চিনের সঙ্গে বাণিজ্যচুক্তি সেরে ফেলার পরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জানিয়েছেন, তাঁর পরবর্তী লক্ষ্য ভারত। বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে আলোচনার জন্য শুক্রবার ভারতীয় প্রতিনিধিদল আমেরিকাতেও পৌঁছেও গিয়েছে। তবে কূটনৈতিক এবং বণিকমহলের একাংশের মতে চিনের মতো দ্রুত আমেরিকার সঙ্গে বাণিজ্য সমঝোতায় পৌঁছনো ভারতের পক্ষে কঠিন। কারণ, পথে রয়েছে অনেক ‘কাঁটা’।
বৃহস্পতিবার চিনের সঙ্গে চুক্তির পরে হোয়াইট হাউসে ট্রাম্প বলেন, “আমরা সবে মাত্র চিনের সঙ্গে (বাণিজ্য) চুক্তি করলাম। সবার সঙ্গে আমরা চুক্তি করব না। তবে কিছু দারুণ চুক্তি হবে। যেমন পরেরটাই হয়তো হবে ভারতের সঙ্গে। খুব বড় চুক্তি হবে সেটা।” সেই সঙ্গে আশা প্রকাশ করেন, বাণিজ্যচুক্তি হলে ভারত তার বাজার খুলে দেবে আমেরিকার জন্য। যদিও সম্ভাব্য সেই চুক্তির রূপরেখা সম্পর্কে কিছু জানাননি তিনি। মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স অবশ্য গত এপ্রিলে ভারতে এসেই ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘‘২০৩০ সালে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ৫০ হাজার কোটি ডলারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে চুক্তি করব আমরা।’’
নয়াদিল্লি-ওয়াশিংটন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যের অঙ্ক প্রায় ১৯ হাজার ১০০ কোটি ডলার। চুক্তি হলে তা এক ধাক্কায় অনেকটাই বাড়তে পারে। বস্তুত, গত ফেব্রুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর আমেরিকা সফরের সময়ে দ্রুত দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যচুক্তির বার্তা দিয়েছিলেন ট্রাম্প এবং ভান্স দু’জনেই। তবে তার পর পরিস্থিতি কিছুটা বদলে যায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বিরুদ্ধে শুল্কযুদ্ধ ঘোষণা করেন ট্রাম্প। পণ্য আমদানির উপর বাড়তি আমদানি শুল্ক ধার্য করেন। সেই তালিকায় ছিল ভারতও। ভারতীয় পণ্যের উপর বাড়তি ২৬ শতাংশ শুল্ক চাপানোর কথা ঘোষণা করা হয়। পরে তা ৯ জুলাই পর্যন্ত স্থগিত রাখা হলেও ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়ামজাত পণ্যে ২৫ শতাংশ বাড়তি শুল্ক বহাল রাখা হয়।
এর পরেই ট্রাম্পের দেশ থেকে আমদানি করা ২৯টি পণ্যের উপর শুল্ক বসানোর জন্য ডব্লিউটিও-র কাছে বার্তা দিয়েছিল মোদী সরকার। যা নিয়ে দু’দেশের বিরোধ পৌঁছে গিয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-র কাছে। এই আবহে ভারতের পক্ষে নিজের স্বার্থরক্ষা নিশ্চিত করে বাণিজ্যচুক্তির রূপরেখা স্থির করা কঠিন বলেই অনেকে মনে করছেন। কারণ, এ ক্ষেত্রে বেজিংয়ের যে সুবিধা ছিল, তা নয়াদিল্লির নেই। বিরল খনিজ থেকে বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের কাঁচামাল পর্যন্ত বহু ক্ষেত্রের চিনের উপর নির্ভরতা রয়েছে আমেরিকার। কিন্তু নয়াদিল্লির সে সুবিধা নেই। ফলে সাউথ ব্লকের একটি সূত্র শরতের মধ্যে বাণিজ্যচুক্তির প্রথম পর্ব চূড়ান্ত করার বার্তা দিলেও তা নিয়ে সংশয় রয়েছে।
ফেব্রুয়ারিতে পরস্পরের উপরে শুল্ক বাড়িয়ে বাণিজ্যে পাঁচিল তুলতে নেমেছিলেন ট্রাম্প এবং চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। কিন্তু কয়েক সপ্তাহ পরেই শেষে দু’দেশের মধ্যে সমঝোতা হয়। চিনা পণ্যে শুল্কের হার ১৪৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩০ শতাংশ করে আমেরিকা। চিন আমেরিকার পণ্যে শুল্কের হার ১২৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে করে ১০ শতাংশ। প্রাথমিক সমঝোতায় স্থির হয়েছিল, তা ৯০ দিন চলবে। সেই সময়সীমার পেরনোর পরেই দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে ফেলল বিশ্বের বৃহত্তম দুই অর্থনৈতিক শক্তি।
নতুন বাণিজ্যচুক্তি নিয়ে ইতিমধ্যেই কয়েক দফা আলোচনা হয়েছে ভারত এবং আমেরিকার। কিন্তু গাড়ির যন্ত্রাংশ, ইস্পাত এবং কৃষিজাত পণ্যের আমদানি শুল্ক নিয়ে মতবিরোধের কারণে তা নিয়ে চুক্তির রূপরেখা এখনও চূড়ান্ত হয়নি বলে সরকারি সূত্রের খবর। ‘টাফ নেগোশিয়েটর’ মোদীর সঙ্গে দর কষাকষি করা যে ‘কঠিন’ বলেও উল্লেখ করেছিলেন ট্রাম্প। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে নয়াদিল্লির দর কষাকষির ক্ষমতা কতটা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ভারতের মোট রফতানির প্রায় ১৮ শতাংশ যায় আমেরিকার বাজারে। আমদানির ক্ষেত্রে দেশীয় বাজারের ৬.২২ শতাংশ মার্কিন পণ্য। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য হয় ১০.৭৩ শতাংশ। বাণিজ্যচুক্তি চূড়ান্ত না হলে ভারতীয় চিংড়ি, কার্পেট, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং সোনার গহনা রফতানিকারকেরা ধাক্কা খেতে পারেন বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও আমেরিকার সামগ্রিক বাণিজ্য পরিসংখ্যানে তার তেমন প্রভাব পড়বে না। তবে মোটরগাড়ি ও তার যন্ত্রাংশ, সয়াবিন এবং ভুট্টার মতো কৃষিপণ্যে ভারত শুল্ক কমালে তার কিছুটা সুফল পাবে ওয়াশিংটন।

