১৫টি ভোটের রহস্যে মোড়া ত্র্যহস্পর্শ উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে! হিসাবের চেয়ে ১৫ বেশি, ১৫-ই কম, আবার বাতিলও ঠিক ১৫টি

এক দল যা দাবি করেছিল, তার চেয়ে ১৫টি ভোট কম পেল। অন্য দল যা হিসাব কষেছিল, তার চেয়ে ১৫টি ভোট বেশি পেল। আবার ঠিক ১৫টি ভোট বাতিলও হল। উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফল ঘোষণা হতেই রহস্য ঘনাল ‘১৫’ সংখ্যাটিকে ঘিরে। বিজেপি দাবি করল, ভোট ভেঙেছে ‘ইন্ডিয়া’ শিবিরের। কংগ্রেস সে তর্কে না-ঢুকে তুলে ধরল শতাংশের হিসেব। বলল ‘নৈতিক পরাজয়’ হয়েছে বিজেপির। প্রবীণ তৃণমূল সাংসদ বললেন, ‘‘আমাদের সব ভোট সুদর্শন রেড্ডিই পেয়েছেন, বাকিটা ইন্ডিয়া মঞ্চের নেতারা কাটাছেঁড়া করে দেখুন।’’

ভোটগ্রহণ শেষ হয়েছিল বিকেল ৫টায়। ঠিক ৫টা ১৪ মিনিটে কংগ্রেস নেতা জয়রাম রমেশ সমাজমাধ্যমে লেখেন, ‘বিরোধী শিবির ঐক্যবদ্ধ ছিল। বিরোধী দলগুলির ৩১৫ জন সাংসদের সকলেই ভোট দিতে এসেছিলেন।’ কংগ্রেসের তরফে সাংবাদিক বৈঠক করেও একই সংখ্যার কথা বলা হয়। কিন্তু ভোটের ফল প্রকাশিত হতেই দেখা যায়, বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র প্রার্থী বি সুদর্শন রেড্ডি পেয়েছেন ৩০০টি ভোট। অর্থাৎ জয়রামের তথা কংগ্রেসের দাবি করা সংখ্যার চেয়ে ১৫টি কম।

এনডিএ প্রার্থী সিপি রাধাকৃষ্ণন কমপক্ষে ৪৩৭টি ভোট পাবেন বলে শাসক শিবিরে জল্পনা ছিল ভোটের আগে থেকেই। কারণ লোকসভায় এনডিএর সাংসদসংখ্যা ২৯৩, রাজ্যসভায় ১৩২। দুয়ে মিলে হয় ৪২৫। এর পাশাপাশি অন্ধ্রপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জগন্মোহন রেড্ডির দল ওয়াইএসআরসিপি জানিয়েছিল, তাদের ১১ সাংসদ সমর্থন করবেন এনডিএ প্রার্থী রাধাকৃষ্ণনকে। অরবিন্দ কেজরীওয়ালের দল আম আদমি পার্টির (আপ) সাংসদ স্বাতী মালিওয়ালও এনডিএ প্রার্থীকে ভোট দেবেন বলেও বিজেপি সূত্রের দাবি ছিল। সব মিলিয়ে সংখ্যাটা পৌঁছয় ৪৩৭-এ। কিন্তু ফলাফল বলছে, রাধাকৃষ্ণন পেয়েছেন ৪৫২। অর্থাৎ প্রত্যাশার চেয়ে ঠিক ১৫টি বেশি।

তা হলে কি জয়রামের দাবি করা সংখ্যার চেয়ে ‘ইন্ডিয়া’ প্রার্থী যে ক’টি ভোট কম পেলেন, ঠিক সেই ক’টি ভোট সরাসরি এনডিএ-র দিকে চলে গেল? অর্থাৎ ‘ক্রস ভোটিং’ করিয়ে বিরোধী ‘ইন্ডিয়া’র সংসারে আবার ভাঙন ধরাল শাসক এনডিএ? এ প্রশ্নের স্পষ্ট জবাব কারও কাছে নেই। কারণ এক দিকে হিসাবের চেয়ে ১৫টি ভোট কম পড়েছে এবং অন্য দিকে প্রত্যাশার চেয়ে ১৫টি বেশি পড়েছে ঠিকই, কিন্তু একই সংখ্যক ভোট বাতিলও হয়েছে। তাই ‘ইন্ডিয়া’ থেকে এনডিএ-র দিকে ‘ক্রস ভোটিং’-ই হয়েছে, এ কথা জোর দিয়ে কেউ বলতে পারছেন না। কারণ বাতিল হওয়া ১৫টি ভোটের সব ক’টি যদি ‘ইন্ডিয়া’ শিবিরের ভোট হয়ে থাকে, তাহলে ‘ক্রস ভোটিং’ তত্ত্ব ধোপে টিকছে না। রাধাকৃষ্ণন যে ১৫টি ভোট হিসাবের চেয়ে বেশি পেয়েছেন, তা এনডিএ এবং ‘ইন্ডিয়া’র বাইরে থাকা সাংসদের থেকে জোগাড় করা হয়েছে বলে কংগ্রেসের একাংশ দাবি করছেন।

উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনের ফল ঘোষণা হওয়ার পরে অবশ্য কংগ্রেসের জয়রামকেই সর্বাগ্রে নিশানা করেছে বিজেপি। দলের সর্বভারতীয় আইটি ও সমাজমাধ্যম ইনচার্জ অমিত মালবীয় নিজের এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) তুলে ধরেন জয়রামের সেই পোস্ট, যেখানে তিনি ৩১৫টি বিরোধী ভোট ‘ঐক্যবদ্ধ’ হওয়ার কথা লিখেছিলেন। মালবীয় লেখেন, ‘৩১৫ জনই ভোট দিয়েছেন, কিন্তু আসল প্রশ্ন হল, কাকে দিয়েছেন! প্রচুর হইচই এবং বড়াইয়ের পরেও ইন্ডি জোটের প্রার্থী মাত্র ৩০০টি ভোট জোগাড় করতে পেরেছেন, যা তাঁদের আত্মবিশ্বাসী দাবির চেয়ে ১৫টি কম।’

মালবীয়ের এই কটাক্ষের জবাব জয়রাম সরাসরি দেননি। তবে তিনি ফলপ্রকাশের পরে ফের সমাজমাধ্যমে পোস্ট করেন। লেখেন, ‘উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী শিবির পুরোপুরি একজোট থেকেছে।’’ ভোটের সংখ্যা নিয়ে জয়রামের এই পোস্টে আর কোনও কাটাছেঁড়া ছিল না। জয়রাম সেখানে শুধু শতাংশের হিসাব তুলে ধরেন। ২০২২ সালে জগদীপ ধনখড়ের বিরুদ্ধে বিরোধীদের প্রার্থী মার্গারেট আলভা প্রদত্ত ভোটের মাত্র ২৬ শতাংশ পেয়েছিলেন। সেখানে এ বার সুদর্শন প্রদত্ত ভোটের ৪০ শতাংশ পেয়েছেন। এই হিসেব তুলে ধরে জয়রাম লেখেন, ‘পাটিগণিতের হিসেবে বিজেপির যে জয়, তা আসলে তাদের নৈতিক এবং রাজনৈতিক পরাজয়।’

তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ‘‘কোনও ভোট এ দিকে-ও দিকে গিয়েছে কি না, তা ইন্ডিয়া মঞ্চের নেতারা একসঙ্গে বসে বিশ্লেষণ করে দেখবেন। তবে আমরা তৃণমূলের সাংসদরা ইন্ডিয়ার প্রার্থী সুদর্শন রেড্ডিকেই ভোট দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম। আমরা তা করেছি। তৃণমূলের একটা ভোটও এ দিকে-ও দিকে যায়নি, একটা ভোটও নষ্ট হয়নি। আমি এবং সৌগতদা অসুস্থতা সত্ত্বেও ডাক্তারের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে গিয়ে ভোট দিয়ে এসেছি। সুতরাং আমাদের যা করার ছিল, আমরা তা সফল ভাবেই করেছি।’’

পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত আর এক সাংসদ তথা রাজ্য বিজেপির সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যের দাবি, উপরাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিরোধী শিবিরের অনৈক্য আবার প্রকাশ্যে চলে এসেছে। তাঁর কথায়, ‘‘ওঁরা তো সাংবাদিক সম্মেলন করে দাবি করলেন যে, ৩১৫ পাবেন। পেলেন ৩০০। আবার আমরা পেলাম ১৫টি অতিরিক্ত। এর থেকে যা বোঝার বুঝে নিন।’’ শমীকের যুক্তি অনুযায়ী, ‘‘যে ১৫টি ভোট বাতিল হয়েছে, সেগুলির সব ক’টিই বিরোধীদেরই ভোট ছিল, এটা সম্ভব নাকি! যদি বাতিল ভোটগুলির মধ্যে একটিও আমাদের হয়ে থাকে, তা হলেই তো স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে যে, ক্রস ভোটিং হয়েছে।’’

তবে বাতিল ভোটগুলির মধ্যে কোন শিবিরের কতগুলি ছিল, সত্যিই সবক’টি বাতিল ভোটই ‘ইন্ডিয়া’ শিবিরের কি না, সে বিষয়ে স্পষ্ট তথ্য কোনও দলই রাত পর্যন্ত দিতে পারেনি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.