কেন আচমকা ইস্তফা দিলেন জগদীপ ধনখড়? রাজধানী দিল্লির রাজনীতির অলিন্দ আপাতত সরগরম সেই চর্চায়। রাজ্যসভার একাধিক সাংসদের দাবি, সোমবার বিকালেও তাঁরা ফুরফুরে মেজাজেই দেখেছিলেন উপরাষ্ট্রপতি তথা রাজ্যসভার চেয়ারম্যানকে। মঙ্গলবারের অধিবেশন নিয়ে কথাবার্তাও বলেছিলেন কারও কারও সঙ্গে। কিন্তু সেই তিনিই সন্ধ্যায় অসুস্থতার কথা জানিয়ে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুকে চিঠি লিখে উপরাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন।
ঘটনার আকস্মিতায় হতবাক অনেকেই। উপরাষ্ট্রপতির আচমকা ইস্তফা নিয়ে ইতিমধ্যেই বিরোধীরা প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন। তবে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলছেন না। কেন্দ্রীয় সরকারও নীরব। ধনখড়ের ইস্তফাকে ‘অপসারণ’ হিসাবেই দেখছেন অনেকে। যদিও ইস্তফার কারণ হিসাবে ধনখড় অসুস্থতার কথাই উল্লেখ করেছেন। যা রাজনীতিতে সবচেয়ে ‘নিরাপদ’ বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। রাষ্ট্রপতি ধনখড়ের ইস্তফা মঞ্জুর করার পর কালক্ষেপ না করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সমাজমাধ্যমে পোস্ট করে ধনখড়ের সুস্বাস্থ্য কামনা করেছেন। যা থেকে স্পষ্ট যে, ধনখড় পর্ব সমাপ্ত। সেটা অবশ্য বোঝা গিয়েছিল তখনই, যখন রাষ্ট্রপতি বিনা বাক্যব্যয়ে ধনখড়ের ইস্তফাটি গ্রহণ করে নেন। বস্তুত, সোমবার সন্ধ্যায় যে ভাবে ধনখড়ের ইস্তফাপত্রটি ‘ফাঁস’ হয়ে গিয়েছিল, তা-ও একটি ‘সঙ্কেত’ বলেই মনে করছেন অনেকে। সর্বসমক্ষে উপরাষ্ট্রপতির ইস্তফার বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে ফেরার রাস্তা একপ্রকার বন্ধই হয়ে যায়।
ধনখড়ের ইস্তফা নিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবন বা কেন্দ্রীয় সরকার বাক্যব্যয় না-করলেও আলোচনা, চর্চা এবং জল্পনা থামছে না। কারণ, এমন ঘটনা দেশের রাজনীতিতে সাম্প্রতিককালে ঘটেছে বলে কেউ মনে করতে পারছেন না। ফলে আলোচনা উত্তরোত্তর বাড়ছে। প্রতিটিরই অভিমুখ এক— কারণ কী? কী কারণ? দিল্লিতে খোঁজখবর নিয়ে প্রাথমিক ভাবে যা জানা যাচ্ছে, তাতে ধনখড়ের হঠাৎ-ইস্তফার নেপথ্যে মূলত তিনটি কারণ রয়েছে
বিজেপির ঘনিষ্ঠ বৃত্তের অনেকেই একান্ত আলোচনায় জানাচ্ছেন, ধনখড়ের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের মতানৈক্য শুরু হয়েছিল তাঁর বিচারব্যবস্থা-কেন্দ্রিক মন্তব্যের জন্য। কেন্দ্রের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে পূর্ণচ্ছেদও পড়ল বিচারপতি যশবন্ত বর্মার অপসারণ-কাণ্ডে তাঁর ‘অতিসক্রিয়তা’র কারণে। মাঝে একটি সরকারি অনুষ্ঠানে সংশ্লিষ্ট দফতরের মন্ত্রীর উদ্দেশে তাঁর ‘নির্দেশমূলক’ বক্তব্যও ‘তিক্ততা’র অন্যতম কারণ।
মতানৈক্যের সূত্রপাত তামিলনাড়ু সরকারের তরফে সুপ্রিম কোর্টে করা একটি মামলা নিয়ে। তামিলনাড়ু সরকার ওই মামলাটি করেছিল তাদের রাজ্যের রাজ্যপালের ভূমিকা নিয়ে। শীর্ষ আদালতে এমকে স্ট্যালিনের নেতৃত্বাধীন ডিএমকে সরকারের মামলার বিষয়বস্তু ছিল, বিধানসভায় পাশ হওয়া বিল রাজ্যপাল আটকে রাখছেন। বিষয়টি শীর্ষ আদালত বিবেচনা করুক। সেই মামলাতেই সুপ্রিম কোর্ট বলেছিল, রাজ্যপালের এক্তিয়ার নেই বিল আটকে রাখার। শুধু তা-ই নয়, আরও এক ধাপ এগিয়ে দেশের শীর্ষ আদালত রাজ্যপাল তো বটেই, স্বয়ং রাষ্ট্রপতিকেও বিলে সই করার সময় বেঁধে দিয়েছিল। প্রকাশ্যে শীর্ষ আদালতের সেই নির্দেশের সমালোচনা করেছিলেন পেশায় আইনজীবী ধনখড়। রাজ্যসভার নতুন সাংসদদের একটি কর্মশালায় ধনখড় গত এপ্রিল মাসে বলেছিলেন, ‘‘সুপ্রিম কোর্ট নিজেকে সুপার পার্লামেন্ট মনে করছে। এটা অনভিপ্রেত।’’ সূত্রের খবর, উপরাষ্ট্রপতির ওই প্রকাশ্য মন্তব্যের পরে কেন্দ্রের তরফে তাঁকে বার্তা দেওয়া হয়েছিল, তিনি যেন বিচারব্যবস্থা সম্পর্কে প্রকাশ্যে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। ধনখড় পাল্টা বার্তা দিয়েছিলেন, আইনের বিষয়ে তাঁর সম্যক ধারণা রয়েছে। সেই বনিয়াদি জ্ঞান থেকেই তিনি যা বলার বলেছেন। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রথম সারির একাধিক মন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক বিজেপি নেতার বক্তব্য, ‘‘তখন থেকেই দূরত্ব তৈরি হচ্ছিল।’’ রাজধানীর রাজনৈতিক মহলে এমনও শোনা যাচ্ছে যে, ধনখড়কে বোঝানোর চেষ্টা হয়েছিল, তাঁর বক্তব্য আইনসভার সঙ্গে বিচারব্যবস্থার সংঘাতের আকার নিচ্ছে, যা একেবারেই অভিপ্রেত নয়। কিন্তু তিনি কেন্দ্রের সেই সতর্কীকরণ গ্রাহ্যের মধ্যে আনেননি।
সেই অনভিপ্রেত বিষয়টি চরমে পৌঁছোয় দিল্লি হাই কোর্টের বিচারপতি বর্মার অপসারণ (ইমপিচমেন্ট) ঘিরে। বিচারপতি বর্মার বাড়িতে নোটের স্তূপ উদ্ধারের ঘটনা নিয়ে গত দেড়-দু’মাস ধরে ধনখড়ের নানা মন্তব্য কেন্দ্রকে ‘বিড়ম্বিত’ করছিল, যা চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোয় সোমবার।
দিল্লির ক্ষমতার অলিন্দের আলোচনার নির্যাস— বিচারপতি বর্মার অপসারণের বিষয়টিকে রাজনৈতিক ভাবে ‘ব্যবহার’ করতে চেয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু তাতে জল ঢেলে দেন ধনখড়। সোমবার বিচারপতির অপসারণের দাবিতে বিরোধীদের তরফে একটি প্রস্তাব জমা পড়ে রাজ্যসভায়। চেয়ারম্যান হিসাবে ধনখড় তা গ্রহণ করে উচ্চকক্ষের সেক্রেটারি জেনারেলকে পাঠান, যা কেন্দ্রের সঙ্গে তৈরি হওয়া তাঁর দূরত্বকে তিক্ততার পর্যায়ে নিয়ে যায়।
সূত্রের খবর, গত মাসে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর পারিবারিক অনুষ্ঠানে অন্য দুই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ধনখড়কে একান্ত আলোচনায় মুখোমুখি বসে বোঝানোর চেষ্টা করেছিলেন, তিনি যেন বিচারপতি বর্মার অপসারণ সংক্রান্ত বিষয়ে ‘আগ্রাসী’ ভূমিকা না-নেন। কিন্তু তার পরেও পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়নি। কারও কারও বক্তব্য, বিচারপতি বর্মার বিষয়ে ধনখড়ের ‘অতিসক্রিয়তা’র নেপথ্যে ব্যক্তিগত সমীকরণও থেকে থাকতে পারে।
ওই বিষয়ে যেমন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের পরামর্শ কানে তোলেননি ধনখড়, তেমনই আবার উপযাচক হয়ে সরকারি অনুষ্ঠানে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে প্রকাশ্যেই ‘নির্দেশ’ দিয়েছেন। মে মাসের শেষের দিকে একটি মন্ত্রকের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত ছিলেন উপরাষ্ট্রপতি ধনখড়। ছিলেন সংশ্লিষ্ঠ দফতরের মন্ত্রীও। ওই অনুষ্ঠানে সকলের সামনেই ওই মন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়ে নির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণের কথা বলেছিলেন ধনখড়। প্রত্যাশিত ভাবেই ওই মন্ত্রী তা ভাল ভাবে নেননি। প্রকাশ্যে অনুষ্ঠানে উপরাষ্ট্রপতির বক্তব্য নিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর দফতরকে অবহিত করেছিলেন তিনি। ঘনিষ্ঠমহলে বলেও ছিলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজে কখনও তাঁর মন্ত্রকের কাজ নিয়ে তাঁকে কিছু বলেননি। কিন্তু ধনখড় তাঁর সঙ্গে সর্বসমক্ষে ‘প্রভু’ হিসাবে আচরণ করেছেন। ধনখড়ের ওই আচরণে তাঁর নিজেকে ‘ভৃত্য’ মনে হয়েছে। ধনখড়ের ইস্তফার পর আবার দু’মাস আগের ওই ঘটনা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
তবে সাধারণ ভাবে ধারণা, কেন্দ্রের সঙ্গে ধনখড়ের দূরত্ব আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল। সোমবার শেষ সুতোটুকুও ছিঁড়ে গেল।