অহমদাবাদের বিমান দুর্ঘটনার এক মাসের মাথায় তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়েছে। ককপিট ভয়েস রেকর্ডার থেকে দুর্ঘটনার আগের মুহূর্তে এয়ার ইন্ডিয়ার দুই পাইলটের কথোপকথন শুনেছেন তদন্তকারীরা। রিপোর্টেও তার উল্লেখ রয়েছে। বিমানে যান্ত্রিক ত্রুটির সম্ভাবনা কার্যত উড়িয়েই দেওয়া হয়েছে। তবে পাইলটদের কথোপকথন এবং অন্যান্য প্রমাণ থেকে একটি বিষয় নিশ্চিত, জ্বালানির সুইচ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ওই বিমানের। ফলে দু’টি ইঞ্জিনেই জ্বালানি পৌঁছোনো বন্ধ হয়ে যায়। শেষ মুহূর্তে চেষ্টা করেও তা আর চালু করা যায়নি। কিন্তু যান্ত্রিক ত্রুটি না থাকলে কী ভাবে এমন ঘটনা ঘটল? রানওয়ে ছাড়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কী ভাবে জ্বালানির সুইচ বন্ধ হয়ে গেল? তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর এয়ার ইন্ডিয়ার দুর্ঘটনা নিয়ে রহস্যে বেড়ে গিয়েছে কয়েক গুণ। তবে কি দুর্ঘটনার কারণ পাইলটই? ভুল করে তিনি জ্বালানির সুইচ বন্ধ করে থাকতে পারেন? অন্য আর কী সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞেরা?
এয়ার ইন্ডিয়ার ওই বিমানের প্রধান পাইলট ছিলেন ক্যাপটেন সুমিত সবরওয়াল (৫৬)। ১৫,৬৩৮ ঘণ্টা বিমান ওড়ানোর অভিজ্ঞতা ছিল তাঁর। এ ছাড়া ককপিটে তাঁর সহকারী হিসাবে ছিলেন কো-পাইলট ক্লাইভ কুন্দর (৩২)। তদন্তকারী সংস্থা এয়ারক্র্যাফ্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো (এএআইবি)-র রিপোর্ট অনুযায়ী, দুর্ঘটনার ঠিক আগে এক পাইলট অপর জনকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘‘কেন তুমি বন্ধ (জ্বালানির সুইচ) করে দিলে?’’ অন্য জন তার উত্তরে বলেন, ‘‘আমি কিছু বন্ধ করিনি।’’ কোন পাইলট কী বলেছেন, সে বিষয়ে নিশ্চিত ভাবে কিছু জানানো হয়নি রিপোর্টে। কিন্তু তদন্তকারীরা জানতে পেরেছেন, জ্বালানির সুইচটি ‘রান’ থেকে ‘কাটঅফ’-এ চলে গিয়েছিল। ফলে মাত্র এক সেকেন্ডের ব্যবধানে বন্ধ হয়ে যায় দু’টি ইঞ্জিনই। শেষ মুহূর্তে সুইচ আবার ‘রান’-এ ফিরিয়ে আনা হয়। ইঞ্জিনে জ্বালানি পৌঁছোনোর জন্য, ইঞ্জিন চালু করার জন্য মরিয়া চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু লাভ হয়নি। ইঞ্জিন-২ শেষে চালু হলেও ইঞ্জিন-১ আর আগের অবস্থায় ফেরেনি। সামনের বিল্ডিংয়ে ধাক্কা খেয়ে ভেঙে পড়ে এয়ার ইন্ডিয়ার এআই১৭১। তীব্র বিস্ফোরণে তাতে আগুন ধরে যায়। সরকারি হিসাবে মোট মৃতের সংখ্যা ২৬০। লন্ডন গ্যাটউইকগামী বোয়িং ড্রিমলাইনার বিমানটিতে গুজরাতের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রূপানি-সহ ২৪২ জন ছিলেন। এক জন ছাড়া বাকি সকলেরই মৃত্যু হয়েছে।
এয়ার ইন্ডিয়ার সিইও ক্যাম্পবেল উইলসন সোমবার কর্মীদের উদ্দেশে একটি বার্তা দিয়েছিলেন। তাতে বলেছিলেন, বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। অনেক তদন্ত এখনও বাকি। ফলে এখনই এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া উচিত নয়। তিনি কর্মীদের মনে করিয়ে দিয়েছেন, দুর্ঘটনাগ্রস্ত বিমানটিতে যান্ত্রিক বা রক্ষণাবেক্ষণগত কোনও ত্রুটি ধরা পড়েনি। জ্বালানির মানেও সমস্যা ছিল না। বিমান নির্ভুল ভাবে রানওয়ে ছেড়েছিল। পাইলটদের যে বাধ্যতামূলক শারীরিক পরীক্ষা হয় বিমান ওড়ার আগে, তাতেও ছিল না কোনও অস্বাভাবিকতা। তবে কী ভাবে জ্বালানির সুইচ বন্ধ হয়ে গেল, তা নিয়ে প্রাথমিক রিপোর্টে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। সেই সংক্রান্ত তদন্ত এখনও চলছে। উইলসন নিজেই জানিয়েছেন, এই রিপোর্ট বাড়তি অনেক প্রশ্ন তুলে দিয়েছে।

এই রিপোর্ট প্রকাশ্যে আসার পর পাইলটের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকেই। ভুল করে এই সুইচ বন্ধ করে দেওয়া কি সম্ভব? বিশেষজ্ঞেরা অধিকাংশই সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দিয়েছেন। জ্বালানির সুইচ পাইলটেরাই ব্যবহার করেন। বিমান রানওয়ে ছাড়ার আগে এই সুইচ চালু করা হয়। ফলে চালু হয়ে যায় ইঞ্জিন। আবার বিমান অবতরণের সময়ে এই সুইচ বন্ধ করে ইঞ্জিন বন্ধ করা হয়। এ ছাড়া, মাঝআকাশে কোনও জরুরি পরিস্থিতি তৈরি হলে (যেমন, ইঞ্জিনে আগুন ধরে যাওয়া) এই সুইচ ব্যবহার করা হয়। ফলে সুস্থ অবস্থায় ভুল করে এই সুইচে হাত দেওয়া পাইলটের পক্ষে সম্ভব নয়। সেই সম্ভাবনা বাস্তবসম্মতও নয়, দাবি বিশেষজ্ঞদের।
দুর্ঘটনার তদন্ত রিপোর্টের পর কেউ কেউ দাবি করেছেন, ক্যাপটেন সবরওয়াল বিষণ্ণতায় ভুগছিলেন। মায়ের মৃত্যুর পর বেশ কিছু দিন ছুটিতেও ছিলেন। তাঁর মানসিক স্বাস্থ্য কি বিমান চালানোর পক্ষে উপযুক্ত ছিল? প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে এই রিপোর্টের পর। যদিও ককপিটের কথোপকথনে কোনটি কার গলার স্বর, এখনও তা নিশ্চিত করা হয়নি। অনেকেরই প্রশ্ন, পাইলটদের মানসিক স্বাস্থ্যকে কি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হচ্ছে? তার জন্য যথেষ্ট পদক্ষেপ কি করা হচ্ছে?
বিমান বিপর্যয়ে পাইলটের ভূমিকা একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পাইলটের ভুলে দুর্ঘটনার নজির যেমন রয়েছে, আত্মঘাতী দুর্ঘটনা বা ইচ্ছাকৃত ভাবে দুর্ঘটনার নজিরও বিরল নয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে এমন একাধিক বিমান বিপর্যয় ঘটেছে, যার নেপথ্যে ছিল পাইলটের মানসিক স্বাস্থ্য। তার পরেও বিমান সংস্থাগুলি কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টিতে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না, দাবি বিশেষজ্ঞদের একাংশের। ২০২২ সালের ব্লুমবার্গের একটি রিপোর্টে দাবি, বিশ্বব্যাপী বিমান দুর্ঘটনার পরিসংখ্যানে যদি আলাদা করে দেখা হয়, ২০১২ সালের পর থেকে পশ্চিমে তৈরি বিমানগুলির দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দ্বিতীয় বৃহত্তম কারণ হয়ে উঠবে পাইলটের হত্যা বা আত্মহত্যা।

পাইলটের আত্মহত্যার কারণে এখনও পর্যন্ত সবচেয়ে কুখ্যাত বিমান দুর্ঘটনা ২০১৫ সালের জার্মানউইংস বিপর্যয়। ১৫০ জন যাত্রী নিয়ে ফ্রান্সের পাহাড়ে ধাক্কা খেয়েছিল সেই বিমান। মৃত্যু হয়েছিল সকলেরই। তদন্তকারীরা জানিয়েছিলেন, সহকারী পাইলট অ্যান্ডিস লুবিট্জ় ওই বিমানের ক্যাপটেনকে ককপিটের বাইরে বার করে দরজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তার পর ইচ্ছা করে পাহাড়ের সঙ্গে বিমানটিকে ধাক্কা খাইয়েছিলেন। লুবিট্জ় ভুগছিলেন মানসিক অবসাদে। কিন্তু তাঁকে উড়ানের উপযোগী বলে সবুজসঙ্কেত (ফিট সার্টিফিকেট) দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তদন্তকারীরা এ-ও জানতে পারেন, কী ভাবে আত্মহত্যা করা যায়, অনলাইনে তা সার্চ করেছিলেন লুবিট্জ়। ককপিটের দরজার নিরাপত্তা নিয়েও ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলেন। গুরুতর অবসাদে ভুগছিলেন তিনি। অথচ, বিমান সংস্থা তা জানতেই পারেনি! দুর্ঘটনার কয়েক সপ্তাহ আগে মনোবিদ লুবিট্জ়ের একটি বিশেষ রোগও নির্ণয় করেছিলেন। তদন্তকারীদের মতে, নিজের দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলার ভয় আচ্ছন্ন করেছিল লুবিট্জ়কে। কিন্তু এই তথ্য তিনি লুকিয়ে রেখেছিলেন, কাউকে জানতে দেননি। এই রোগের কথা জানাজানি হলে নিঃসন্দেহে পাইলট হিসাবে তাঁর কেরিয়ার শেষ হয়ে যেত।
একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে, পাইলটদের চার থেকে আট শতাংশের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে। কখনও না কখনও তিনি আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন বা আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে পাইলটদের এই পরিসংখ্যানে খুব একটা ফারাক নেই।
লাইসেন্স সচল রাখতে হলে পাইলটদের নির্দিষ্ট সময় অন্তর স্বাস্থ্যপরীক্ষা করাতে হয়। ক্যাপটেন সবরওয়ালের ক্ষেত্রে শারীরিক পরীক্ষায় ডাক্তারের শংসাপত্র পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু শারীরিক পরীক্ষা নয়, পাইলটের মানসিক সুস্থতার শংসাপত্রও দেখানো উচিত বিমানে ওঠার আগে। অনেকেই চাকরি চলে যাওয়ার ভয়ে মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়টি লুকিয়ে যান। আমেরিকায় ২০২২ সালের সমীক্ষা অনুযায়ী, এই ধরনের পাইলটের সংখ্যা ৫৬.১ শতাংশ!
২০১৩ সালে নামিবিয়ায় মোজ়াম্বিকান এয়ারলাইন্সের বিমান বিপর্যয়ও পাইলটের আত্মঘাতী দুর্ঘটনার অন্যতম নজির। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, ওই বিমানের পাইলট হারমিনো ডোস সান্তোস ফার্নান্ডেজ় একা ককপিটে ঢুকেছিলেন। সহকারীকে ঢুকতেই দেননি! তার পর ইচ্ছাকৃত ভাবে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছিলেন। ২০১৪ সালে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের বিমান এমএইচ৩৭০-এর গায়েব হয়ে যাওযার নেপথ্যেও কেউ কেউ পাইলটের আত্মহত্যার কথা বলে থাকেন। কুয়ালা লামপুর থেকে বেজিং যাচ্ছিল বিমানটি। ভিতরে ২৩৯ জন ছিলেন। বিমানটিকে আজ পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভারত মহাসাগরের ৪৬ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা জুড়ে তল্লাশি চালানো হয়েছিল। কিন্তু রহস্য এখনও অধরা। বেশ কয়েকটি রিপোর্টে মালয়েশিয়া এয়ারলাইন্সের পাইলটের দিকে আত্মঘাতী দুর্ঘটনার আঙুল তোলা হয়েছিল। এই সমস্ত ঘটনা এড়াতে ককপিটের দরজার ডিজ়াইন বদলে ফেলা দরকার বলেও কেউ কেউ প্রস্তাব করেছেন। কিন্তু এখনও তা নিয়ে চূড়ান্ত কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।
কী ভাবে অহমদাবাদের সেই বিমানের জ্বালানির সুইচ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, সে প্রশ্নের উত্তর এখনই মেলার সম্ভাবনা নেই। তদন্তের পরবর্তী এবং চূড়ান্ত রিপোর্ট কবে আসবে, তা-ও নিশ্চিত নয়। তবে পাইলটদের মানসিক স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা যে কতটা জরুরি, আরও এক বার এই ঘটনা সে দিকে নজর ঘুরিয়ে দিল। যদি সত্যিই যান্ত্রিক কোনও ত্রুটি না থেকে থাকে, যদি সত্যিই বিমান রানওয়ে ছাড়ার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত সমস্ত ঠিকঠাক থেকে থাকে, তবে শেষ পর্যন্ত পাইলটদের দিকেই আঙুল ঘুরবে। তত দিন এই সংক্রান্ত প্রশ্নগুলি ঘুরপাক খেতে থাকবে তদন্তের আকাশে। রহস্যের মোড়কে ঢেকে থাকবে অহমদাবাদের এআই১৭১।