রজার ফেডেরার এক বার বলেই ফেলেছিলেন, ‘‘দূর আর ভাল লাগছে না। নাদালের বদলে এ বার একটু অন্য কারও সঙ্গে আমার লড়াই হোক।’’ ইয়ানিক সিনার রবিবার ইউএস ওপেনের ফাইনালে নামার আগে বুঝতে পারছেন না, তাঁর ভাল লাগছে, না খারাপ!
উল্টো দিকে কার্লোস আলকারাজ়। র্যাঙ্কিংয়ে এক নম্বর সিনারের সঙ্গে দু’নম্বর আলকারাজ়ের লড়াই। এই নিয়ে পর পর তিনটি গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনালে মুখোমুখি এই দু’জন। ফেডেরার-উবাচ মনে করিয়ে দিতে সিনার বলেছেন, ‘‘জানি না খারাপ লাগছে, না ভাল লাগছে। তবে রজার যদি এই কথা বলে থাকে, তা হলে বলব, আমাদের চিন্তা-ভাবনা এক।’’
বিষয়টা চিন্তার। ভাবনারও।
ফেডেরার এবং নাদালের অবসরের পর পুরুষদের টেনিস সার্কিট আর একটা যুদ্ধের রসদ খুঁজছিল, যাদের মাধ্যমে কোর্টে একের পর এক মহাকাব্য তৈরি হবে। ভোররাতে শেষ হওয়া সেই উইম্বলডন ফাইনালের মতো আরও বহু রূপকথা তৈরি হবে।
তিন বছর আগে এই ইউএস ওপেনেই নতুন রূপকথা লেখা শুরু। সে দিন টেনিসবিশ্ব প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছিল, ফেডেরার বনাম নাদাল লড়াইয়ের স্বাদ পাওয়া যাবে সিনার বনাম আলকারাজ় দেখে। ২০২২ সালের সেই ইউএস ওপেন কোয়ার্টার ফাইনালে আলকারাজ় জিতেছিলেন ৬-৩, ৬-৭ (৭), ৬-৭ (০), ৭-৫, ৬-৩ গেমে। পাঁচ সেটের লড়াই দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল, আহা, এই তো মহাকাব্য লেখা শুরু হল।
কিন্তু মহাকাব্যই হোক বা রূপকথা, যে উপাদানটির অভাব তখন বোঝা যায়নি, তা হল শক্তিশালী পার্শ্বচরিত্র। ফেডেরার-নাদাল যুগে ছিলেন নোভাক জোকোভিচ নামক এক জন। যিনি এখনও খেলা ছাড়ার কথা ভাবতে পারছেন না। যিনি ২৪টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জিতে শেষ পর্যন্ত ফেডেরার (২০), নাদালকে (২২) টপকে গিয়েছেন। ছিলেন দুই অ্যান্ডি— মারে এবং রডিক। কিন্তু সিনার-আলকারাজ় যুগে আলেকজান্ডার জ়েরেভ, টেলর ফ্রিৎজ়, লরেঞ্জো মুসেত্তি, দানিল মেদভেদেভরা পার্শ্ব ভূমিকায় দুর্বল।

তাই এ বারের ফরাসি ওপেনে সিনার-আলকারাজ় পাঁচ সেটের ফাইনাল, বা তার পর উইম্বলডনে চার সেটের ফাইনাল দেখেও প্রশ্ন উঠেছিল, মন কি ভরল? লড়াইয়ে মশলা তো কম নেই। ঘাস, সুরকি বা সিন্থেটিক যেকোনও কোর্টেই দু’জন সমান শক্তিশালী। অথচ, দু’জনের খেলার ধরন ভিন্ন। আর কী চাই! কিন্তু চাই প্রতিদ্বন্দ্বিতা, যা জ়েরেভ-মেদভেদেভদের দিয়ে হচ্ছে না। তাই পর পর তিনটি গ্র্যান্ড স্ল্যামের ফাইনালে বোধ হয় আর এই লড়াই দেখতে ভাল লাগছে না। এ বারের নিউ ইয়র্ক তাই বছরের শেষ গ্র্যান্ড স্ল্যাম নিয়ে এতটা নিরুৎসাহিত। যেটুকু উৎসাহ, তার পুরোটাই ১০ বছর পর মার্কিন প্রেসিডেন্টের খেলা দেখতে আসা নিয়ে।
সিনার আর আলকারাজ় মিলে নিয়ম করে গ্র্যান্ড স্ল্যামের প্রথম ছ’টি রাউন্ড অপ্রাসঙ্গিক করে দিচ্ছেন। প্রতি বছর ২১ জুলাই তৃণমূলের সভার মতো। অপেক্ষা শুধু ফাইনাল বক্তার জন্য। ফলে সব মিলিয়ে বিরাট ঝুঁকির সামনে হঠাৎ একঘেয়ে, বোরিং লাগতে শুরু করা ছেলেদের টেনিস।
টেনিসের ওপেন যুগে এটিই প্রথম ঘটনা, যেখানে একই বছর তিনটি স্ল্যাম ফাইনালে একই জুটি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। শেষ যে চারটি প্রতিযোগিতায় সিনার এবং আলকারাজ় খেলেছেন, তার সবকটির ফাইনালেও উঠেছেন তাঁরা। প্রতিদ্বন্দ্বিতা বলতে যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে, তা শুধু ৩৮-এর জোকোভিচের থেকেই। কিন্তু টেনিসে এমন এক জন তরুণ খেলোয়াড়ের আশু প্রয়োজন, যিনি এই দু’জনের আধিপত্যে ভাগ বসাবেন। দ্রুত প্রয়োজন এক জন জোকোভিচের।
খোদ জোকারও একমত। বলেছেন, ‘‘নিঃসন্দেহে ওদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা এই মুহূর্তে সেরা। এবং মনে হচ্ছে এরকমই চলবে। কিন্তু আমার নজর তৃতীয় কারও দিকে। কারণ, ফেডেরার এবং নাদালের যুগে আমি তৃতীয় ছিলাম। আমি সেই তৃতীয় খেলোয়াড়কে দেখতে চাই। জোকার সেই সময় যে ভূমিকা নিয়েছিল, সেই ভূমিকা এখন নিক, এমন খেলোয়াড়কে চাই।’’
সম্প্রতি জয় শেঠির পডকাস্টে জোকোভিচ তাঁর সঙ্গে ফেডেরার, নাদাল এবং মারের প্রতিযোগিতা নিয়ে বলেছেন। এই চার জনের মধ্যে মানসিক ভাবে তিনি নিজেকে সবচেয়ে শক্তিশালী বলেছেন। শারীরিক দিক দিয়ে এগিয়ে রেখেছেন নাদালকে। তাঁর বলার রসদ ছিল, মশলা ছিল। এখন আর কোনও ‘ফ্যাব ফোর’ নেই। রয়েছেন ‘বোরিং টু’ সিনার আর আলকারাজ়।
রবিবারের ফাইনালটা খেলতে ভাল লাগছে, না খারাপ লাগছে, সিনার জানেন না। কিন্তু তিনি কি সত্যিই চাইছেন, তাঁর এবং আলকারাজ়ের মাঝে তৃতীয় কোনও শক্তি উঠে আসুক? সিনারের জবাব, ‘‘জানি না আমরা দু’জনেই খুশি কি না। কিন্তু এটুকু জানি, আমি চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসি। যদি কেউ আমার মধ্যে থেকে সেরা খেলাটা বের করে আনতে পারে, আমার জন্য তার থেকে ভাল আর কিছু হতে পারে না।’’
সিনার হয়তো শেষে বুঝতে পেরেছেন, ২০২৫ সালের টেনিসের মতোই বোরিং হয়ে যাচ্ছে তাঁর জবাবও। তাই বলেছেন, ‘‘মাঝে মাঝে একটু অন্য লড়াই হলেও মন্দ হয় না।’’
‘অন্য লড়াই’ দেখতে চাইছে টেনিস। তাই ইউএস ওপেন শেষ হওয়ার আগেই সকলের নজর পরের প্রতিযোগিতার দিকে। সকলের বিরক্তিকর প্রতীক্ষা, রবিবারটা কবে যাবে! সকলের একটাই চাহিদা, পরের বছর যেন শুরু থেকেই সিনার বনাম আলকারাজ় দেখতে না হয়।