পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে ব্যারিকেড। নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন জনাকয়েক পুলিশকর্মী। হাজার হাজার বিক্ষোভকারীর সামনে একটা সময় তাঁদের অসহায় দেখাচ্ছিল। তবে পরে আরও পুলিশ এসে পড়ায় পরিস্থিতি পাল্টে যায়। দফায় দফায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে উত্তাল হয়ে ওঠে নেপালের কাঠমান্ডু। শুধু রাজধানী নয়, বিক্ষোভের আঁচ ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যত্রও। বাদ যায়নি সে দেশের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির গ্রামও। তাঁর পৈতৃক বাড়ি লক্ষ্য করে ইটবৃষ্টি শুরু হয়। উঠেছে তাঁর পদত্যাগের দাবিও। দেশের উত্তাল পরিস্থিতির মধ্যে নেপালের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিলেন রমেশ লেখক।
সম্প্রতি নেপাল সরকার ফেসবুক, হোয়াট্সঅ্যাপ, এক্স-সহ ২৬টি সমাজমাধ্যম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সোমবার সকাল থেকে প্রতিবাদে নামেন ছাত্র-যুবরা। বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতি ক্রমশ পুলিশ-প্রশাসনের হাতের বাইরে চলে যায়। নিয়ন্ত্রণ করতে শূন্যে গুলি ছোড়ে পুলিশ। ছোড়া হয় রবারের গুলিও। তবে বিক্ষোভকারীদের দাবি, পুলিশ শূন্যে নয়, তাঁদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে। কারও গায়ে লেগেছে, কারও হাতে, আবার কারও মাথায়। সোমবার রাত (ভারতীয় সময়) পর্যন্ত পুলিশের গুলিতে মৃতের সংখ্যা ১৯। হুড়োহুড়ি, ধস্তাধস্তি, পুলিশের গুলি, লাঠিতে আহতের সংখ্যাও অনেক। ‘কাঠমান্ডু পোস্ট’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২৫০ জনের বেশি আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ওলির পদত্যাগের দাবি
বিক্ষোভ ঠেকাতে পুলিশকে কাজে লাগিয়ে প্রতিবাদীদের কণ্ঠরোধের চেষ্টা করছে ওলির সরকার! এমনই দাবি বিক্ষোভকারীদের। তরুণ প্রজন্মের এই বিক্ষোভকে সামনে রেখে এ বার ওলির পদত্যাগের দাবি তুলল বিরোধী দল রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি (আরএসপি)। সরকার যে ভাবে প্রতিবাদ দমনের চেষ্টা করেছে, তা নিন্দনীয়। বিবৃতি জারি করে জানাল তারা। তাদের দাবি, ‘‘প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করুন। ঘটনার তদন্তের জন্য উচ্চপর্যায়ের বিচারবিভাগীয় কমিটি গঠন করতে হবে। দায়ী সকলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ করার উচিত।’’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ
বিক্ষোভের মুখে পড়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেন রমেশ। কাঠমান্ডু পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সোমবার সন্ধ্যায় বালুওয়াতারে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তাঁর পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন।
বিক্ষোভকারীদের নিশানায় ওলির বাড়ি
কাঠমান্ডু থেকে ৪০০ কিলোমিটার দূরে পূর্ব নেপালের কোশি প্রদেশের দামাক এলাকায় রয়েছে ওলির পৈতৃক বাড়ি। বিক্ষোভের আঁচ গিয়ে পড়েছে সেখানেও। বাড়ি লক্ষ্য করে ইট, পাথর ছুড়ছেন বিক্ষোভকারীরা। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সেখানেও গুলি ছোড়ে পুলিশ।
মহাসড়ক অবরোধ
প্রতিবাদের জেরে অবরুদ্ধ দেশের বিভিন্ন রাস্তা। নেপালের পূর্ব-পশ্চিম মহাসড়ক অবরোধ করে রেখেছেন বিক্ষোভকারীরা। সেই পথে যান চলাচল বন্ধ। দিকে দিকে টায়ারে আগুন ধরিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন প্রতিবাদীরা। পরিস্থিতি সামাল দিতে নামানো হয়েছে র্যাফ ও সেনা।
‘জেন জ়ি’ বিক্ষোভ
খাতায়-কলমে এই প্রতিবাদের নেতৃত্বে আছে নেপালের ‘জেন জ়ি’, অর্থাৎ তরুণ প্রজন্ম। সোমবারের বিক্ষোভেও সামনের সারিতে দেখা গিয়েছে স্কুল-কলেজের পড়ুয়াদের। দলে দলে তরুণ-তরুণী পথে নেমেছেন। সরকারের বিরুদ্ধে স্লোগান, পোস্টার ছড়িয়েছে বিভিন্ন দিকে। সোমবার সকালে কাঠমান্ডুর বাণেশ্বর এলাকায় বিক্ষোভ শুরু হয়। পরে সেই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে কাঠমান্ডুর বিভিন্ন দিকে।
কার্ফু জারি, গুলি পুলিশের
বিক্ষোভ যাতে না ছড়াতে পারে তাই নেপালের সংবেদশীল এলাকায় কার্ফু জারি করা হয়েছে। পুলিশ, সেনা মিলিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা চলছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ আনতে গুলি চালায় পুলিশ। আন্দোলনকারীদের অভিযোগ, ‘‘আমাদের শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু পুলিশ এগিয়ে আসতেই সহিংসতার চেহারা নেয়।’’ এক বিক্ষোভকারীর কথায়, ‘‘আমরা যত এগিয়েছি, ততই পুলিশের সহিংসতা দেখতে পেয়েছি। পুলিশ জনগণের উপর গুলি চালাচ্ছে, যা শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের মূলনীতির পরিপন্থী। যাঁরা ক্ষমতায় বসে আছেন, তাঁরা আমাদের উপর এ ভাবে কিছু চাপিয়ে দিতে পারেন না।’’
বিক্ষোভের নেপথ্যে অন্য কারণ?
ফেসবুক-সহ অন্যান্য সমাজমাধ্যম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞার জন্যই এই প্রতিবাদ, এমনটা মনে করছেন না অনেকেই। কারণ নেপালের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কয়েক দিন ধরেই দুর্নীতির অভিযোগ উঠছিল। দেশে আর্থিক বৈষম্য নিয়েও ক্ষোভ বাড়ছিল ছাত্র-যুবদের মধ্যে। মনে করা হচ্ছে, আগে থেকে পুঞ্জীভূত হওয়া ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে রবিবার। নেপাল সরকারের অবশ্য দাবি, দেশকে সুরক্ষিত রাখতেই সমাজমাধ্যমগুলির বিরুদ্ধে কড়া পদক্ষেপ করা হয়েছে। যদিও বিক্ষোভকারীদের দাবি, বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন করতেই ওই কাণ্ড ঘটিয়েছে সরকার।
কেন নিষেধাজ্ঞা জারি?
গত ২৮ অগস্ট নেপাল সরকার জানিয়েছিল, সমাজমাধ্যমগুলিকে পরবর্তী সাত দিনের মধ্যে সরকারের খাতায় নাম নথিভুক্ত করাতে হবে। ৩ অগস্ট সেই সময়সীমা শেষ হয়। অধিকাংশ সমাজমাধ্যমই নেপালের সরকারি নির্দেশ মানেনি। ৪ অগস্ট ফেসবুক, এক্স, হোয়াট্সঅ্যাপ-সহ ২৬টি সমাজমাধ্যম ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। দেশের যুবসমাজের মধ্যে ক্ষোভের আঁচ পেয়ে আগেই নেপালের নানা অংশে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ করেছিল সে দেশের সরকার। তবে টিকটক নিয়ে নিষেধাজ্ঞা না থাকায় সেটির মাধ্যমে পারস্পরিক যোগাযোগ বাড়িয়ে তোলেন প্রতিবাদীরা।