অলিম্পিক্স থেকে বিশ্বকাপ, ক্রীড়ার ক্ষেত্রকে বার বার প্রতিবাদের মঞ্চ করেছে জনতা, ক্ষোভের স্রোতে ফের শামিল লাল-হলুদ গ্যালারি!

১৯৬৮ সালের মেক্সিকো অলিম্পিক্স। কৃষ্ণাঙ্গদের মানবাধিকারের দাবিতে প্রতিবাদ করেছিলেন দুই অ্যাথলিট টমি স্মিথ ও জন কার্লোস। ২০০ মিটারে সোনাজয়ী স্মিথ ও ব্রোঞ্জজয়ী কার্লোস পদক নেওয়ার সময় জুতো ছাড়া পায়ে কালো মোজা পরে এসেছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গদের দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের প্রতি সমর্থন জানাতে সেই ‘বিবৃতি’ দিয়েছিলেন তাঁরা। আমেরিকার জাতীয় সঙ্গীত হওয়ার সময় তাঁদের মাথা ছিল নিচু। কালো দস্তানা পরা মুষ্টিবদ্ধ হাত তোলা ছিল আকাশের দিকে।

‘কোল্ড ওয়ার’-এর আবহে ১৯৮০ সালের মস্কো অলিম্পিক্স আমেরিকা-সহ ৬০টি দেশ বয়কট করেছিল।

২০১৯ সালের ক্রিকেট বিশ্বকাপে ভারত-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ চলাকালীন আকাশপথে উড়ে গিয়েছিল ‘জাস্টিস ফর কাশ্মীর’ এবং ‘ইন্ডিয়া স্টপ জ়েনোসাই়ড অ্যান্ড ফ্রি কাশ্মীর’ লেখা ব্যানার নিয়ে ছোট বিমান। একই ভাবে ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া সেমিফাইনালে এজবাস্টনের মাঠের উপরের আকাশে উড়ন্ত বিমান থেকে উড়তে-থাকা ব্যানার দেখা গিয়েছিল। যাতে লেখা, ‘ওয়ার্ল্ড মাস্ট স্পিক আপ ফর বালুচিস্তান’।

Protest during ICC Cricket World Cup 2019

২০২০ সালে আমেরিকার মিনেপোলিসে পুলিশের হাতে শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গিয়েছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড। গোটা বিশ্ব উদ্বেল হয়েছিল ‘ব্ল্যাক লাইভ্‌স ম্যাটার’ আন্দোলনে। ম্যাডোনা, জেনিফার লোপেজ়, রিহানা, আরিয়ানা গ্রান্দের মতো বিনোদন দুনিয়ার তারকাদের সঙ্গে সেই প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন মাইকেল জর্ডন, সেরিনা উইলিয়ামস, লেব্রন জেমস, নেওমি ওয়াকা, সিমোনে বাইল্‌স, মাইকেল হোল্ডিংয়ের মতো ক্রীড়াবিদেরা। বিশ্বের নানা প্রান্তে বিভিন্ন খেলার সঙ্গে যুক্ত খ্যাতনামীরা ম্যাচ শুরুর আগে হাঁটু মুড়ে বসতেন। কারণ, ওই ভঙ্গিতেই ফ্লয়েডের গলায় হাঁটু বসিয়ে তাঁর শ্বাসরোধ করেছিলেন এক শ্বেতাঙ্গ পুলিশ অফিসার।

Michael Jordan

বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বহুদিন ধরে খেলার মাঠ প্রতিবাদের মঞ্চে পর্যবসিত হয়েছে। কখনও মাঠ। কখনও গ্যালারি। স্কটিশ লিগে প্যালেস্টাইনের পতাকা উড়েছে। লিভারপুলের ম্যাচে রাজনৈতিক প্রতিবাদ দেখা গিয়েছে। ১৯৩০ সালের বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন উরুগুয়ে পরের প্রতিযোগিতায় খেলেনি। প্রকাশ্যে এসে পড়েছিল লাতিন আমেরিকা-ইউরোপ সংঘাত। ১৯৭৪ সালের বিশ্বকাপে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন খেলেনি চিলের সঙ্গে। গত বছর ফ্রান্স-ইজ়রায়েল ম্যাচের আগে প্যারিসের রাস্তায় প্রতিবাদে নেমেছিলেন ফরাসিরা। ১৯৬৭ সালে মহম্মদ আলির রাজনৈতিক প্রতিবাদ আলোড়ন ফেলেছিল গোটা বিশ্বে। ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় নিয়ম ভেঙে তিনি আমেরিকার সেনাবাহিনীতে যোগ দেননি। ‘ওয়ার্ল্ড বক্সিং অ্যাসোসিয়েশন’ তাঁর হেভিওয়েট খেতাব ছিনিয়ে নিয়ে আলিকে চার বছরের জন্য নির্বাসিত করেছিল। আমেরিকার নিম্ন আদালত পাঁচ বছরের কারাবাসের শাস্তি দিয়েছিল তাঁকে। তবে সে দেশের সুপ্রিম কোর্ট সেই নির্দেশ খারিজ করে দেয়।

Muhammad Ali

ভারতবর্ষের খেলার মাঠে এমন চড়াদাগের প্রতিবাদ অতীতে খুব বেশি দেখা যায়নি। তবে সাম্প্রতিক কালে কলকাতা শহর প্রতিবাদের মঞ্চ হিসাবে একাধিক বার ফুটবল ম্যাচের গ্যালারিকে বেছে নিয়েছে। ২০২০ সালে এনআরসি-র সময় ডার্বির গ্যালারিতে ‘রক্ত দিয়ে কেনা মাটি, কাগজ দিয়ে নয়’ ব্যানার উড়েছিল। বুধবার ডুরান্ড কাপে ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচে গ্যালারি থেকে ঝোলানো হল বিশাল ব্যানার— ‘ভারত স্বাধীন করতে সে দিন পরেছিলাম ফাঁসি! মায়ের ভাষা বলছি বলে আজকে ‘বাংলাদেশী’?

এনআরসি এবং বাংলাদেশ— দু’টি বিষয়ের সঙ্গেই ইস্টবেঙ্গল জনতার যোগাযোগ আবেগের। ছিন্নমূল উদ্বাস্তু পরিবারের সদস্য এবং তাঁদের সন্তানসন্ততি মূলত ইস্টবেঙ্গলের সমর্থক। ফলে তাঁদের সঙ্গে বাংলাদেশের রক্তের টান আছে। দেশভাগের সময় তাঁরা বা তাঁদের পূর্বপুরুষেরা এই বাংলায় এসে বসতি গড়ে নিরন্তর লড়াই করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। আশ্চর্য নয় যে, তাঁরা প্রতিবাদে শামিল হবেন এবং তার মঞ্চ হিসাবে বেছে নেবেন ইস্টবেঙ্গল ম্যাচের গ্যালারিকে।

গত বছর আরজি করের ঘটনার পরে যৌথ প্রতিবাদে শামিল হয়েছিলেন মোহনবাগান এবং ইস্টবেঙ্গলের সমর্থকেরা। ওই ঘটনার পরে নাগরিক বিক্ষোভের আবহে এই ডুরান্ড কাপেরই ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ বাতিল করেছিল প্রশাসন। সেই বাতিল ম্যাচের দিনেও অঝোর বৃষ্টি উপেক্ষা করে যুবভারতীর আশেপাশে জড়ো হয়েছিলেন দুই প্রধানের সমর্থকেরা। যোগ দিয়েছিলেন কলকাতা ময়দানের তৃতীয় প্রধান মহমেডান ক্লাবের সমর্থকেরাও। পুলিশের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন তাঁরা। অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস। সে দিনের সেই প্রতিবাদে যোগ দিয়েছিলেন মোহনবাগানের অধিনায়ক শুভাশিস বসু। সবুজ-মেরুন ভক্তের কাঁধে দেখা গিয়েছিল লাল-হলুদ সমর্থককে। স্লোগান উঠেছিল, ‘আমাদের বোনের বিচার চাই।’ কলকাতা লিগের বিভিন্ন ম্যাচে গোলপোস্টের পিছনের গ্যালারিতে প্রতিবাদী ব্যানার-টিফো দেখা গিয়েছিল। তাতে লেখা থাকত, ‘তিলোত্তমার রক্ত চোখ, আঁধার রাতে মশাল হোক’।

East Bengal supporters with banners regarding RG Kar incident

ঘটনাচক্রে, যখন আরজি করের ঘটনার এক বছর পূর্ণ হতে চলেছে, তখন অন্য এক প্রশ্নে প্রতিবাদের মঞ্চ হয়ে উঠল ফুটবল মাঠের গ্যালারি। এই প্রতিবাদে অবশ্য এখনও পর্যন্ত শামিল শুধু ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরাই। ইতিহাস বলে, এ দেশে খেলার মাঠে প্রতিবাদীর ভূমিকায় ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদেরই বেশি দেখা গিয়েছে। বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের উপর হামলার খবরের সময় লাল-হলুদ গ্যালারিতেই দেখা গিয়েছে ব্যানার— ‘সংখ্যালঘুর রক্ত মুছে ফেললেই চলবে? দেশান্তরী স্মৃতিগুলো সব ঢাকতে তুমি কি পারবে?’

সন্দেহ নেই, এই প্রতিবাদে স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে পরিকল্পনাও মিশে থাকে। থেকেছে। ‘আলট্রাজ়’ নামে ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের একটি সংগঠন মূলত এই প্রতিবাদ সংগঠিত করে। তাদের অন্যতম সংগঠক কৃষ্ণেন্দু দত্ত বৃহস্পতিবার জানিয়েছেন, ভবিষ্যতেও তাঁরা দরকার পড়লে যে কোনও ‘সামাজিক বর্বরতা’-র বিরুদ্ধে এ ভাবেই প্রতিবাদ করবেন। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা যে কোনও ধরনের সামাজিক বর্বরতার বিরুদ্ধে সরব হই। এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাভাষীদের উপর আক্রমণ হচ্ছে। অনুপ্রবেশকারীদের অবশ্যই ফেরত পাঠানো হোক। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, বাংলা ভাষায় কথা বললেই তিনি বাংলাদেশি!’’

তবে ইস্টবেঙ্গলের এই সাম্প্রতিক প্রতিবাদ নিয়ে লাল-হলুদ সমর্থকদের মধ্যে ঈষৎ বিভাজনও তৈরি হয়েছে। একাংশ বলছেন, খেলার মাঠে কেন রাজনৈতিক প্রতিবাদ? রাজনীতি তো খেলার বিষয় হতে পারে না। অন্য অংশের যুক্তি, এই প্রতিবাদের সঙ্গে রাজনীতির যোগ নেই। এই প্রতিবাদ বাংলাভাষার প্রতি আবেগ থেকে। ‘ইস্টবেঙ্গল’ নামটির মধ্যে পূর্ববঙ্গ জড়িয়ে। সেই আবেগ থেকেই এই প্রতিবাদ।

আশ্চর্য নয় যে, ইস্টবেঙ্গলের প্রতিবাদী অংশের জনতাকে রাজ্যের শাসকদলের সঙ্গে জুড়ে দেওযা হচ্ছে। কারণ, বাংলাভাষার ‘অবমাননা’ নিয়ে সবচেয়ে সরব তৃণমূল। বস্তুত, এই বিষয়টিই যে আগামী বিধানসভা ভোটে তাদের ‘অন্যতম হাতিয়ার’ হতে চলেছে, তা-ও এখন স্পষ্ট। প্রতিবাদীরা অবশ্য মানছেন না, তাঁরা ‘তৃণমূল’। তাঁদের কথায়, যখন তাঁরা বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদ করেছিলেন বা আরজি কর কাণ্ডের প্রতিবাদ করেছিলেন, তখন তাঁদের ‘বিজেপিপন্থী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এখন যেমন বাংলাভাষার পক্ষে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করেছেন বলে সেই তাঁদেরই ‘তৃণমূল’ বলে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

তবে প্রতিবাদ যেমন দেশকালের গন্ডি মানে না, তেমনই প্রতিবাদের গায়ে রাজনীতির রং সহজে লাগে না। আশ্চর্য নয় যে, আন্দোলনকারীরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো সুবিধামতো অবস্থান বদলায়। কিন্তু প্রতিবাদীরা নিজেদের অবস্থানে অনড় থাকেন। সে কৃষ্ণাঙ্গ পীড়ন হোক বা প্যালেস্তাইন। আরজি কর হোক বা বাংলাভাষার অপমান!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.