প্রথম আইপিএল, তার পর ইংল্যান্ড। গত এক মাস ব্যাট হাতে সময়টা ভালই গিয়েছে শুভমন গিলের। ভারতের টেস্ট দলের অধিনায়ক হওয়ার পর টি-টোয়েন্টি দলের সহ-অধিনায়ক হয়েছেন। অর্থাৎ নেতৃত্বের পথও পরিষ্কার হচ্ছে। ব্যাটার শুভমনের উত্থানের নেপথ্যে রয়েছেন ফলের রস বিক্রেতা, যিনি প্রয়োজনে শুভমনকে থ্রোডাউন দেন। ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন নিয়েও ব্যর্থ হওয়া এক তরুণের নিরলস প্রয়াসেই ব্যাটিংয়ে উন্নতি হয়েছে শুভমনের।
মোহালি স্টেডিয়ামের বাইরে অনেক বছর ধরেই ঠেলাগাড়িতে ফলের রস বিক্রি করতেন উত্তরপ্রদেশের কুশিনগরের বাসিন্দা রামবিলাস শাহ। ছোটবেলায় রোজ সেই দোকান থেকে ফলের রস খেতেন শুভমন এবং তাঁর বাবা লখবিন্দর গিল। রামবিলাসের ছেলে অবিনাশ কুমার মোহালি স্টেডিয়ামের পিছনে একটি মাঠে জোরে বোলিং করতেন।
২০১৪-এ একদিন ঠেলাগাড়িতে অবিনাশকে দেখে লখবিন্দর প্রশ্ন করেছিলেন তাঁর বাবার ব্যাপারে। অবিনাশ বলেছিলেন, “পাজি, আমি ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছি। এখন স্টুডিয়োয় চাকরি করি। বাবার শরীর খারাপ বলে আজ এখানে এসেছি।” ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’কে অবিনাশ বলেছেন, “পঞ্জাব ক্রিকেট সংস্থার এক কোচকে আমার বাবা রাজি করানোর পর ক্রিকেট খেলা শুরু করি। শুভমনের থেকে আমি দু’বছরের বড়। জোরে বোলার ছিলাম। কিন্তু আর্থিক অনটনের কারণে ক্রিকেট ছেড়ে দিই।”
কয়েক মাস পর আবার লখবিন্দর ঠেলাগাড়িতে অবিনাশকে দেখতে পান। তখন ক্রিকেট ছাড়ার জন্য বেশ বকাঝকা করেন তাঁকে। অবিনাশ বলেছেন, “লখবিন্দর পাজি রেগে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন, ক্রিকেট আমার পরিবারের অবস্থা বদলে দিতে পারে। আমার ক্রিকেট ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তে খুশি হতে পারেননি। স্টুডিয়োয় কাজ করি জেনে আরও রেগে গিয়েছিলেন।”
এক সপ্তাহ পরে লখবিন্দর একটি ভিডিয়ো দেখান অবিনাশকে। সেই ভিডিয়ো ছিল সাইড-আর্ম থ্রোয়ারের। অবিনাশকে নির্দেশ দেন সেটি অনুশীলন করতে। কী ভাবে করতে হবে সেটাও দেখিয়ে দেন। এর পর থেকেই শুভমনের সঙ্গে অবিনাশের বন্ধুত্ব হয়ে যায়। অবিনাশ বলেছেন, “ওকে অ্যাকাডেমির দিন থেকেই চিনতাম। এখন আমি ওর ব্যক্তিগত সাইড-আর্ম থ্রোয়ার। কী দিন ছিল আর কী দিন দেখছি। আমরা একসঙ্গেই রয়েছি।”
অবিনাশ দিনে ১৫০-২০০ টাকা রোজগার করেন। তবে কখনও শুভমন বা তাঁর বাবার থেকে এক টাকাও নেননি। অবিনাশের কথায়, “শুভমনের বাবা আমার জীবনের পথ দেখিয়েছেন। হোলি বা দিওয়ালিতে টাকা দিয়েছেন। হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছেন। এমনকি দরকারে পরিবারকেও সাহায্য করেছেন। আমি সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।”
২০১৯-এ অবিনাশ পঞ্জাব দলের সাইড-আর্ম থ্রোয়ার হন। তখনই মনদীপ সিংহ, গুরকিরত মানের মতো সিনিয়রেরা তাঁকে পছন্দ করতে শুরু করেন। শুভমন, অভিষেক শর্মা, প্রভসিমরন সিংহের সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়ে যায়। ২০২৪-এ এক দিন হঠাৎই শুভমনকে অবিনাশ বলে দেন, “এখন তো তুই অধিনায়ক হয়ে গিয়েছিস। আমাকেও আইপিএলে একটা সুযোগ করে দে।” শুভমন তাঁকে পরামর্শ দেন চিন্তা না করার।
এ বছরের শুরুতে, ছেলের সঙ্গে একদিন চণ্ডীগড়ের বাড়িতে খেলছিলেন অবিনাশ। হঠাৎই শুভমনের ফোন পান। ফোনের ও পার থেকে শুভমন নির্দেশ দেন ব্যাগ গুছিয়ে ফেলতে। যে কোনও মুহূর্তে গুজরাত টাইটান্স থেকে ফোন আসতে পারে। অবিনাশ হতবাক হয়ে যান। বলেছেন, “এর আগে আমাকে জুতো, জামা, মোবাইল দিয়েছে। কিন্তু আইপিএলে সুযোগের ব্যাপারটা ভাবতেও পারিনি।”
আইপিএলের আগে থেকেই ইংল্যান্ড সিরিজ়ে চোখ ছিল শুভমনের। ছোটবেলার বন্ধু খুশপ্রীত সিংহ সাহায্য করতেন। তার সঙ্গে শুভমনের দরকার ছিল আরও একজনকে, যিনি ইংল্যান্ড সিরিজ়ের জন্য প্রয়োজনীয় সাহায্য করতে পারেন। রঞ্জিতে পঞ্জাবের ব্যাটারদের সমস্যায় ফেলার জন্য অবিনাশের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। তাঁকেই সাহায্য করতে বলেন শুভমন।
অবিনাশ বলেছেন, “গুজরাতে যোগ দেওয়ার পর শুভমন আমাকে বলেছিল নেটে লাল বলে ওকে সমস্যায় ফেলার চেষ্টা করতে। আমি সেটাই করেছিলাম। লাল বলে আমি এমনিতেই ব্যাটারদের সমস্যায় ফেলি। সাদা বলেও ব্যাটারদের আত্মবিশ্বাসে ধাক্কা দিতে পারি। কিন্তু লাল বলের লড়াইটা আলাদা।”
এত কিছুর পরেও কোনও কৃতিত্ব নিতে চান না অবিনাশ। বলেছেন, “পুরো সাফল্যই শুভমন পেয়েছে নিজের পরিশ্রমের জন্য। আমার থ্রোয়ে অনেক বার আঘাত লেগেছে। কখনও কিছু বলেনি। ওর বাবা এবং কেপি পাজির জন্যই শুভমন আজ এই জায়গায়। আমি তো শুধু ওকে নকিং করিয়েছি। তার জন্য ও বা ওর বাবা যা করেছেন আমি কৃতজ্ঞ।”