গ্রিলের দরজা দিয়ে ঢুকেই ছোট্ট একফালি বারান্দা। দড়িতে এখনও ঝুলছে তাঁর ট্রাউজ়ার্স আর গেঞ্জি। তিনতলা বাড়ির প্রায় সর্বত্র তাঁর কোনও না কোনও চিহ্ন। শুধু মানুষটাই নেই!
দু’দিন আগেও যিনি বাড়িময় ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন, স্ত্রী-পুত্র-পুত্রবধূ-নাতনির হাতে গুনে গুনে তুলে দিচ্ছিলেন পুজোর খরচ, আচমকাই তিনি যেন গায়েব হয়ে গিয়েছেন! শহর জুড়ে দুর্গাপুজোর প্রস্তুতি তুঙ্গে। মেঘভাঙা রোদ ঝলসে যাচ্ছে দশদিক। শুধু নেতাজিনগরের গান্ধীকলোনির কুন্ডু পরিবারের আকাশ বিষাদের মেঘে আচ্ছন্ন।
হিসাব মেলাতে পারছেন না বাষট্টি বছরের প্রাণতোষ কুন্ডুর পুত্র দোলন। মানতে পারছেন না বাবার অকালমৃত্যু। বলেই ফেললেন, ‘‘আমার মাথা কাজ করছে না। সব গুলিয়ে যাচ্ছে। এখনও ভাবতে পারছি না কিছু।’’ সোমবার পর্যন্ত সব ঠিকঠাকই ছিল। রবিবার মহালয়ায় ছোট ইলিশ মাছ কিনে এনেছিলেন প্রাণতোষ। বলে দিয়েছিলেন, পুজোয় আরও বেশি দাম দিয়ে বড় ইলিশ আনবেন। জানতেন না, সোমবার রাত তাঁদের জীবনে কালরাত্রি হয়ে দেখা দেবে। রাতভর টানা বৃষ্টিতে জল থৈ থৈ শহরটা পঙ্গু। উদ্বিগ্ন প্রাণতোষ পরের দিন সকালে বেরিয়েছিলেন নেতাজিনগর মোড়ে নিজের ফলের দোকানের পরিস্থিতি দেখতে। আর ফেরেননি। রাস্তার জমা জলে তড়িদাহত হয়ে প্রাণ হারান প্রাণতোষ। দীর্ঘক্ষণ সেই জমা জলে ভাসছিল তাঁর নিষ্প্রাণ দেহ। পরিবারের সদস্যেরা সেই জল থেকে তাঁর দেহ উদ্ধার করতে পারেননি দীর্ঘ ক্ষণ। সে দিনের ঘটনা মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠেন পেশায় বেসরকারি সংস্থার হিসাবরক্ষক দোলন। বলেন, ‘‘বাবা সকালে দুধ আনতে বেরিয়েছিল। সেখান থেকে ফলের দোকানের অবস্থাটাও দেখে আসবে বলে ভেবেছিল। চারদিকে এত জল! বাবা লাইটপোস্টে সাইকেলটা হেলান দিয়ে রেখেছিল। পরে সেটা ছুঁতেই এই কাণ্ড।’’
তড়িৎস্পৃষ্ট হয়ে প্রাণতোষ মুখ থুবড়ে পড়ার পর তাঁর দিকে ঝাঁপিয়েছিল একটি কুকুর। তড়িদ্স্পর্শে তৎক্ষণাৎ তারও মৃত্যু হয়। আর কেউ কাছে ঘেঁষার সাহস পাননি। জমা জলে আধোডোবা হয়ে পড়েছিল শুধু একটি সাইকেল আর দু’টি নিথর দেহ। দোলন বলেন, ‘‘দাঁড়িয়ে দেখা ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় ছিল না। সিইএসসি থেকে লোকজন আসে প্রায় দু’ঘণ্টা পরে। দমকল আসতেও দেড় ঘণ্টা লেগে গিয়েছিল। তার পরে বাবার দেহ উদ্ধার করতে পেরেছি।’’
কেন এমন হল? দোলনের জবাব, ‘‘গাফিলতি তো সিইএসসি-র! পুজোর সময় একটু সাবধান হবে না? পুরসভারও লাইটপোস্টগুলো দেখা উচিত। সরকারের কাজ হল তদারকি করা। সেটা একেবারেই হয়নি।’’
হিসাবি মানুষ ছিলেন প্রাণতোষ। ফলের দোকানের পাশাপাশি বাড়িতে একটি ছোট মুদি দোকান খুলেছিলেন। পুত্রবধূ দেখাশোনা করতেন। পুজো উপলক্ষে বাড়ির সকলের হাতে কিছু কিছু করে টাকা দিয়েছিলেন প্রাণতোষ। স্ত্রীকে দিয়েছিলেন হাজার টাকা। পুত্রকে দু’হাজার এবং পুত্রবধূকে তিন হাজার। নাতনি রিয়া পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্রী। দাদুর কাছ থেকে সে-ও পেয়েছিল হাজার দুয়েক টাকা। তবে রিয়ার তাতে মন ভরেনি। মায়ের ‘সমান সমান’ হতে আরও হাজার টাকার বায়না ধরেছিল দাদুর কাছে। দেবেন, বলেছিলেন প্রাণতোষ।
কুন্ডুদের বাড়ির দু’দিকে কয়েক হাত দূরত্বে দু’টি বড় বড় পুজোমণ্ডপ। ঢাক বাজতে শুরু করেছে। কিন্তু সে আওয়াজ পানসে লাগছে এক রাতের বৃষ্টিতে গৃহকর্তাকে হারানো পরিবারের কাছে। সারা শহর খুশিয়াল হয়ে বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়। সপ্তমী-অষ্টমীর ভিড় এড়াতে আগেভাগেই ঠাকুর দেখার ভিড় জমেছে কলকাতার আনাচেকানাচে। আর প্রাণতোষের ফেলে-যাওয়া পরিবার কলকাতা পুরসভায়।
সামান্য ফলের দোকানের আয় থেকেই তিল তিল করে তিনতলা বাড়ি তুলেছিলেন প্রাণতোষ। টাকা খরচ করতেন গুনে গুনে। স্ত্রী কুসুম জানালেন, দোকানের পরিধি আর বাড়ানোর সুযোগ ছিল না। তবে আয় কী ভাবে বাড়ানো যায়, প্রাণতোষ সেই চিন্তায় ডুবে থাকতেন। দুর্গাপুজোয় ঘুরতে-টুরতে বেরোতেন না কখনও। সামনে লক্ষ্মীপুজো। ফলের দোকানে তখন বাড়তি চাপ। তার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিলেন। ধরাগলায় কুসুম বলছিলেন, ‘‘১৪ বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিল আমার। প্রায় ৫০ বছরের দাম্পত্য। ও আগে কাঠের কাজ করত। বাবা মারা যাওয়ার পরে ফলের দোকান শুরু করে। লক্ষ্মীপুজোয় রাত পর্যন্ত দোকানেই থাকত।’’ কান্না চেপে সদ্যবিধবা বলেন, ‘‘ও আমার খুব প্রিয় ছিল। আমায় কোনও কাজ করতে দিত না। ওর এ ভাবে চলে যাওয়াটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে খুব।’’
পাড়ার লোকজন ‘বাবু’ নামেই চেনেন প্রাণতোষকে। তাঁর এবং তাঁর কিছু বন্ধুর উদ্যোগে পাড়ায় কালীপুজো শুরু হয়েছিল। ৪০ বছর ধরে সেই কালীপুজোর সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে ছিলেন প্রাণতোষ। বাবুর এমন বেঘোরে মৃত্যু পড়শিরাও মানতে পারছেন না। প্রাণতোষের পুত্রবধূ সনিয়া অবাঙালি। তিনি বললেন, ‘‘বাবা মোবাইলে খুব একটা সড়গড় ছিলেন না। স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পারতেন না। ছোট একটা ফোন ব্যবহার করতেন। বাজারে গেলে আমায় ফোন করে জানতে চাইতেন বাড়িতে কিছু লাগবে কি না। জলে পড়ে বাবার সেই ফোনটাও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। বাবার মতো ফোনটাও থেমে গেল।’’
সোমবার রাতের বেনজির বৃষ্টিজনিত দুর্যোগে কলকাতা এবং শহরতলিতে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। অধিকাংশই প্রাণতোষের মতো জমা জলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মৃতদের পরিবারের জন্য দু’লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেছেন। সরকারি চাকরির আশ্বাস দিয়েছেন। তাঁর প্রস্তাব মেনে সিইএসসি কর্তৃপক্ষ নিহতদের পরিবারগুলিকে এককালীন পাঁচ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছে।
তিনতলা বাড়ির একতলায় থাকতেন প্রাণতোষ। টিভির পাশে রাখা ল্যান্ডলাইন। দেওয়ালে ঝুলছে নাতনি রিয়ার স্কুলের পোশাক। বসার ঘর পেরিয়ে সিঁড়ির কাছে যেতেই চোখে পড়ল সেই লাল সাইকেলটা। কেউ জল থেকে তুলে এনে সিঁড়ির পাশে এক কোণে রেখে দিয়েছেন।
একটি লাল সাইকেল। হাতে হাতে গুঁজে দেওয়া কিছু নোট। পঞ্চমী এল নেতাজিনগরের নিষ্প্রাণ এক তিনতলা ইমারতে।