অধিনায়ক হিসাবে ইংল্যান্ডের মাটিতে রেকর্ড! চ্যালেঞ্জের মুখে জ্বলে ওঠেন শুভমন, ভারতীয় ক্রিকেটে কোহলি-উত্তর যুগ শুরু

ভারতীয় ক্রিকেটে শুরু হয়ে গেল কোহলি-উত্তর যুগ। সেই চার নম্বর। সেই আগ্রাসন। সেই বিপক্ষকে পিষে ফেলার অদম্য চেষ্টা। সেই সাহসী ব্যাটিং। সবই দেখালেন শুভমন গিল। এজবাস্টনে ইংরেজ বোলারদের পিটিয়ে ২৬৯ রান করলেন তিনি। ছাপিয়ে গেলেন কোহলিকেও। ত্রিশতরান হাতছাড়া হলেও কঠিন পরিস্থিতিতে যে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে ভালবাসেন, তা বুঝিয়ে দিলেন ভারত অধিনায়ক।

গত ৫০ বছরে টেস্টে ভারতীয় ক্রিকেটের ব্যাটন বদলেছে। সুনীল গাওস্করের কাছ থেকে পেয়েছিলেন সচিন তেন্ডুলকর। দুই দশকের বেশি সময় ধরে তিনি সেই দায়িত্ব সামলেছেন। নিজের চার নম্বর জায়গা তিনি ছেড়ে গিয়েছিলেন কোহলিকে। সচিনের মান রেখেছেন কোহলি। শুধু ব্যাটার হিসাবে নয়, অধিনায়ক হিসাবে নিজেকে আরও উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কোহলির ছেড়ে দেওয়ার চার নম্বর জায়গা মাত্র দুই টেস্টেই নিজের করে নিয়েছেন শুভমন। মাত্র দুই টেস্টেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন, শক্ত হাতে রয়েছে ভারতের টেস্ট ক্রিকেট।

এজবাস্টনে প্রথম ইনিংসে একাই প্রায় ৬৫ ওভারের বেশি ব্যাট করে ফেলেছেন শুভমন গিল। এই ৬৫ ওভারে যে কত বল তাঁর বুক, মাথা লক্ষ্য করে হয়েছে তার হিসাব নেই। কিন্তু তার পরেও তাঁকে থামাতে পারেননি ইংরেজ বোলারেরা। শুভমন যখন ১৯৯ রানে খেলছেন তখনও তাঁকে বাউন্সার করেন জশ টং। তাতে শুভমনের কোনও সমস্যা হয়নি। ফাইন লেগে পুল মেরে নিজের প্রথম দ্বিশতরান করেছেন তিনি। তার পরেও থামেননি। প্রথম ভারতীয় অধিনায়ক হিসাবে ত্রিশতরান করার সুযোগ ছিল। তা হাতছাড়া হয়েছে। শেষ পর্যন্ত থেমেছেন ২৬৯ রানে। ৩০ চার ও তিন ছক্কার ইনিংসে ভারত অধিনায়ক বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে ভালবাসেন। তাঁর সামনে অসহায় দেখাচ্ছে ইংরেজ বোলিংকে।

ইংল্যান্ডে সিরিজ় শুরু হওয়ার আগে শুভমন জানিয়েছিলেন, এই টেস্টে সর্বাধিক রান করতে চান তিনি। সেটা যে শুধু কথার কথা ছিল না, তা প্রমাণ করে দিচ্ছেন ভারত অধিনায়ক। এখনও পর্যন্ত সিরিজ়ে সর্বাধিক রানের মালিক তিনি। প্রথম দুই টেস্টেই তিনি যে ভাবে ব্যাট করেছেন তাতে পাঁচ ম্যাচের সিরিজ় শেষে তিনি কোথায় থামবেন, তা নিয়ে আলোচনা চলছে।

প্রথম টেস্টের প্রথম ইনিংসেও শুভমনের সুযোগ ছিল দ্বিশতরানের। ১৪৭ রান করার পর শোয়েব বশিরের বলে লোভ সামলাতে পারেননি। ছক্কা মারতে গিয়ে ডিপ স্কোয়্যার লেগে আউট হন। ফেরার সময় কেঁদে ফেলেছিলেন ভারত অধিনায়ক। বোঝা যাচ্ছিল, কতটা হতাশ তিনি। শুভমন জানতেন, তাঁর সামনে অধিনায়ক হিসাবে প্রথম ইনিংসেই দ্বিশতরানের রেকর্ড গড়ার সুযোগ ছিল। লোভ সামলাতে না পারায় সেটা হয়নি। সেই কারণেই হয়তো নিজের উপরই রেগে গিয়েছিলেন শুভমন।

এজবাস্টনে দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম ইনিংসেও বার বার সেই প্রলোভন তাঁকে দেখিয়েছেন ইংরেজ বোলারেরা। দূরে দূরে ফিল্ডার রেখে বড় শট মারার আমন্ত্রণ করেছেন। কিন্তু সেই আমন্ত্রণে সাড়া দেননি তিনি। শুভমন তখনই বড় শট খেলেছেন, যখন তাঁর মনে হয়েছে। প্রতিটা শটে ধরা পড়েছে তাঁর ‘ক্লাস’। অবাক হয়ে প্রশংসা করেছেন ধারাভাষ্যকারের ভূমিকায় থাকা গাওস্কর, নাসের হুসেনরা। শুভমন থামেননি। তাঁকে থামাতে পারেনি ইংল্যান্ডের বোলিং আক্রমণ

শতরানের আগে একটু সাবধানি দেখাচ্ছিল শুভমনকে। ধৈর্য নিয়ে খেলছিলেন। তাড়াহুড়ো করছিলেন না। তার একটা বড় কারণ, সেই সময় দলের রানের কথা অনেক বেশি ভাবতে হচ্ছিল তাঁকে। এজবাস্টনের পাটা উইকেটে ২১১ রানে ৫ উইকেট পড়ে গিয়েছিল ভারতের। শুভমন জানতেন, অন্তত ৪০০ রান করার লক্ষ্য ছিল তাঁর। শুভমনকে সাহায্য করলেন রবীন্দ্র জাডেজা। তিন বছর আগে এই মাঠেই শতরান করেছিলেন জাডেজা। তিনি ভাল খেললেন। দু’জনের মধ্যে ২০৩ রানের জুটি হল। তাতে চাপ অনেক কমে গেল শুভমনের উপর।

জাডেজা আউট হওয়ার পর শুভমনের ঢাল হয়ে দাঁড়ালেন ওয়াশিংটন সুন্দর। তিনি জানতেন, এই জুটির পর আর ব্যাটার নেই ভারতের। তাই নিজের উইকেট দেননি। সুন্দর সাধারণত আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে ভালবাসেন। কিন্তু ধৈর্য ধরলেন তিনি। একের পর এক বল আটকালেন। ধীরে ধীরে এগোলেন। তাতে সময় পেয়ে গেলেন শুভমন। দ্বিশতরান করলেন তিনি। শুভমনের দ্বিশতরান যখন প্রায় নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে, তখন হাত খুলতে দেখা গেল সুন্দরকে।

২০০ রানের পরে দেখা গেল শুভমনের সেই পরিচিত ভঙ্গিতে উল্লাস। তবে তার মধ্যে একটা প্রত্যয় ধরা পড়ছিল তাঁর মুখে। দেখে বোঝা যাচ্ছিল, ২০০ করেই সন্তুষ্ট থাকতে চান না তিনি। আবার নতুন করে গার্ড নিয়েছেন। নীচের সারির ব্যাটারদের নিয়ে খেলেছেন। শেষ দিকে আক্রমণাত্মক ব্যাটিং করেছেন তিনি। শুভমন জানতেন, বেশি ওভার তিনি হয়তো পাবেন না। তাই সময় নষ্ট করতে চাননি। তাড়াহুড়ো করতে গিয়েই উইকেট দিয়ে এসেছেন ভারত অধিনায়ক। তবে তত ক্ষণে শুভমন বুঝিয়ে দিয়েছেন, কঠিন পরিস্থিতিতে জ্বলে ওঠেন তিনি। চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসেন। সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে ভালবাসেন। হেডিংলের পর এজবাস্টনেও তা টের পাচ্ছেন বেন স্টোকসেরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.