একশো-দুশো কোটি নয়, একেবারে ২২,৯১৬ কোটি টাকা!
কোনও দেশের জিডিপি বা কোনও ব্যবসায়িক চুক্তি নয়, এই অর্থ খরচ করেছে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের (ইপিএল) ছ’টি ক্লাব। ফুটবলার কিনতে এত টাকা আগে কবে খরচ হয়েছে, মনে করা কঠিন। তাই শুক্রবার থেকে শুরু হতে চলা ইপিএলে লড়াইটা এ বার শুধু মাঠে নয়, মাঠের বাইরেও। মরসুম শেষে হিসাব হবে, কোন দল সোনার ফসল ফলিয়েছে, আর কোন দলের অর্থ পুরোটাই জলে।
ছয় দলের প্রত্যেকের কাছেই টাকা খরচের নিজস্ব কারণ রয়েছে। আর্নে স্লটের আমলে লিভারপুল যেমন নিজেদের জায়গা আরও শক্ত করতে চেয়েছে, তেমনই কেভিন দ্য ব্রুইনের বিকল্প খুঁজেছে ম্যাঞ্চেস্টার সিটি। প্রতিবেশী ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেড এক যুগ ব্যপী দুর্দশা কাটাতে মরিয়া। আর্সেনাল চাইছে দ্বিতীয় স্থানের গেরো কাটিয়ে এ বার ট্রফি হাতে তুলতে। টটেনহ্যাম হটস্পার নতুন আশা নিয়ে তাকিয়ে কোচ টমাস ফ্রাঙ্কের দিকে।
ইতিহাস ছোঁয়ার স্বপ্ন লিভারপুলের
অনেক উত্থান-পতনের পর গত বার ইপিএল জিতেছিল লিভারপুল। ট্রফিজয়ের নিরিখে ছুঁয়ে ফেলেছে ম্যান ইউকে। স্লটের দ্বিতীয় মরসুমে ট্রফি ধরে রাখতে মরিয়া তারা। গত মরসুমের ট্রফি তোলার ঠিক ৮২ দিন পরে নতুন মরসুম শুরু হচ্ছে লিভারপুলের খেলা দিয়েই। প্রতিপক্ষ বোর্নমাউথ। ট্রফি জিতলেও এ বার সবচেয়ে বেশি খরচ করেছে তারাই। ট্রেন্ট আলেকজ়ান্ডার আর্নল্ড চলে গিয়েছেন রিয়াল মাদ্রিদে। ডারউইন নুনেজ় পাড়ি দিয়েছেন সৌদি আরবের আল হিলালে। অকালে গাড়ি দুর্ঘটনায় প্রয়াত হয়েছেন দিয়োগো জোতা। এই তিন জনের অভাব পূরণ করাই চ্যালেঞ্জ ছিল তাদের।
১৯৮৪-র পর লিভারপুর কখনও টানা দু’বার ইপিএল জিততে পারেনি। এ বার যে তারা এতটা মরিয়া, সেটা বোঝা যায়নি আগে। দীর্ঘ দিন ধরেই ফ্লোরিয়ান উইর্ৎজ় তাদের নজরে ছিল। বায়ার লেভারকুসেন থেকে ১৩৭৭ কোটি টাকায় জার্মান ফুটবলারকে কিনেছে তারা। এখনও পর্যন্ত এটাই এ বারের প্রিমিয়ার লিগে কোনও ফুটবলারের সর্বোচ্চ মূল্য। এখানেই থামেনি তারা। লেভারকুসেন থেকে তুলে নিয়েছে জেরেমি ফ্রিমপংকে। ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে ৯৩৭ কোটিতে নিয়েছে হুগো একিতিকেকে। এসেছেন মিলোস কেরকেজ়ও। ট্রান্সফার উইন্ডোতে ৩৪৫৪ কোটি টাকা খরচ করেছে লিভারপুল। যদি তারা নিউক্যাসল থেকে আলেকজ়ান্ডার ইসাককে নিতে পারে, তা হলে পরের মরসুমে লিভারপুলকে থামানো সবচেয়ে কঠিন কাজ হতে চলেছে।
নিজেকে প্রমাণ করার চাপ গুয়ার্দিওলার
টানা চার বার ইপিএল জিতেছিল ম্যান সিটি। গত বারও চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দৌড়ে ছিল। কিন্তু মাঝ-মরসুম থেকে তারা এমন ভাবে হোঁচট খেতে থাকে, সামাল দেওয়া সম্ভব হয়নি শেষ দিকে। দলের প্রথম সারির ফুটবলারদের বেশির ভাগের চোট এবং ঠাসা সূচি পেপ গুয়ার্দিওলার কাজ কঠিন করে দেয়। স্পেনীয় কোচ এ বার প্রমাণ করতে মরিয়া যে, তিনি ফুরিয়ে যাননি। কেভিন দ্য ব্রুইন ক্লাব ছেড়েছেন। চোটের কারণে এখনও কয়েক মাস পাওয়া যাবে না বাল দ্যঁর জয়ী রদ্রিকে। এই অবস্থায় রায়ান আইত-নুরি, রায়ান চেরকি, টিয়ানি রেইন্ডার্স, ভেরে নাইপানকে নিয়েছে তারা। খরচ হয়েছে ১৭৫১ কোটি।
কাপ ও ঠোঁটের দূরত্ব মেটাতে মরিয়া আর্সেনাল
বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল মিকেল আর্তেতা কোচিং করাচ্ছেন। আর্সেনালের সুদিন ফিরেছে। কিন্তু কাপ আর ঠোঁটের দূরত্ব রয়েই গিয়েছে। মিটেও মিটছে না। এ বার সেই দূরত্ব আর রাখতে চাইছে না গানার্সরা। গোলের অভাব মেটাতে ৭৫৯ কোটি টাকায় কিনেছে ভিক্টর গিয়োকেরেসকে। গত বার ইউরোপের সব লিগ মিলিয়ে সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন সুইডেনের এই ফুটবলার। চেলসি থেকে নিয়েছে নোনি মাদুয়েকেকে। মিডফিল্ড জমাট রাখতে রিয়াল সোসিয়েদাদ থেকে নিয়েছে মার্তিন জ়ুবিমেন্দিকে। এ ছাড়া এসেছেন গোলকিপার কেপা আরিজ়াবালাগা, ক্রিশ্চিয়ান নরগার্ড এবং ক্রিশ্চিয়ান মসকেরা। মরসুমের মাঝপথে ছন্দ হারানোর জন্য ‘সুনাম’ রয়েছে আর্সেনালের। এ বার সেটা আটকানোই লক্ষ্য।
শীর্ষে ফেরাই লক্ষ্য চেলসির
মালিকানা বদলানোর পর থেকে চেলসি সমর্থকেরা বার বার অভিযোগ করেছেন, মালিক টড বোহেলি দল গঠনের ব্যাপারে মাথাই ঘামান না। এ বার চেলসি দলগঠন করতে ২৮০২ কোটি খরচ করেছে (ইপিএলে দ্বিতীয়)। নিয়েছে লিয়াম ডেলাপ, মামাদৌ সার, জোয়াও পেদ্রো, এস্তেভাওয়ের মতো প্রতিভাবান ফুটবলারদেকে। গত মরসুমে কনফারেন্স লিগ জেতার পর কিছু দিন আগে ক্লাব বিশ্বকাপ জিতেছে তারা। ইউরোপ সেরা পিএসজি-কে তিন গোল দিয়েছে। ফলে এনজ়ো মারেস্কাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন সমর্থকেরা। এ বার লক্ষ্য ইপিএল।
ম্যান ইউয়ের সামনে লম্বা রাস্তা
দিন বদলের স্বপ্ন দেখিয়ে গত মরসুমের মাঝপথে কোচ হয়ে এসেছিলেন রুবেন আমোরিম। তখন লিগ তালিকায় ম্যান ইউ যেখানে ছিল, মরসুম শেষের পর আরও তিন ধাপ নেমে ১৫-তে শেষ করেছে। তবে ম্যান ইউ কর্তৃপক্ষ আস্থা রেখেছেন পর্তুগিজ কোচের উপরে। এমনকি, দলবদলের বাজারে ২৪৯৮ কোটি টাকা (ইপিএলে তৃতীয়) খরচও করেছে লাল ম্যাঞ্চেস্টার। ইপিএলের অভিজ্ঞ দুই খেলোয়াড় ম্যাথেউস কুনহা এবং ব্রায়ান এমবিউমোকে সই করিয়েছে। লাইপজিগ থেকে ৮৭৫ কোটি টাকায় কিনেছে বেঞ্জামিন সেসকোকে। অ্যালেক্স ফার্গুসনের আমলে যে দাপট ম্যান ইউ দেখাত, তা এ বারও পারবে কি না সেটা সময় বলবে। তবে দল দেখে বিশেষজ্ঞদের মতামত, পয়েন্ট তালিকায় উপরে শেষ করলেও ট্রফিতে এখনই হাত রাখা হবে না ম্যান ইউয়ের। আমোরিম কী ভাবে দলকে চালান, নতুন ফুটবলারেরা কতটা পরিশ্রম করেন তার উপর অনেক কিছু নির্ভর করছে।
গত মরসুমে ম্যান ইউয়ের দু’ধাপ নীচে, ১৭ নম্বরে শেষ করেছিল টটেনহ্যাম। এ বার মহম্মদ কুদুস বাদে নামকরা কোনও ফুটবলার নেয়নি তারা। উল্টে সন হিউং মিন ক্লাব ছেড়েছেন। তবে কোচ ফ্রাঙ্কের অধীনে তারাও স্বপ্ন দেখছে সুদিনের।
দ্বিতীয় ডিভিশন থেকে ইপিএলে উঠে আসা সান্ডারল্যান্ডও প্রচুর অর্থ খরচ করেছে দলগঠনে। ইপিএলে উঠে আসা অপর দুই দল লিডস এবং বার্নলেও পিছিয়ে নেই। এ ছাড়া চমকে দিতে তৈরি নিউক্যাসল, নটিংহ্যাম ফরেস্টের মতো দলও। ট্রফি কার হাতে উঠবে, তা অবশ্য জানা যাবে ন’মাস পরে।