ছ’-সাত হাজার রেডারের সমন্বয় ব্যবস্থা গড়ে তুলে সুসংহত এবং নিশ্ছিদ্র নজরদারি। সেই সঙ্গে রুশ এবং দেশীয় প্রযুক্তিতে তৈরি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ((এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম)-র মাধ্যমে শত্রুর হামলা প্রতিরোধের প্রস্তুতি। অপারেশন সিঁদুরের পরে ভারতীয় আকাশসীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে উপগ্রহ এবং লেজ়ার নিয়ন্ত্রিত অস্ত্রের ব্যবহারেও সক্রিয় হয়েছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। ‘দিগন্তের বাইরে’ (‘ওভার দ্য হরাইজ়ন’ বা ওটিএইচ) নজরদারি এবং প্রত্যাঘাতের ক্ষমতাসম্পন্ন ‘ইন্টিগ্রেটেড এয়ার ডিফেন্স ওয়েপন সিস্টেম’ (আইএডিডব্লিউএস)-ই হতে চলেছে ভারতীয় সেনার নতুন ‘সুদর্শন চক্র’।
সুপারসনিক (শব্দের চেয়ে দ্রুতগতি সম্পন্ন) যুদ্ধবিমান, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসা ড্রোন থেকে শুরু করে শত্রুপক্ষের ছোড়া ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র। ২০১৮ সালে মস্কোর থেকে পাওয়া এস-৪০০ ট্রায়াম্ফ আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা প্রায় নির্ভূল ভাবে বহুমুখী হামলার মোকাবিলায় সক্ষম। গত মে মাসে অপারেশন সিঁদুর-পর্বে সেই সক্ষমতার প্রমাণও দিয়েছে ভ্লাদিমির পুতিনের দেশের অস্ত্র। মস্কোর এই ‘সুদর্শন চক্র’র অ্যারে রেডার ৬০০ কিলোমিটার পর্যন্ত ক্ষেপণাস্ত্র, ড্রোন এবং যুদ্ধবিমানকে চিহ্নিত করতে সক্ষম। তবে এস-৪০০র ক্ষেপণাস্ত্রগুলির পাল্লা সর্বোচ্চ ৪০০ কিলোমিটার। নতুন ব্যবস্থায় ‘দিগন্তের বাইরে’ও শত্রুর গতিবিধি ঠাহর করে তা ধ্বংস করার পরিকল্পনা নিয়েছে ভারত।
গত ১৫ অগস্ট স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী ঘোষণা করেছিলেন ‘মিশন সুদর্শন চক্র’ কর্মসূচির। ‘ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে’ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, দু’মাস পেরনোর আগেই ওই কর্মসূচির নির্ণায়ক অগ্রগতি হয়েছে। ইতিমধ্যেই ওড়িশার চাঁদিপুর উপকূলের ইন্টিগ্রেটেড টেস্ট রেঞ্জে প্রাথমিক পরীক্ষা হয়ে গিয়েছে দেশীয় প্রযুক্তি এবং নকশায় তৈরি আইএডিডব্লিউএস-এর। ‘ভারতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা’ (ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজ়েশন বা ডিআরডিও)-র বিজ্ঞানীদের সহযোগিতায় নির্মিত সুসংহত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার যা অন্যতম অংশ। ইজ়রায়েলের আয়রন ডোমের মতোই বহুস্তরীয় এই নিরাপত্তা বলয় শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র, বিমান এবং ড্রোনের হামলা থেকে ভারতের আকাশকে নিরাপদ রাখবে বলে দাবি প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের। বহুস্তরীয় এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় রয়েছে ‘কুইক রিঅ্যাকশন সারফেস টু এয়ার মিসাইল’ (কিউআরএসএএম)। ‘অ্যাডভান্সড ভেরি শর্ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম’ (ভিএসএইচওআরএডিএস) এবং ‘ডায়রেক্ট এনার্জি ওয়েপন’ (ডিইডব্লিউ)।
প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারত প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য তার মহাকাশ নজরদারি ক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করছে, তাই মহাকাশ-ভিত্তিক নজরদারি (‘স্পেস বেস্ড সার্ভিল্যান্স’ বা এসবিএস) কর্মসূচির তৃতীয় ধাপে ২০৩০ সালের মধ্যে ৫২টি নতুন নজরদারি উপগ্রহ মোতায়েনের কাজ শেষ করতে চায়। আর সেই কাজ ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। এগুলি সুদর্শন চক্রের অধীনে বহুমুখী আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এবং রেডারের সাথে সংযুক্ত করা হবে। শত্রু বিমান, ড্রোন বা ক্ষেপণাস্ত্র ‘স্ক্যান এবং ট্র্যাক’ করা এবং ধ্বংস জন্য অস্ত্র (প্রথাগত ‘ভূমি থেকে আকাশ’ ক্ষেপণাস্ত্র এবং লেজ়ার নিয়ন্ত্রিত অস্ত্র) ব্যবহারের সঙ্কেত দেওয়া হবে এই ব্যবস্থার মাধ্যমে।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ডিআরডিও-র পাশাপাশি, সশস্ত্র বাহিনীর তিন শাখার (স্থল, নৌ এবং বায়ুসেনা) প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ এমনকি, বাছাই করা কয়েকটি বেসরকারি সংস্থাকেও ‘মিশন সুদর্শন চক্র’ কর্মসূচিতে শামিল করা হয়েছে বলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে দাবি। অস্ত্র এবং নজরদারি সরঞ্জামগুলির অধিকাংশই তৈরি হবে ভারতে। এর পাশাপাশি রুশ-৪০০-র উন্নততর সংস্করণ এস-৫০০ কেনার বিষয়ে ইতিমধ্যেই মস্কোর সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে। এই ‘অ্যান্টি-ব্যালিস্টিক মিসাইলে’র পাল্লা সর্বোচ্চ ৬০০ কিলোমিটার। ওই সীমার মধ্যে শত্রুপক্ষের ড্রোন, বিমান বা ক্ষেপণাস্ত্র এলেই তা নিমেষে ধ্বংস করে দিতে পারে এস-৫০০। বর্তমানে ভারতীয় সেনার ব্যবহৃত এস-৪০০-র পাল্লা সর্বোচ্চ ৪০০ কিলোমিটার। ২০২১ সালে রুশ সেনার অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল এস-৫০০। ভারতই প্রথম দেশ যাকে সম্প্রতি এই অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে পুতিনের সরকার।