে ভিত্তিভূমি থেকে সোয়া ইঞ্চি থেকে দেড় ইঞ্চি পর্যন্ত উঠে এসেছে, অপর দিকে ভিত্তিভূমি থেকে প্রায় দুই ইঞ্চি পর্যন্ত উঠে এসেছে প্রবেশপথের ত্রিখিলানের উপরিভাগের অলংকরণ। প্রতি ক্ষেত্রেই শিল্পী কিন্তু একটি নির্দিষ্ট অনুপাতের ধারা মেনে চলেছেন। প্রতি ক্ষেত্রেই শিল্পী কিন্তু একটি নির্দিষ্ট অনুপাতের ধারা মেনে চলেছেন, যা শ্রেষ্ঠত্বের দাবী রাখে।

এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, তারাপদ সাঁতরা মন্দির নির্মাণে ভাস্কর্য অলঙ্করণ নিয়ে তাঁর গ্রন্থে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। মন্দির ত্রিখিলানের উপরিভাগ অলংকরণ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি সবিস্তারে জানিয়েছেন কি ভাবে মন্দিরে অলঙ্করণ করা হত। তিনি জানিয়েছেন ক্ষেত্র প্রস্তুত করার পদ্ধতি। ক্ষেত্র প্রস্তুত করে তারউপর নিজস্ব মুন্সিয়ানায় শিল্পী তাঁর পরিকল্পনা মাফিক আধকাঁচা ইঁটের ফলকের উপরপ্রার্থিত ভাস্কর্য নরুণের বা বাঁশের তৈরী সূক্ষ্ম যন্ত্রের সাহায্যে কিভাবে খোদাইকাজ সম্পন্ন করতেন ত্রিমাত্রিক পদ্ধতিতে। এমনকি খোদাই কাজ সম্পন্ন করার ফলক গুলিকে স্বতন্ত্র ভাবে পোড়ানো হত।

রঘুনাথ মন্দিরের ত্রিখিলানের উপরিভাগে যে অলংকরণের ত্রিমাত্রিকতা দেখা যায় সেই প্রসঙ্গে তারাপদ সাঁতরা মহাশয় একটি বক্তব্য পেশ করেন , ” কোনো কোনো গবেষক মন্তব্য করেছেন যে, কাঠের ছাঁচে ফেলে স্থানীয় কুম্ভকারেরা এই ধরনের পোড়ামাটির ফলক তৈরি করতেন। কিন্তু এই পদ্ধতিটি সর্বক্ষেত্রে যথার্থ নয় তা ওই ভাস্কর্য ফলকগুলিতে স্বল্প গভীরে খোদাই কাজের দিকে দৃষ্টি দিলেই প্রতীয়মান হবে। ”

রঘুনাথ মন্দিরের ত্রিখিলানের উপরিভাগের অলংকরণের প্রতিটি ফলকই অতীব যত্ন সহকারে ডিটেইলিং করা হয়েছে। কিছু ক্ষত অংশ থেকে তার প্রমান পাওয়া যায়। আর্চ প্যানেলের প্রতিটি ফলকের এত সুন্দর ডিটেইলিং বিষয় বস্তুতে এক অদ্ভুত ছন্দ এবং গতিময়তা এনেছে। একারনেই রঘুনাথ মন্দির এত উৎকর্ষ, এত আলাদা ,এত উজ্জ্বল।

সব থেকে বড় ব্যাপার হল ,মন্দির গাত্রে অলংকরণে নির্দিষ্ট শাস্ত্রীয় নিয়মরীতি মেনে চলা হয়েছে এখানে । যেমন পার্শ্ব অলংকররণে একেবারে নিচের স্তরে অর্থাৎ বেস প্যানেলে দেখা যায় সমাজ জীবনের নানা রূপ।এখানে যুদ্ধের দৃশ্য, রণতরী বা শিকারের দৃশ্য সুন্দরভাবে বিন্যস্ত। বিশেষভাবে উল্লেখ করার মত – দুটি রণতরীর ফলক , যা বৈচিত্র্যপূর্ন ।

মধ্যস্তর অলঙ্কৃত নানান পৌরাণিক বিষয়ের মোটিফে।ভালিয়ার রঘুনাথ মন্দিরের বেস প্যানেলের ঠিক উপরেই স্থান পেয়েছে শ্ৰী কৃষ্ণ কথা। সেখানে শ্ৰী কৃষ্ণের জন্ম , বাল্যলীলা, যুদ্ধ ইত্যাদি সকল ঘটনা বর্নিত হয়েছে। সারিবদ্ধ ভাবে রয়েছে পুতনা বধ , শকটাসুর বধ ও তৃণাবর্তাসুর বধ ইত্যাদি দৃশ্য। এছাড়াও আছে কালিয়া দমন, গোবর্ধন পর্বত ধারণ ইত্যাদি ঘটনাও।

আরও একটি উল্লেখ্য বিষয় হল , প্রবেশপথের উপরের আর্চ প্যানেলগুলিতে রামায়ণের বিভিন্ন ঘটনা স্তরে স্তরে সুবিন্যস্ত। প্রবেশ পথের প্রতিটি আর্চ প্যানেলই মূলত সাতটি স্তরে সজ্জিত এবং ফলকগুলি কোনো না কোনো ঘটনাক্রম দ্বারা নির্দিষ্ট।

যেমন –

প্রবেশ পথের উপর বাম আর্চ প্যানেলের উপর থেকে তৃতীয় স্তরে যেমন রয়েছে আদিশক্তি রূপ দর্শন – চামুন্ডা রূপী মহামায়ার চন্ড মুন্ড বধের দৃশ্য এবং তার ঠিক পাশেই রয়েছে দেবীর নারায়ণী রূপে বা বিষ্ণুদুর্গার রূপে দুর্গাসুর বধের দৃশ্য। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য যে বাংলার পোড়ামাটির মন্দিরে বিষ্ণুদুর্গার উপস্থিতি খুবই বর্তমান কালে চিহ্নিত হয়েছে। এর পূর্বে বাংলার পোড়ামাটির মন্দির সংক্রান্ত কোনো লেখায় এই নারায়ণী রূপ বা বিষ্ণুদুর্গার উল্লেখ চোখে পড়েনি। অথবা কেউ চিহ্নিত করেন নি।

মধ্য বা সেন্ট্রাল আর্চ প্যানেলের উপর থেকে প্রথম স্তরেই রয়েছে ব্রহ্মা , বিষ্ণু , মহেশ্বরের উপস্থিতি। এর পরের স্তরগুলিতে রাম লক্ষ্মণের সাথে রাবণ এবং ত্রিশিরার যুদ্ধ, লঙ্কিনী দেবীর বানর সেনাকে ভক্ষণ , রাম
এবং বানর সোনার সাথে কুম্ভকর্ণের যুদ্ধ , ইন্দ্রজিতের শক্তিশেল নিক্ষেপে আহত লক্ষ্মণ ইত্যাদি।

সেন্ট্রাল আর্চ প্যানেলের ঠিক উপরে অর্থাৎ কার্ণিশের ঠিক নীচের অলংকরণে স্থান পেয়েছে ভীষ্মের শরশয্যা এবং অর্জুনের গঙ্গা আনয়নের দৃশ্যটি। বাংলার খুব কম মন্দিরেই এই দৃশ্যগুলি দেখা যায়।

দক্ষিণ দিকে আর্চ প্যানেলের একটি দৃশ্যে দেখা যায় রাবণের রাজ সভায় হনুমানকে আনয়ন করা হয়েছে । রাবনকে দেখার উদ্দেশ্যে হনুমান রাক্ষস সেনাদের কাছে ধরা দেয় এবং তাঁকে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাবণের সভায় নিয়ে আসা হয়। অন্যদিকে দূত হিসাবে অঙ্গদ রাবণের সভায় উপস্থিত হয়ে লেজের উপর পাকিয়ে বসে রাবণের থেকে উচ্চ আসন লাভ করেছেন।এর ঠিক পরের স্তরেই আছে শ্ৰী রাম কতৃক দেবী দুর্গার অকাল বোধনের দৃশ্য এবং অপরটিতে রয়েছে রয়েছে রাবণের অশোক বনে যাত্রা।

আরো একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল , প্রবেশপথের প্রতিটি আর্চ প্যানেলের রয়েছে দুটি করে সহস্র দল পদ্ম , যদিও বিভিন্ন কারণে সেগুলি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে , সহস্রদল পদ্ম এখানে সহস্রারের প্রতীক।অর্থাৎ , শাস্ত্রীয় রীতি মেনে ভালিয়ার মন্দিরটিকেও দেখানো হয়েছে দেখা হয়েছে এনব জীবনের বিভিন্ন স্তর পেরিয়ে মোক্ষলাভের স্থান হিসাবে। এত একদম নীচের প্যানেলে সমাজজীবনের নানা দৃশ্য থেকে শুরু করে মধ্যস্তরে নানা শাস্ত্রীয় পৌরাণিক কাহিনী র দৃশ্য দেখিয়ে প্রবেশপথের ঠিক উপরের বিষয় গুরুত্ব পেয়েছে মুক্তির দ্যোতকের রূপকটি।

ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের প্রাচীন মন্দিরগুলির মতোই অন্ত মধ্যযুগের বাংলার পোড়ামাটির মন্দিরও কিন্তু বাস্তু শাস্ত্রের নিয়মে নির্মিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে আমাদের শ্রদ্ধেয় পূর্বজ ঐতিহাসিক, গবেষক, নৃত্ত্ববিদ প্রমুখরা বিস্তর ইঙ্গিত প্রদান করলেও বর্তমানে এই আঙ্গিকে মন্দির চর্চা খুবই সীমিত এবং এই বিষয় যথেষ্ট ভাবনার অবকাশ আছে। কারন কেবলমাত্র ভালিয়ার রঘুনাথ মন্দিরই নয় , অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত নির্মিত বাংলার অন্ত – মধ্য যুগের টেরাকোটা বা পোড়ামাটির মন্দিরগুলি পর্যবেক্ষন করলে দেখা যাবে কোথাও না কোথাও মন্দিরের স্থাপত্যশৈলী ও ভাস্কর্য বিন্যাসের সঙ্গে শাস্ত্রের এক নিবিড় যোগসূত্র রয়েছে।

দুঃখের বিষয় হল, বাংলার বহু মন্দিরের ন্যায় ভালিয়ার এই মন্দিরটিও চরম অবহেলিত হয়ে কালের করাল গ্রাসে আজ ভগ্নদশায় জরাজীর্ণ অবস্থায় কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে রয়েছে। মন্দিরের একদিকের অংশ বাজ পড়ে ক্ষতিগ্রস্থ , বেস এবং সাইডের প্যানেল গুলিও শ্যাওলা আক্রান্ত, অনেক জায়গায় ফলকগুলি ড্যাম বা নোনা লেগে নষ্ট হয়ে গেছে। মন্দিরগুলির যথাযথ সংরক্ষণ করা আশু প্রোয়জন। তার সঙ্গে মন্দির সম্পর্কে জনচেতনার জাগরণ এবং সহযোগিতা একান্ত কাম্য।

ভাঙা দেউলের দেবতা,

কত উৎসব হইল নীরব,

কত পূজানিশা বিগতা।

কত বিজয়ায় নবীন প্রতিমা

কত যায় কত কব তা–

শুধু চিরদিন থাকে সেবাহীন

ভাঙা দেউলের দেবতা।

#সমাপ্ত

দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ভালিয়ার রঘুনাথ মন্দির : একটি রচনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.