প্রান্তিক স্টেশন শহিদ ক্ষুদিরামে আরাম অতীত! এখন শুধু পথের ক্লান্তি, দুর্ভোগ সঙ্গী নিত্যযাত্রীর

কবি সুভাষ স্টেশনের ঘড়িতে সকাল ৯টা ১৭ মিনিট। ৯টা ২০ মিনিটের দক্ষিণেশ্বরগামী আপ মেট্রো ধরার ভিড়। ভিড়ের মধ্যে মাঝবয়সি এক জন হঠাৎই প্ল্যাটফর্মে থুতু ফেললেন। সম্ভবত অভ্যাসে। বা বিরক্তিতে। অথবা হতাশায়। তাঁর কাঁধে ঝোলানো টিফিন বাক্সের ব্যাগ। হাতে প্লাস্টিকের থলে। উঁকি দিচ্ছে আকাশি রঙের জামা। বোঝা যাচ্ছিল, কোনও আবাসন বা শপিং মলে রক্ষীর কাজ করেন। স্টেশনের দেওয়ালে গুটখার লাল-খয়েরি দাগ। মনে হয়েছিল, এই স্টেশন থেকে কেন মেট্রো শুরু বা শেষ হয়!

ঘটনাচক্রে, সে দিন ছিল সোমবার। ঘটনাচক্রে, সে দিন দুপুরের পর থেকেই দক্ষিণেশ্বরগামী আপ লাইনে ব্যাহত হয়েছিল মেট্রো চলাচল। তার পরেই মেট্রো কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করেন, কবি সুভাষ স্টেশনের আপ প্ল্যাটফর্মের পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে। অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে দক্ষিণেশ্বর থেকে নিউ গড়িয়া সংলগ্ন কবি সুভাষ স্টেশন পর্যন্ত মেট্রো চলাচল।

দক্ষিণেশ্বর থেকে আগত মেট্রোর শেষ এবং প্রান্তিক স্টেশন এখন শহিদ ক্ষুদিরাম। সোম থেকে শুক্রবার— মেট্রোর ওই একটি ঘোষণার প্রভাব পড়েছে দক্ষিণে শহরতলি, মফস্‌সলের বাসিন্দা মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্তদের দৈনন্দিন যাপনে। মেট্রোর ওই এক ঘোষণাতেই বেড়ে গিয়েছে তাঁদের মাসিক খরচ। টাকার পাশাপাশি বেড়েছে সময় আর দুর্ভোগ। আগে যাঁরা নাকেমুখে ভাত গুঁজে বাড়ি থেকে বেরিয়ে ১০ মিনিটে মেট্রো স্টেশনে পৌঁছে যেতেন, এখন তাঁদের হাতে রাখতে হচ্ছে ৪০ থেকে ৪৫ মিনিট অতিরিক্ত সময়।

যেমন ক্যানিংয়ের উদয়কুমার সর্দার। কুঁদঘাটের এক সরকারি স্কুলের শিক্ষক উদয়কুমার ক্যানিং থেকে ট্রেনে নিউ গড়িয়া স্টেশনে নামতেন। স্টেশন থেকে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আবার সিঁড়ি বেয়ে উঠে পৌঁছোতেন কবি সুভাষ স্টেশনে। ভিড়ে ধাক্কাধাক্কি করে মেট্রোর দরজা পর্যন্ত পৌঁছোতে সময় লাগত মেরেকেটে সাত মিনিট। কিন্তু সে সব অতীত। এখন তিনি গড়িয়া স্টেশনে নেমে সেখান থেকে অটো ধরে পৌঁছোচ্ছেন শহিদ ক্ষুদিরাম স্টেশন। কবি সুভাষ থেকে শহিদ ক্ষুদিরামে মেট্রোয় চেপে পৌঁছোতে সময় লাগত দু’মিনিট। উদয়কুমার জানালেন, এখন অটোয় গড়িয়া স্টেশন থেকে শহিদ ক্ষুদিরাম স্টেশনের মধ্যে যাতায়াতে তাঁর সময় লাগছে প্রায় ৪০ মিনিট। তাঁর কথায়, ‘‘যানজটের চোটে একটা মেট্রো মিস্ করলাম। আজ (শুক্রবার) লেটমার্ক পড়ে যাবে স্কুলের খাতায়।’’ মিতা সর্দারের স্কুল সোনারপুরে। বাড়ি কুঁদঘাটে। সকালের স্কুল সেরে কবি সুভাষ থেকে মেট্রো ধরে ১৫ মিনিটে পৌঁছে যেতেন বাড়ি। এখন স্কুল থেকে ফেরার সময়ে ১৫ মিনিট মেট্রো-যাত্রার সঙ্গে যোগ হয়েছে অটোয় যাতায়াতের ৪০ মিনিট। মিতার কথায়, ‘‘চরম ভোগান্তি।’’

(বাঁ দিকে) ক্যানিং থেকে কুঁদঘাটের স্কুলে যাতায়াত করা উদয় কুমার সর্দার। সোনারপুরে স্কুল সেরে ফেরা মিতা সর্দার (ডান দিকে)।

মেট্রো কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন, এত দিন যে ভাবে মেট্রো চলাচল করেছে, তেমনই চলবে। মেট্রোর সময়সূচি বদলের কোনও সম্ভাবনা আপাতত নেই। তাই যাত্রী পরিষেবা বিঘ্নিত হওয়ারও প্রশ্ন উঠছে না। গোটা ব্যবস্থায় শুধু একটাই বদল— মেট্রো আর কবি সুভাষ পর্যন্ত যাবে না। যাবে শহিদ ক্ষুদিরাম পর্যন্ত। কুঁদঘাটের এক সরকারি স্কুলের শিক্ষিকা মৌমিতা ঘোষ মজুমদারের কথায়, ‘‘সমস্যা তো সেখানেই। মেট্রোর সময়সূচিতে পরিবর্তন না হলে কী হবে? আমাদের সময়সূচি তো ঘেঁটে গিয়েছে।’’ তাঁর প্রশ্ন, মেট্রো সময়ে চলতে পারে। কিন্তু লোকজন সময়মতো মেট্রো ধরবেন কী করে? শহিদ ক্ষুদিরামে পৌঁছোতেই কালঘাম ছুটে যাচ্ছে। ওই এলাকায় পরিকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থার হাল তো ভাল নয়।

যাত্রীদের সমস্যার কথা বুঝতে হলে শহিদ ক্ষুদিরাম স্টেশনের অবস্থান বুঝতে হবে। শহিদ ক্ষুদিরাম মেট্রো স্টেশনের গা ঘেঁষে একটি রাস্তা সোজা চলে গিয়েছে গড়িয়া স্টেশনে। সেই রাস্তায় মুখোমুখি দু’টি অটো চললে পাশে খুব বেশি জায়গা থাকে না। এবং সেই রাস্তায় শুধু অটো চলে না। চলে ‘ছোটা হাতি’ থেকে স্কুলে যাতায়াতের টাটা সুমো। গড়িয়া স্টেশনগামী এই রাস্তা কেটে বেরিয়ে গিয়েছে ‘বিশ্ববাংলা সরণি’ অর্থাৎ বাইপাসের মূল রাস্তাকে। ওই রাস্তা রাজপুর-সোনারপুর, নরেন্দ্রপুর থেকে কামালগাজি হয়ে সোজা পাটুলি, রুবি, চিংড়িহাটা পেরিয়ে চলে গিয়েছে উল্টোডাঙা মোড়।

রাস্তার যানজট ঠেলে শহিদ ক্ষুদিরাম স্টেশনে এসে দাঁড়িয়েছেন যাত্রীরা। অপেক্ষা দক্ষিণেশ্বরগামী মেট্রোর।

যেখানে বিশ্ববাংলা সরণিকে কাটছে গড়িয়া স্টেশনের ওই রাস্তা, সেই ঢালাই ব্রিজ এলাকায় এখন দিনরাত যানজট। ভুক্তভোগী যাত্রীরা জানাচ্ছেন, রুবি এবং হাইল্যান্ড পার্ক এলাকার লোকজন এখন সরাসরি বাসে চেপে ওই ঢালাই ব্রিজে নামছেন। তার পর রাস্তা পেরিয়ে শহিদ ক্ষুদিরাম থেকে মেট্রো ধরছেন। সেই রাস্তা পারাপারের জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে গড়ে সাত মিনিট। অন্য দিকে, ক্ষুদিরাম স্টেশনের গেট থেকে ছাড়ে গড়িয়া স্টেশনগামী অটো। সেই অটোকেও গন্তব্যে পৌঁছোতে গেলে এই ঢালাই ব্রিজ ক্রসিংয়ের যানজট পেরোতে হচ্ছে।

সিএবি-তে চাকরিরত এবং হাইল্যান্ড পার্ক এলাকার বাসিন্দা এক নিত্যযাত্রীর কথায়, ‘‘আগে রুবি থেকে আসা মেট্রোয় চাপতাম সত্যজিৎ রায় স্টেশন থেকে। তিন মিনিটে পৌঁছে যেতাম কবি সুভাষ। সেখান থেকে মেট্রো বদলে চলে যেতাম এসপ্ল্যানেডে। এখন ৩০ মিনিটেও শহিদ ক্ষুদিরামে পৌঁছোতে পারছি না। বাসের জন্য দাঁড়াতে হচ্ছে। ভিড় বাসে উঠছি ঠেলেঠুলে। নেমে ঢালাই ব্রিজ পার করতে সময় লাগছে ১০ মিনিট। খরচও বেশি।’’ স্কুল শিক্ষিকা মৌমিতাও জানালেন, তাঁর স্বামী বাইকে চাপিয়ে গড়িয়া স্টেশন এলাকা থেকে শহিদ ক্ষুদিরামে নামিয়ে দিয়ে যান। কিন্তু ঢালাই ব্রিজের ক্রসিং পার হতেই ১৫ মিনিট লেগে যায়। তার উপর খানাখন্দ ভরা রাস্তা! মৌমিতার প্রশ্ন, ‘‘এ ভাবে কি মেট্রো ধরা সম্ভব?’’ শোভাবাজারের এক স্কুলের শিক্ষিকা নিতু মণ্ডল জানালেন, গড়িয়া স্টেশন থেকে অটোয় লাইন দিয়ে জায়গা পাওয়া, তার পরে যানজটে আটকে থাকা যেমন ঝক্কি, তেমনই সময় নষ্ট। তাই আধ ঘণ্টা ধরে হেঁটে তিনি পৌঁছোচ্ছেন শহিদ ক্ষুদিরাম স্টেশনে।

প্রান্তিক স্টেশন বদলে যাওয়ায় গড়িয়া স্টেশন থেকে শহিদ ক্ষুদিরাম রুটের অটোচালকেরা কি লাভের মুখ দেখছেন? না। অটোচালক সুপ্রতিম মোদক বললেন, ‘‘আগে দুটো স্টেশনের মধ্যে যাতায়াতে ১৫ মিনিট লাগত। সোমবারের পর থেকে গড়ে ৪৫ মিনিট সময় লাগছে। ভাগ্য ভাল থাকলে আধ ঘণ্টা। সব তো রাস্তাই খেয়ে গেল!’’ তাঁর কটাক্ষ, ‘‘আমাদের ভাগ্য ট্র্যাফিক পুলিশদের হাতে! যদি কখনও সদয় হয়ে এই দিকের গাড়ি আগে ছাড়েন! ওঁদের অবশ্য বাইপাসে চলাচলকারী গাড়ির উপরই বেশি দয়া।’’ আর এক অটোচালকের আক্ষেপ, এই এলাকায় চারটি স্কুল রয়েছে। সেই স্কুলের বাচ্চাগুলোর কথা কেউ ভাবে না। রোজ তারা দেরি করে স্কুলে যাচ্ছে।

শহরতলি থেকে বহু মানুষ সাইকেলে বা কেউ কেউ বাইকে (যদিও সেই সংখ্যাটা কম) করে এসে কবি সুভাষ স্টেশনের কাছে গ্যারেজে সেগুলি রেখে মেট্রো ধরে কাজে যেতেন। তাঁরা এখন শহিদ ক্ষুদিরামের গ্যারেজে দু’চাকা রাখছেন। ফলে এত দিন যাঁরা ওই স্টেশনে সাইকেল বা বাইক রাখতেন, তাঁদের আর জায়গা হচ্ছে না। শহিদ ক্ষুদিরাম স্টেশনের প্রবেশপথের উল্টো দিকেই রয়েছে একটি গ্যারেজ। তার কর্মী সন্তোষ মণ্ডল বললেন, ‘‘এখন সাইকেল রেখে আর স্কুটার রাখার জায়গা থাকছে না। পুরো জায়গাটা খেয়ে নিয়েছে সাইকেল। পুরনো খদ্দেররা এসে ঝামেলা করছেন। আমরা কী করব? আগে এলে তো জায়গা দিতেই হবে। আর কবি সুভাষের যাত্রীরা তো সাইকেলেই আসেন।’’

‘কবি সুভাষ’-এর নিত্যযাত্রীদের নিয়ে সমস্যায় পড়েছেন মেট্রোর রক্ষীরাও। এক মহিলা রক্ষী যেমন বললেন, ‘‘এঁরা তো ট্রেন থেকে নামেন একগাদা মাল নিয়ে। ওখানে চেক করার বালাই নেই। এখানেও তাই করছেন। সোজা দৌড়ে ঢুকে যাচ্ছেন। দাঁড় করিয়ে চেক করাও মুশকিল। লাইন স্টেশনের বাইরে চলে যাচ্ছে। ভয় লাগছে, কবে আবার কী হয়! দোষ তো আমাদের হবে!’’

মেট্রো সূত্রে জানা গিয়েছে, কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম সংস্কারের জন্য ৯.৪ কোটি টাকার দরপত্র (ই-টেন্ডার) আহ্বান করা হয়েছে। রেলের কোনও সংস্কার বা মেরামতির কাজে খরচ ১০ কোটি টাকার বেশি হলে তাতে ছাড়পত্র দিতে হয় রেলবোর্ডকে। সেইমতো বৃহস্পতিবার বোর্ডের আধিকারিকেরা দিল্লি থেকে এসে কবি সুভাষ মেট্রো স্টেশন পরিদর্শনও করেছেন। এক আধিকারিক জানিয়েছেন, সংস্কার বা নতুন করে তৈরি, যা-ই হোক না কেন, তার বরাদ্দ স্থির করার জন্য এই পরিদর্শন জরুরি ছিল। একাধিক ঠিকাদারকে কাজের দায়িত্ব দেওয়ার হতে পারে বলেও ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। তাই আরও কয়েক বার দরপত্র আহ্বান করার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে মেট্রো কর্তৃপক্ষের একাংশের অবশ্য বক্তব্য, তাঁরা এ নিয়ে তাড়াহুড়ো করতে চাইছেন না। প্রয়োজনে পুরো স্টেশন আবার নতুন করে গড়া হতে পারে বলেও খবর। তবে রেলের তরফে এ বিষয়ে কিছু নিশ্চিত করে জানানো হয়নি। সূত্র শুধু বলছে, সংস্কারের কাজ শুরু হবে পুজোর পরে।

যাত্রীদের এখন একটাই প্রশ্ন, কবে থেকে কবি সুভাষ স্টেশন থেকে চালু হবে মেট্রো চলাচল। ক্যানিং, জয়নগর, ডায়মন্ড হারবার-সহ দক্ষিণ ২৪ পরগণার প্রত্যন্ত অঞ্চলের বহু বাসিন্দা গড়িয়া স্টেশন, পাঁচপোতা এলাকায় বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকেন। তার পরে কবি সুভাষ থেকে মেট্রো ধরে এসি-র আরামে শহরে কাজ করতে যেতেন। কেউ নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন, কেউ আয়ার কাজ করেন, কেউ বা পার্লারে। একটি সংস্থার হয়ে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফেশিয়াল, ম্যাসাজের কাজ করেন টগরী পুরকাইত। তাঁর কথায়, ‘‘কবি সুভাষের বদলে রোজ রোজ শহিদ ক্ষুদিরাম থেকে মেট্রো ধরে যাতায়াত সম্ভব নয়। দিনে ২০ টাকা অতিরিক্ত খরচ হচ্ছে। আজ দেরি হল বলে মেট্রো ধরছি। আরামের জন্য এই খরচ কী করে করব? তার চেয়ে ভিড় বাসে যাতায়াত করে নেব। আমাদের অভ্যাস আছে।’’ ভবানীপুরের এক শপিং মলে নিরাপত্তারক্ষীর কাজ করেন শিবশঙ্কর সামন্ত। থাকেন পাঁচপোতার ভাড়া বাড়িতে। রোজ কবি সুভাষ থেকে মেট্রো ধরে নেতাজি ভবন স্টেশনে নামতেন। তাঁর কথায়, ‘‘১০ ঘণ্টা তো দাঁড়িয়েই থাকি। যাতায়াতের এই একটু সময়ে আরামে মেট্রোয় বসে যেতাম। সইল না! ট্রেনে বা বাসে যাব। ক্ষুদিরাম হয়ে মেট্রো ধরলে পোষাবে না।’’

কবি সুভাষের প্ল্যাটফর্মে থুতু ফেলা সেই রক্ষীর কথা মনে পড়ে গেল! তিনি কি এখন হতাশা আর বিরক্তির জন্য শহিদ ক্ষুদিরামকে বেছে নিয়েছেন!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.