দু’হাতে বল করতে পারা বাংলার স্পিনার ভারতের নেটে, স্পিন সামলাতে হিমশিম খাওয়া জাডেজারা হাওড়ার কৌশিকের শরণাপন্ন

ডান হাতি বোলার বল ‘ছুড়ছিলেন’। কোচ বলেছিলেন, বাঁ হাতে বল করতে। হাত বদলে ক্রিকেটজীবন বাঁচিয়ে ছিলেন। ভোলেননি ডান হাতকেও। যাঁর কেরিয়ার শেষ হয়ে যাচ্ছিল, হাওড়ার সেই সব্যসাচী বোলার কৌশিক মাইতিই এখন স্পিনে হাবুডুবু খাওয়া ভারতীয় ব্যাটারদের ভরসা।

দক্ষিণ আফ্রিকার স্পিনারদের বল খেলতে ইডেনে সমস্যায় পড়েছেন ভারতীয় ব্যাটারেরা। দ্বিতীয় টেস্টের আগে সাই সুদর্শন, ধ্রুব জুরেলদের স্পিন বল খেলার দক্ষতায় শান দিচ্ছেন গৌতম গম্ভীর। তাই মঙ্গলবার ভারতীয় দলের ঐচ্ছিক অনুশীলনে ডেকে নিয়েছিলেন বাংলার স্পিনার কৌশিককে। যাঁর বিশেষত্ব দু’হাতে বল করতে পারা।

ভারতীয় দলের নেটে মঙ্গলবার দীর্ঘক্ষণ বল করেছেন কৌশিক। গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ পেয়েছেন রবীন্দ্র জাডেজার কাছ থেকে। বাংলার হয়ে আটটি ৫০ ওভারের ম্যাচ এবং তিনটি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা রয়েছে ইস্টবেঙ্গলের ক্রিকেটারের। বল করার সময় ভারতীয় দলের বোলিং কোচ মর্নি মর্কেল বা গম্ভীর কোনও আলাদা পরামর্শ দেননি। নিজের মতো বল করেছেন। বাঁহাতি ব্যাটারদের অফস্পিন করেন আর ডানহাতি ব্যাটারদের বাঁ হাতে বল করেন। ভারতীয় দলের নেটেও সে ভাবেই বল করেছেন। আনন্দবাজার ডট কমকে কৌশিক বললেন, ‘‘সিএবির কাছে আমি কৃতজ্ঞ। এ রকম একটা সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। ভারতীয় দল কলকাতায় আসার পর ফিল্ডিং অনুশীলনের জন্য কয়েক জন স্থানীয় ক্রিকেটার চেয়েছিল। আমাকে ডাকা হয়। তবে মঙ্গলবার প্রথম ভারতীয় দলের নেটে বল করলাম। আগে আইপিএলের বিভিন্ন দলের নেটে বল করার সুযোগ পেয়েছি। গম্ভীর বা মর্কেল আমাকে কোনও নির্দেশ দেননি। যে ভাবে বল করি, ভারতীয় দলের নেটে সে ভাবেই করেছি। সাই সুদর্শন, ওয়াশিংটন সুন্দর, রবীন্দ্র জাডেজা এবং দেবদত্ত পাড়িক্কলকে অফ স্পিন করেছি। আর ধ্রব জুরেলকে বাঁ হাতে বল করেছি।’’

কৌশিকের অন্যতম প্রিয় ক্রিকেটার জাডেজা। তাঁকে বল করার সুযোগ পেয়ে উচ্ছ্বসিত ২৬ বছরের স্পিনার। কৌশিক বলেছেন, ‘‘জাড্ডু ভাইকে বল করার সুযোগ পেলাম। আমার স্বপ্ন সত্যি হল। কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শও পেয়েছি। ওয়াশিংটন ভাইও পরামর্শ দিয়েছেন। মূলত টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে কী করে আরও ভাল বল করা যায় জানতে চেয়েছিলাম।’’

কী পরামর্শ দিলেন দেশের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার? কৌশিক বলেছেন, ‘‘আমার বলে ব্যাট করার পর জাড্ডু ভাই কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। আমার স্বাভাবিক লেংথ ৪ থেকে ৫ মিটার। উনি বললেন, লেংথ বাড়িয়ে ৬ থেকে ৭ মিটার করতে। বলের গতি বৃদ্ধিরও পরামর্শ দিয়েছেন। ব্যাটারদের যতটা সম্ভব খেলার সময় কম দেওয়ার কথা বলেছেন।’’

ঐচ্ছিক অনুশীলন থাকায় লোকেশ রাহুল, ঋষভ পন্থ, যশস্বী জয়সওয়ালদের বল করার সুযোগ পাননি। চোটের জন্য অনুশীলনে আসেননি অধিনায়ক শুভমন গিলও। দেশের সেরা ব্যাটারদের বল করতে না পারার আক্ষেপ রয়েছে? কৌশিক বলছেন, ‘‘না না আমার কোনও আক্ষেপ নেই। যে সুযোগটা পেলাম, যে অভিজ্ঞতা হল, এটাই আমার কাছে অনেক। যাঁদের বল করলাম, তাঁরাও তো বড় ক্রিকেটার। জাড্ডু ভাইয়ের কথাই ধরুন। নেটে তাঁকে বল করাই বা কম কী।’’

এত দিন ভারতীয় দলের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতাও ভাগ করে নিলেন কৌশিক, ‘‘সাজঘরের কথা আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়। বলতে পারব না। তবে সকলের খুব সাহায্য পেয়েছি। সকলে উৎসাহ দিয়েছেন। এটা একটা দারুণ অভিজ্ঞতা। এ বার অনুশীলনে ছিলাম। ভবিষ্যতে ভারতীয় দলের সদস্য হতে চাই। এটাই স্বপ্ন।’’

দু’হাতে বল করা রপ্ত করলেন কী ভাবে? কৌশিক বলেছেন, ‘‘একদম শুরুতে ডান হাতেই বল করতাম। কিন্তু আমার বল চাকিং হয়ে যেত। হাওড়ায় যেখানে ছোটবেলায় শিখতাম, সেখানকার কোচেরা বাঁ হাতে বল করার পরামর্শ দিয়েছিলেন। সেই শুরু। অনূর্ধ্ব-১৯ বাংলার হয়ে বাঁহাতি স্পিনার হিসাবেই খেলেছি। এখন দু’হাতেই বল করি। সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে খেলা শিখেছি দীর্ঘ দিন। উনিও উৎসাহ দিয়েছেন দু’হাতে বল করতে।’’

ছাত্রকে নিয়ে উচ্ছ্বসিত সম্বরণও। প্রাক্তন জাতীয় নির্বাচক আনন্দবাজার ডট কমকে বললেন, ‘‘কৌশিক প্রথম যখন আমার আকাডেমিতে আসে, তখন ওর বয়স ছয়। হাওড়ার ছেলে। খুব দুঃস্থ পরিবারের ছেলে। ওর বাবা নিয়ে এসেছিলেন। খুব প্রতিভাবান খেলোয়াড়। বাংলার হয়ে সাদা বলের ক্রিকেট খেলেছে। শুধু ভাল স্পিনারই নয়, এই মুহূর্তে বাংলার অন্যতম সেরা ফিল্ডার কৌশিক। দু’হাতে বল করতে পারে। এটা ওর সহজাত। আমরা কিছু চাপিয়ে দিইনি।’’ সম্বরণ আরও বললেন, ‘‘এক দিন দেখি অনুশীলনে ডান হাতে বল করছে। তখন ১০-১১ বছর বয়স হবে। মৃদু ধমক দিয়ে বলেছিলাম, অ্যাই, ডান হাতে বল করছিস কেন? ও বলেছিল, স্যর আমি তো ডান হাতেও বল করতে পারি। শুনে বলেছিলাম, কর তো দেখি। দারুণ একটা অফ স্পিন করে দেখাল। একদম বড়দের মতো করল। দেখে ওকে বলেছিলাম, দু’হাতেই বল করবি।’’

ছাত্রের প্রতিভা নিয়ে সন্দেহ নেই সম্বরণের। তবে মনে করিয়ে দিলেন, ‘‘চেষ্টা করে যেতে হবে। সুযোগ কাজে লাগাতে হবে। কত দূর পৌঁছোবে, বলতে পারব না। প্রতিভা কাজে লাগাতে পারলে হবে।’’

কৌশিকের লক্ষ্য আইপিএল খেলা। রাজস্থান রয়্যালসে ট্রায়াল দিয়েছেন। ২০২৩ সালের বিজয় হজারে ট্রফিতে ১১ উইকেট নেওয়া স্পিনার জানেন না আইপিএলের দরজা খুলবে কিনা। তবে রাজস্থান দলে সুযোগ পেলে নিজেকে আরও উন্নত করতে পারবেন বলে তাঁর বিশ্বাস। কারণ আগামী আইপিএলে জাডেজা খেলবেন রাজস্থানের জার্সি গায়ে। কৌশিক অবশ্য এখনই বেশি কিছু ভাবতে চাইছেন না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.