গুরু পূর্ণিমা ও মহর্ষি ব্যাসদেব বা কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন ব্যাস

কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন, যিনি ব্যাস বা বেদব্যাস নামে অধিক পরিচিত, তিনি হিন্দু ধর্মের একজন কেন্দ্রীয় ও পরম পূজনীয় ঋষি। তাঁর জন্মদিনটি গুরুপূর্ণিমা বা ব্যাস পূর্ণিমা হিসেবে পালন করা হয় পবিত্রতা সহকারে। তিনি মহাভারতের রচয়িতা।

এটি হিন্দু পঞ্জিকার আষাঢ় মাসে (জুন-জুলাই) পূর্ণিমা তিথিতে পালন করা হয়। পরমেশ্বর শিবের দক্ষিণামূর্তি রূপকে “গুরুমূর্তি” বলা হয়, সপ্ত ঋষি ও ব্রহ্মা-বিষ্ণু সহ সমস্ত দেবতারা এই মাসের পূর্ণিমা তিথিতে মহাদেবের কাছে পরমজ্ঞান লাভ করেন, শিবকে আদিগুরু মানা হয়,তাই এটি গুরু পূর্ণিমা বলেই বিখ্যাত ।

এটি ব্যাস পূর্ণিমা নামেও পরিচিত, কারণ এটি ঋষি বেদব্যাসের জন্মদিন চিহ্নিত করে, যিনি মহাভারত রচনা করেছিলেন এবং বেদ সংকলন করেছিলেন।

হিন্দুদের মতে, ঋষি ব্যাসদেব বহু গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থের সংকলক হিসেবেও বিবেচিত হন। তিনি পরাশর ঋষি ও সত্যবতীর পুত্র (যিনি ভীষ্মের সৎ মা)।

তিনি বিষ্ণুর আংশিক অবতার (অংশ অবতার) হিসেবে বিবেচিত হন এবং ঐতিহ্য অনুযায়ী, তিনিই ঋগ্বেদ, সামবেদ, যজুর্বেদ ও অথর্ববেদ—এই চারটি বেদে মন্ত্রসমূহকে বিভাজন ও সংকলন করেছিলেন (এই কারণেই তাঁর নাম হয়েছে বেদব্যাস)। এছাড়াও, তিনি অষ্টাদশ পুরাণ ও ব্রহ্মসূত্রের রচয়িতা বলেও বিবেচিত। তিনি সাতজন চিরঞ্জীবীদের (অমর ব্যক্তিদের) একজন।

বিশ্বাস করা হয় যে ঋষি ব্যাস গণেশকে মহাভারত লেখায় সহায়তা করার জন্য অনুরোধ করেন। তখন গণেশজি একটি শর্ত দেন—তিনি কেবল তখনই লিখবেন যদি ঋষি ব্যাস একটানা বিরতি ছাড়াই সমগ্র কাহিনী তাকে বলে যান।

এর উত্তরে ব্যাসদেব একটি পাল্টা শর্ত দেন—ভগবান গণেশকে অবশ্যই প্রতিটি শ্লোক আগে ভালোভাবে বুঝতে হবে, তারপরে তবেই তা লিখতে পারবেন। এইভাবে ব্যাসদেব সমগ্র মহাভারত বর্ণনা করেন।

ব্যাসদেবের ‘জয়’, যা মহাভারতের মূল অংশ, তা একটি সংলাপ — কুরু রাজা ধৃতরাষ্ট্র (যিনি কৌরবদের পিতা এবং কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে পাণ্ডবদের বিরোধিতা করেন) ও তাঁর উপদেষ্টা ও রথচালক সঞ্জয়ের মধ্যে।

সঞ্জয় ধারাবাহিকভাবে কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে ঘটনার বিবরণ বর্ণনা করেন, যা আঠারো দিনে সংঘটিত হয়েছিল।

ঋষি ব্যাসকে অষ্টাদশ মহাপুরাণ রচনার কৃতিত্বও প্রদান করা হয়। এই পুরাণগুলি ভারতীয় সাহিত্যের অংশ, যেখানে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থভিত্তিক বিষয়সহ বিশ্বকোষসম আকারে নানা বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। তিনি পরীক্ষিতের পুত্র জনমেজয়কে দেবীভাগবত পুরাণ শ্রবণ করান।

ব্যাসদেবের একজন পুত্র ছিলেন, নাম শুক, যিনি তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরসূরি ও অধিকারী ছিলেন। স্কন্দ পুরাণ অনুযায়ী, ব্যাসদেব ঋষি যাবালির কন্যা বাতিকা (যিনি পিঞ্জলা নামেও পরিচিত) কে বিবাহ করেন। তাঁর উত্তরসূরি শুক ছাড়াও ব্যাসদেবের চারজন শিষ্য ছিলেন— পৈল, জৈমিনি, বৈশম্পায়ন ও সুমন্তু।

চারজন শিষ্যের প্রত্যেককে চারটি বেদের একটি করে প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। পৈলকে ঋগ্বেদের, জৈমিনিকে সামবেদের, বৈশম্পায়নকে যজুর্বেদের এবং সুমন্তুকে অথর্ববেদের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

দশম গ্রন্থের একটি রচনায়, ‘ব্রহ্ম অবতার’-এ, যা শিখদের দ্বিতীয় ধর্মগ্রন্থ, গুরু গোবিন্দ সিং ঋষি ব্যাসকে ব্রহ্মার অবতার হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তাঁকে ব্রহ্মার পঞ্চম অবতার হিসেবে গণ্য করা হয়।

গুরু গোবিন্দ সিং ঋষি ব্যাসের রচনাসমূহের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ লেখেন, যেখানে তিনি মহান রাজাদের সম্পর্কে ব্যাসদেবের বর্ণনার উল্লেখ করেন এবং তাঁকে বৈদিক জ্ঞানের ভাণ্ডার হিসেবে সম্মানিত করেন।

বিশ্বাস করা হয় যে ব্যাসদেব আধুনিক উত্তরাখণ্ডে গঙ্গার তীরে বাস করতেন। ওই স্থানেই ঋষি বসিষ্ঠ ও মহাভারতের পাঁচ ভাই পাণ্ডবদের আধ্যাত্মিক বাসস্থান ছিল। ওড়িশার একটি বিখ্যাত শহরের নাম তাঁর নামানুসারে রাখা হয়েছে—ব্যাসনগর।

গুরু পূর্ণিমা, যা ব্যাস পূর্ণিমা নামেও পরিচিত, এই উৎসবটি ব্যাসদেবকে উৎসর্গ করা হয়েছে। এই দিনটি তাঁর জন্মদিন ও বেদ বিভাজনের দিন—উভয় হিসেবে বিশ্বাস করা হয়। ওড়িশার ব্যাসনগরে প্রতি বছর মার্চ মাসে ভগবান ব্যাসদেবের সম্মানে ১১ দিনের মেলা অনুষ্ঠিত হয়।

তথ্য ও ছবি সংগৃহীত।

সুশান্ত মজুমদার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.