দিলীপের নতুন চমক! ক্ষোভ ভুলে বিজেপি দফতরে গিয়ে শমীককে শুভেচ্ছা, বললেন, ‘উনিশে হাফ, ছাব্বিশে সাফ’

তিন মাসের মধ্যেই তিন চমক! বিবাহপর্ব, দিঘাপর্বের পর দিলীপের আবার ‘বিজেপি-গর্ব’ ফিরে এল!

ক্ষোভ এবং বিতর্কের অধ্যায় পিছনে রেখে মঙ্গলবার দলীয় কার্যালয়ে হাজির হলেন রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি দিলীপ ঘোষ। দলের নতুন রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যকে ‘শুভেচ্ছা জানাতে’ দিলীপ যে মঙ্গলবার রাজ্য দফতরে যাবেন, সে কথা দিলীপের অনুগামীরা সোমবার রাত থেকেই জানাতে শুরু করেছিলেন। মঙ্গলের বিকেলে সে দৃশ্যের সাক্ষী থাকতে প্রত্যাশিত ভাবেই অনেক বিজেপি কর্মী ভিড় জমিয়েছিলেন বিধাননগর সেক্টর ফাইভের দফতরে। জয়ধ্বনির মধ্যে দিয়েই দলীয় দফতরে প্রবেশ করলেন দিলীপ। উত্তরীয় এবং ফ্রেমে বাঁধানো দলীয় প্রতীকের ছবি দিয়ে প্রাক্তন সভাপতি সংবর্ধনা জানালেন নতুন সভাপতিকে।

বিকেল ৪টে ২০ নাগাদ দিলীপ দলীয় দফতরে পৌঁছন। সাংগঠনিক কাজে শমীক তার কয়েক ঘণ্টা আগে থেকেই সেখানে ছিলেন। শমীকের জন্য নির্দিষ্ট কক্ষে গিয়েই দিলীপ তাঁর সঙ্গে দেখা করেন। শমীককে গেরুয়া উত্তরীয় পরিয়ে দেন দিলীপ। শমীকের হাতে তুলে দেন ফ্রেমবন্দি ‘পদ্ম’ প্রতীকের ছবি। শমীককে এই শুভেচ্ছা জানানোর সময়ে দিলীপ বলেন, ‘‘আমাদের একটাই নেতা— পদ্মফুল। তাই নতুন সভাপতির হাতে পদ্মফুলের ছবিই তুলে দিলাম।’’ রাজ্য বিজেপির প্রাক্তন সভাপতি আরও বলেন, ‘‘শমীকের নেতৃত্বেই আমরা কাজ করব।’’ একই সঙ্গে রাজ্যে ক্ষমতাবদলের ডাক দিয়ে স্লোগান তুললেন, ‘‘উনিশে হাফ, ছাব্বিশে সাফ’’! ২০২৬ সালেই রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন।

আরও পড়ুন:

বিজেপিতে শমীকের যাত্রাপথ অন্তত ৪২ বছরের। দিলীপ সে তুলনায় বিজেপিতে অনেকটাই নবীন। তিনি আরএসএসের (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ) প্রচারক ছিলেন। আরএসএস থেকেই তাঁকে বিজেপিতে পাঠানো হয়। ২০১৫ সালে বিজেপিতে শামিল হয়ে দিলীপ প্রথমে দলের রাজ্য সাধারণ সম্পাদক হন। ২০১৬ সালে রাজ্য সভাপতি হন। পরে বিধায়ক, সাংসদও হন। ২০২১ সালের শেষ দিকে দিলীপকে সরিয়ে সুকান্ত মজুমদারকে রাজ্য সভাপতি করা হয়। দিলীপকে সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি করা হয়। পরে সেই দায়িত্ব থেকেও অব্যহতি দেওয়া হয়। অন্য দিকে, দিলীপ দলের আসার আগেই শমীক বিজেপির রাজ্য সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন। বিধায়কও হয়েছিলেন। দিলীপের সভাপতিত্বকালে বরং শমীকের উপরে বড় কোনও সাংগঠনিক দায়িত্ব ছিল না। শুধু রাজ্য দলের প্রধান মুখপাত্র ছিলেন। সুকান্তর জমানায় শমীক রাজ্যসভার সাংসদ হন। গত ৩ জুলাই আনুষ্ঠানিক ভাবে দলের রাজ্য সভাপতি ঘোষিত হয়েছেন। বয়স এবং দলে থাকার মেয়াদ, দু’দিক দিয়েই দিলীপের চেয়ে শমীক প্রবীণ। সেই প্রবীণের নেতৃত্বেই যে তিনি চলবেন, সে কথা দিলীপ আনুষ্ঠানিক ভাবে মঙ্গলবার উচ্চারণ করলেন। সেই সুবাদে বেশ কয়েক মাস পরে দলের রাজ্য দফতরে পদার্পণও করলেন।

গত ১৮ এপ্রিল বড় চমক ছিল দিলীপের বিয়ে। সঙ্ঘ বা দলের অনেকের আপত্তি না-শুনে ওই দিন তিনি বিয়ে করেন দলেরই কর্মী রিঙ্কু মজুমদারকে।

আরও পড়ুন:

এর পর, দলের ঘোষিত লাইনের বিপরীতে হেঁটে গত ৩০ এপ্রিল দিঘায় জগন্নাথ মন্দির উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে সস্ত্রীক হাজির হয়েছিলেন দিলীপ। নাম না-করে সে দিনই তাঁর কঠোর সমালোচনা করেছিলেন রাজ্য বিধানসভার বিরোধী দলনেতা তথা রাজ্য বিজেপির অন্যতম শীর্ষনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তৎকালীন রাজ্য সভাপতি সুকান্তও জানিয়েছিলেন, দিলীপের এই দিঘা সফর তাঁর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত, একে দল অনুমোদন করছে না। পর দিন দিঘা থেকে ফেরার পথে কোলাঘাটে দিলীপের চা-চক্র ভেস্তে গিয়েছিল দলীয় কর্মীদের বিক্ষোভে। তার পর থেকে দলের নেতৃত্বের একাংশের বিরুদ্ধে দিলীপ সপ্তাহ খানেক ধরে লাগাতার তোপ দাগতে শুরু করেছিলেন। ফলে দলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব ক্রমশ বাড়তে থাকে। কোনও গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকেই তিনি আর ডাক পাচ্ছিলেন না। এমনকি নতুন রাজ্য সভাপতি বাছাই পর্বেও দিলীপ পুরোপুরি অনুপস্থিত ছিলেন। শমীকের মনোনয়ন পেশের দিনে এবং সভাপতি হিসেবে ঘোষিত হওয়ার দিনে অন্য দুই প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি অসীম ঘোষ এবং রাহুল সিংহ একেবারে সামনের সারিতে থেকেছেন। দিলীপ ডাক পাননি।

তবে দিলীপের প্রকাশ্য ‘নির্ঘোষ’ শুরু হয়েছিল গত লোকসভা ভোটের ফল বেরোনোর পর থেকেই। দল তাঁকে জেতা কেন্দ্র মেদিনীপুর থেকে সরিয়ে বর্ধমান-দুর্গাপুর আসনে লড়তে পাঠিয়ে দেয়। দিলীপ হেরে যান। হেরেই বলেন, ‘‘আমাকে কাঠি করা হয়েছে।’’ তার পর থেকে নানা ভাবে দলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বেড়েই গিয়েছে। তাই মঙ্গলবার বিকেলে দলের রাজ্য দফতরে দিলীপের পদার্পণ ঘটনাপ্রবাহে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ মোড় বলে বিজেপির অনেকেই মনে করছেন।

দলীয় কার্যালয়ে দিলীপ খুব বেশি ক্ষণ ছিলেন না। সব মিলিয়ে ৪৫ থেকে ৫০ মিনিট। তবে তার মাঝেই শমীকের সঙ্গে দিলীপের দু’দফায় বৈঠক হয়। দু’দফাতেই মিনিট ১৫ করে কথাবার্তা চলে। প্রথম দফার কথাবার্তা সেরে শমীক নেমে আসেন কার্যালয়ের গাড়িবারান্দায়। কর্মী-সমর্থকদের উৎসুক ভিড় যে নেতৃত্বের কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করছে, সে কথা বুঝতে পেরেই শমীক নেমে এসেছিলেন। একটি চেয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে রাজ্য বিজেপি সভাপতি কর্মীদের উদ্দেশে ঐক্যের বার্তা দেন। আদি-নব্য দ্বন্দ্বের বিরুদ্ধে বার্তা দেন। যাঁরা বিজেপির পতাকা ধরে রয়েছেন, তাঁদের কাউকে ‘অন্য দলের লোক’ বলে দাগিয়ে না-দেওয়ার পরামর্শ দেন। তৃণমূল বা সিপিএমের যে সাধারণ সমর্থকরা দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত নন, তাঁদেরও বিজেপিতে টেনে আনতে সচেষ্ট হওয়ার নির্দেশ দেন। দিলীপ দলবদল করবেন কি না, সে সংক্রান্ত জল্পনা গত কয়েক দিন ধরে অনেকে চালাচ্ছিলেন। সে প্রসঙ্গ সরাসরি উচ্চারণ না-করেও শমীক জল্পনায় জল ঢালার চেষ্টা করেন। বলেন, ‘‘দিলীপ ঘোষ বিজেপিতে ছিলেন, বিজেপিতে রয়েছেন, বিজেপিতেই থাকবেন।’’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.