গুজরাতের অহমদাবাদে বৃহস্পতিবার ভেঙে পড়েছিল এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান। দুপুর ১টা ৩৯ মিনিট নাগাদ ওড়ার মাত্র আট মিনিটের মধ্যেই মেঘানিনগরে বি জে মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলের উপর ভেঙে পড়ে এআই১৭১। সেই ঘটনায় প্রথমে বিমানে থাকা ২৪১ জনের মৃত্যুর খবর আসে। পরে আহতদের মধ্যেও কারও কারও মৃত্যু হয়। সরকারি হিসাবে এখনও পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা ২৭৪। কাকতালীয় ভাবে বিমানে থাকা যাত্রীদের মধ্যে মাত্র এক জন বেঁচে গিয়েছেন। বাকিদের বেশিরভাগেরই দেহ জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে দুর্ঘটনা-পরবর্তী বিস্ফোরণে। সে সব দেহাবশেষ দেখে আর শনাক্ত করারও উপায় নেই!
কী ভাবে দুর্ঘটনা? খতিয়ে দেখবে কেন্দ্রীয় কমিটি
ইতিমধ্যেই অহমদাবাদের বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে কেন্দ্রের অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রকের অধীনস্থ সংস্থা ‘এয়ারক্রাফ্ট অ্যাক্সিডেন্ট ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো’ (এএআইবি)। ২০১২ সালে এএআইবি গঠিত হয় দেশে। তার পর থেকে দেশে বিমান দুর্ঘটনার তদন্ত তারাই করে। তার মাঝেই আবার কেন্দ্রের অসামরিক বিমান পরিবহণ মন্ত্রক জানিয়েছে, এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান কেন দুর্ঘটনার কবলে পড়ল, তা পৃথক ভাবে তদন্ত করে দেখবে তারা। শুক্রবার গভীর রাতে মন্ত্রকের তরফে এ বিষয়ে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানানো হয়। কমিটির নেতৃত্বে থাকবেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব। সদস্য হিসাবে থাকবেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের আধিকারিকেরাও। সব কিছু খতিয়ে দেখে তিন মাসের মধ্যে রিপোর্ট জমা দেবে এই কমিটি। বিমান দুর্ঘটনার নেপথ্যে যান্ত্রিক ত্রুটি না কি পাইলটের ভুল, সব কিছু খতিয়ে দেখা হবে। পাশাপাশি, বর্তমানে দেশে উড়ানের নিরাপত্তা সংক্রান্ত যে নির্দিষ্ট বিধি বা ‘এসওপি’ রয়েছে, তা-ও পর্যালোচনা করে দেখবেন কমিটির সদস্যেরা।
নিহত ২৭৪
অহমদাবাদের দুর্ঘটনায় এখনও পর্যন্ত প্রাণ গিয়েছে ২৭৪ জনের। নিহতদের মধ্যে বিমানের যাত্রীরা ছাড়াও রয়েছেন ক্রু সদস্য, পাইলট, বিজে মেডিক্যাল কলেজের পড়ুয়া, এমনকি স্থানীয় বাসিন্দারাও। বেশির ভাগেরই দেহ পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছে। ‘দেহ’ বলতেও কিছু আর অবশিষ্ট নেই। দেহাংশ যা রয়েছে, তা-ও চেনার অযোগ্য। এখনও পর্যন্ত মাত্র কয়েকটি দেহ শনাক্ত করা গিয়েছে। সেগুলি তুলে দেওয়া হয়েছে পরিজনদের হাতে। বাকি দেহগুলি শনাক্ত করার জন্য নিহতদের নিকটাত্মীয়দের ডিএনএ-র নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছে। তার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে নিহতদের ডিএনএ। মিললেই দেহাংশ পরিবারের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
‘অভিশপ্ত’ ১২ তারিখের টিকিট! লন্ডন ফেরা হল না প্রবাসী দম্পতির
৬ জুন লন্ডনে ফেরার কথা ছিল মোনালি পটেল ও তাঁর স্বামী সানি পটেলের। সব ঠিকঠাকই ছিল। কিন্তু পরিবারের সঙ্গে আরও কয়েকটা দিন কাটিয়ে যেতে চেয়েছিলেন দু’জনেই। তাই ৬ তারিখের টিকিট বাতিল করে ১২ জুন এয়ার ইন্ডিয়ার গ্যাটউইকগামী বিমানের টিকিট কাটেন। সেটাই কাল হল! দীর্ঘশ্বাস ফেলে পরিজনেরা বলছেন, হয়ত মৃত্যু ডেকেছিল! এখন মোনালি ও সানির দেহ হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় দিন গুনছেন তাঁরা।
টাটা গোষ্ঠী দেবে এক কোটি, ২৫ লক্ষ টাকা করে দেবে এয়ার ইন্ডিয়াও
অহমদাবাদে বিমান দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারকে এক কোটি টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা আগেই ঘোষণা করেছিল টাটা গোষ্ঠী। এ বার এয়ার ইন্ডিয়াও জানিয়েছে, তারা নিহতদের পরিবারকে ২৫ লাখ টাকা করে আর্থিক সাহায্য দেবে। শুধু নিহতদের পরিবারকেই নয়, একমাত্র জীবিত বিশ্বাসকুমার রমেশও সেই টাকা পাবেন। প্রসঙ্গত, এয়ার ইন্ডিয়া টাটা গোষ্ঠীরই অধীনস্থ সংস্থা। শনিবার তাদের তরফে এক্স হ্যান্ডলে পোস্ট করে অতিরিক্ত আর্থিক সাহায্যের কথা জানানো হয়েছে। বিমান দুর্ঘটনায় বিজে মেডিক্যাল কলেজ হস্টেলের যাঁরা জখম হয়েছেন, তাঁদেরও চিকিৎসার খরচ বহন করা হবে বলে জানিয়েছে ওই সংস্থা।
বাঁচাতে পারলাম না! হাহাকার মায়ের
বৃহস্পতিবার দুপুরে মাকে খাবার দিতে এসেছিল বছর পনেরোর আকাশ। তখনই ভেঙে পড়ে বিমান। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ! ধেয়ে আসা আগুনের গোলায় পুড়ে ছাই হয়ে যায় কিশোরের শরীর। অথচ অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছেন আকাশের মা সীতাবেন! মেঘানিনগরে বিজে মেডিক্যাল কলেজের হস্টেলের অদূরেই ছিল তাঁর চায়ের দোকান, পুড়ে ছাই হয়ে যাওয়ার পর সেই দোকানের চিহ্নমাত্রও অবশিষ্ট নেই। তবে ছেলেকে বাঁচাতে গিয়ে সীতাবেনের শরীরের ৫০ শতাংশেরও বেশি পুড়ে গিয়েছে। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় এখনও তিনি সিভিল হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি। পুত্রহারা মা বলেন, ‘‘বিমানটা পিছন থেকে এসেছিল। আগের মুহূর্ত পর্যন্তও বুঝতে পারিনি যে এমন কিছু ঘটতে চলেছে। ভেঙে পড়ার সময় বিকট শব্দ শুনতে পেলাম।’’ ছেলের মৃত্যুর খবর প্রথমে মাকে জানানো হয়নি। তবে পরে খবর পেয়েছেন। সেই থেকে অঝোরে কেঁদেই চলেছেন সীতা।
ভেঙে চুরমার ‘স্বপ্নের উড়ান’!
অটো চালিয়ে সংসার চালাতে হয়। কিন্তু কখনই কন্যার স্বপ্নপূরণে পিছপা হননি। ঋণ নিয়ে মেয়েকে উচ্চশিক্ষার জন্য লন্ডনে পাঠানোরও বন্দোবস্ত করেছিলেন। তবে এক লহমায় ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেল সব স্বপ্ন। অহমদাবাদ বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে গুজরাতের হিম্মতনগরের বাসিন্দা পায়েল খটিকের! কন্যা পায়েলকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন বুনেছিলেন অটোচালক বাবা। মেয়ের ইচ্ছা ছিল বিদেশে গিয়ে স্নাতকোত্তর করবেন। সুযোগও পান লন্ডনের এক কলেজে। মেয়েকে বিদেশে পাঠানোর জন্য বিপুল অঙ্কের ঋণ নেন বাবা। ভেবেছিলেন, স্নাতকোত্তরের পর চাকরি করে ঋণ শোধ করে দেবেন মেয়ে। বৃহস্পতিবারের ‘অভিশপ্ত’ সেই বিমানেই পায়েলের লন্ডনে যাওয়ার কথা ছিল। সপরিবারে মেয়েকে বিমানে তুলতে বিমানবন্দরেও এসেছিলেন। বাড়ি ফিরে শোনেন, বিমান ভেঙে পড়েছে। ভেঙে পড়েছে স্বপ্নের উড়ান! আপাতত মেয়ের দেহ নেওয়ার অপেক্ষায় দিন কাটছে বাবার।
‘মা কখন আসবে?’
বার বার বাড়ির লোকের কাছে একটাই প্রশ্ন করে চলেছে খুদে মেয়ে, ‘মা কখন আসবে?’ কেউই জানে না সেই উত্তর। উত্তর দেবেনই বা কী করে? কারণ মা তো চলে গিয়েছেন ‘না ফেরার দেশে’। বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে এআই১৭১-এর কেবিন ক্রু অপর্ণা মহাধিকের। মহারাষ্ট্রের বাসিন্দা অপর্ণার বাড়িতে রয়েছে তাঁর ছোট্ট মেয়ে। মাকে দেখতে না পেয়ে উতলা মেয়ে জানে না যে, তার মা আর বেঁচে নেই।
‘অভিশপ্ত’ সংখ্যা ১৭১!
অহমদাবাদে বিমান বিপর্যয়ের পর তাদের কোনও বিমানেই ১৭১ সংখ্যাটি আর ব্যবহার করবে না এয়ার ইন্ডিয়া, জানিয়েছে সংবাদ সংস্থা পিটিআই। কোনও নির্দিষ্ট সংখ্যার বিমান বড়সড় দুর্ঘটনার কবলে পড়লে ওই সংখ্যা পুনরায় ব্যবহার না-করাই দস্তুর। প্রচলিত সেই রীতি মেনেই অহমদাবাদ-গ্যাটউইক বিমানের সংখ্যা বদলে দিচ্ছে এয়ার ইন্ডিয়া। সূত্রের দাবি, মঙ্গলবার থেকে ওই বিমানের নম্বর এআই১৭১-এর পরিবর্তে এআই১৫৯ হয়ে যেতে পারে। এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেসও তাদের কোনও বিমানে ১৭১ সংখ্যাটি রাখছে না। আইএক্স ১৭১ নামের বিমানটিরও নাম পরিবর্তন করা হচ্ছে বলে সূত্রের দাবি। যদিও এই বিষয়ে এখনও পর্যন্ত আনুষ্ঠানিক ভাবে কিছু জানায়নি এয়ার ইন্ডিয়া।
ব্ল্যাকবক্সের তথ্য কী বলছে?
শনিবার এক সাংবাদিক বৈঠকে কেন্দ্রীয় অসমারিক বিমান পরিবহণমন্ত্রী রামমোহন নায়ডু জানিয়েছেন, শুক্রবার বিকেল ৫টা নাগাদ বিমানের ব্ল্যাকবক্সটি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। সেই ব্ল্যাকবক্সের তথ্য পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চলছে। কী ঘটেছিল, সেই তথ্য যাচাইয়ের পরই জানা সম্ভব হবে বলে জানান রামমোহন। তাঁর কথায়, ‘‘পাইলট সুমিত সবরওয়ালের শেষ বার্তা ছিল মে ডে। তার পরে আর তাঁর থেকে কোনও সাড়া পাওয়া যায়নি।’’ ঘটনার পর পরই তদন্ত শুরু করেছে বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত ব্যুরো (এএআইবি)। সেই তদন্ত রিপোর্ট এলেও দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানা যাবে।