দেশবাসী সেদিন অন্য এক বাঙ্গলার রূপ প্রত্যক্ষ করলেন, যা বাঙ্গালির পক্ষে খুব গর্বের নয়। ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী তাঁরই দেশের একটি অঙ্গরাজ্যে পদার্পণ করেছেন। মূল উদ্দেশ্য পরের দিন বিবেকানন্দ জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে বেলুড় মঠে এক অনুষ্ঠানে যোগদান। নিতান্ত অরাজনৈতিক কার্যক্রমেও কার্যক্ষেত্রে এক কদর্য দৃশ্য দেখা গেল, একদল লোক মাঠে নামলো কালো পতাকা, কালো বেলুন নিয়ে সিএএ-বিরোধী কালো ব্যাচ পরে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে গো-ব্যাক স্লোগান দেওয়া হলো, রাস্তা আটকে যাত্রীদের হেনস্থাও করা হলো। ফেসবুকে এয়ারপোর্ট ঘেরাওয়ের ডাক দেওয়া হয়েছিল। এই নক্কারজনক অসভ্যতা, গণতান্ত্রিক রীতি-নীতি না মানার যে প্রত্যক্ষ রেওয়াজ সেদিন তৈরি হলো, তাতে অতিথি বৎসল কলকাতার ছবিটা মলিন হলো অবশ্যই। এই অসভ্যতাকে নানা ভাবে ব্যাখ্যার চেষ্টা হচ্ছে।
প্রধান ও জনপ্রিয় ব্যাখ্যা হলো দেশের যুবসমাজ পথে নেমেছে, বাম আন্দোলনের রোমান্টিসিজম ফিরে এসেছে। শেষোক্ত বিন্দুটির দিকে খেয়াল করন। বাম আন্দোলনের রোমান্টিসিজমকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার চেষ্টাটা বিলক্ষণ ধরা পড়বে, আর এই রটনার মূলে কারা আছে, তারা কোন আদর্শে দীক্ষিত, তাদের অ্যাজেন্ডায় টাকা জোগায় কারা সেসব আর নতুন করে বলার দরকার নেই, এই স্তম্ভের পাঠকেরা অনেকবার সেসব । শুনেছেন। একটা বিশেষ অংশের ছাত্র আন্দোলনকে মদত জোগানো হচ্ছে, তার বাইরেও দেশের বৃহত্তম ছাত্র-সমাজ আছে। তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে কারোকে সরব হতে দেখেছেন?
সর্বভারতীয় স্তরে যাওবা হচ্ছে, বাঙ্গলায় বিশেষ প্রতিষ্ঠান বাদে বৃহত্তর ছাত্রসমাজের কণ্ঠস্বর একপ্রকার স্তব্ধ। কারণটা সবাই জানে, ৩৪ বছরের বামজমানায় মেধাবী শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যে মধ্যমেধার চাষ শুরু হয়, সরকারি স্তরে সর্বত্র পার্টি-অনুগত করার যে। চেষ্টায় শিক্ষাব্যবস্থার মেরুদণ্ড একপ্রকার ভেঙে দেওয়া হয়, পরবর্তী জমানায় সেটিই নৈরাজ্যের চেহারা নিয়েছে। গত লোকসভা নির্বাচনে যে দল ও মতাদর্শ ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গেছে, তাদের এই অসভ্যাতা প্রদর্শনের সাহস ও শক্তি আসে কোত্থেকে? কোনও সন্দেহ নেই, এর চরম মতাদর্শ ধারীরা (এক্সট্রিমিস্ট) আজ রাজ্যের শাসকদলকে সুকৌশলে ব্যবহার করছে, আর শাসক-নেত্রী তাঁর রাজনৈতিক অপরিণামদর্শিতায় নিজেকে ব্যবহৃত হতে দিচ্ছেন।
কিছুদিন ধরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি প্রচার খুব চলছিল যে কেন্দ্রীয় সরকারের বা বিজেপি সরকারের সমর্থক (আক্রমণের এখন নতুন ভাষা হয়েছে ‘চাড্ডী’ বা ‘ভক্ত’) কিংবা আরএসএসের লোক দেখলেই তাড়ান, মারুন, কদর্য গালাগাল দিন, আরও যা যা ছোটোলোকামি করা যায় সবই করতে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা চলছে। সেই ‘চাডী’ বা ‘ভক্তদের অসীম সহনক্ষমতা বলতে হবে, গত লোকসভায় ১৮টি আসন জেতার মতো যাদের বিপুল জনসমর্থন, তারা মাঠে নামলে এই ‘চান্স নিয়ে দেখা বুলি আওড়ানো মাধ্যমিক উচ্চমাধ্যমিকের থার্ড ডিভিশনদের আর খুঁজে পাওয়া যেত না কিন্তু তাদের অসীম সংযম এযাত্রা এদের বাঁচিয়ে দিয়ে গেল।
দেশের প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ করায় এককালে বিবেকানন্দকে বেকার যুবক বলা, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেবকে মৃগী রোগী বলা বিকৃতমস্তিষ্ক বিদেশি আদর্শের দালালদের উত্তরপ্রজন্মের গালাগালের সামনে রামকৃষ্ণ মিশন পড়ছে বটে, কিন্তু হঠাৎ এরা একটু যেন রামকৃষ্ণ বিবেকানন্দ ‘ভক্ত হতে চাইছে, সুতরাং সাধু সাবধান। দেশের প্রধানমন্ত্রী তার দেশের অঙ্গরাজ্যে এসে পরিকল্পিত হেনস্থার সম্মুখীন হচ্ছেন, শুধু ভোটযুদ্ধে জয়ই যথেষ্ট নয়, প্রয়োজনে প্রশাসনিক প্রতিরক্ষামূলক কড়া পদক্ষেপও দরকার। কারণ নরেন্দ্র মোদী কোনও দলীয় প্রধান নেতা নন, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশের প্রধানমন্ত্রীকে অপমান প্রকারান্তরে দেশকেই অপমান, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ রাখলে চলবে না। এই দেশদ্রোহীদের চিহ্নিত করা জরুরি, ‘গণতান্ত্রিক অধিকার’-এর মোড়কে দেশবিরোধিতাকে প্রশ্রয় দেওয়া যায় না।
বিশ্বামিত্র-র কলম
2020-01-17