কোমর, আলগোছে, পরগনা, পরদা, বগল— বাংলা শব্দভাণ্ডারে এই কথাগুলো এসেছে ফার্সি থেকে। আলপিন, আলমারি আদতে পর্তুগীজ শব্দ। মুনাফা, মুরুব্বী—এগুলোর মতো অনেক শব্দ অবিচ্ছেদ্যভাবে মিশে গিয়েছে বাংলা ভাষায়। ধাপ্পা হল তুর্কি শব্দ। হিন্দি পড়েঠা থেকে পরোটা, কেবড়া থেকে কেওড়া। এরকম বিশাল তালিকা পেশ করা যায় যেগুলো বাংলা শব্দভান্ডারে ওতপ্রোতভাবে মিশে গিয়েছে। বা, বলা ভাল, যুগ যুগ ধরে একাত্ম হয়ে সেগুলোই জোরদার বাংলা শব্দ।
কিন্তু বলতে পারেন, কেন বাংলায় লিখব বা
বলব গোডাউন, রেজাল্ট, লিস্ট, কোচিং ইনস্টিটিউট, প্রিন্সিপাল, হেডমাস্টার, সেন্টার ইন-চার্জ, হেড, চাইল্ড প্রোটেকশন, অ্যাডভোকেসি, ক্যারিয়ার, সার্টিফিকেট, ইন্টারঅ্যাক্টিভ সেশন, প্লেসমেন্ট, অ্যাকাডেমিক—এরকম শয়ে শয়ে ইংরেজি শব্দ? তালিকা অতি দীর্ঘ। এগুলোর প্রতিটির বাংলা প্রতিশব্দ বা বাংলায় বোঝানোর মত শব্দ রয়েছে।
আমাদের মুখের কথা ছাড়াও বাংলা ভাষার চরম ক্ষতি করছে অধিকাংশ ডিজিটাল। এই ডিজিটাল কথাটা আমরা এখনও বাংলায় চালু করতে পারিনি। বানান বিভ্রান্তির পাশাপাশি আমাদের অধিকাংশের বিন্দুমাত্র চেতনা নেই নিজস্ব শব্দ প্রয়োগের। চেয়ার, টেবিলকে জোর করে না হয় কেদারা, চৌপায়া না লিখলাম! কেক, মাইকের মত ইংরেজি শব্দ ব্যবহার না করে উপায় নেই। কেন উচ্চ মাধ্যমিক কথাটা না লিখে লিখব হায়ার সেকেন্ডারী?
একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল এই পশ্চিমবঙ্গেই সংবাদমাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপ গোষ্ঠীতে বার্তায়ও লেখার সিংহভাগ ইংরেজিতে। তাঁদের কর্তাদের বিষয়টা বহুবার বলেও লাভ হয়নি।
প্রতিদিন আমি অন্তত পাঁচ হাজার শব্দের লেখা লিখি। নীতিগতভাবে কখনও বাংলা লেখায় অনাবশ্যক ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করিনা। কখনও না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে জগদীশচন্দ্র বসু— এঁরা অনেক নতুন বাংলা প্রতিশব্দ উপহার দিয়েছেন। এগুলোর বেশ কয়েকটিকে আমরা একাত্ম করে নিইনি। বরং অবহেলা করেছি। ভাষাটাকে পুজো করিনি। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী বাংলা সংস্কৃতির ধারা বজায় রাখার জন্যই ১৮৯৪ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। তখনকার দিনে সর্বোচ্চ গুণমানী প্রতিষ্ঠান ছিল এটি। তিনি ১৯০৪ থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত এর সভাপতি ছিলেন। লেখা ও বক্তৃতার মাধ্যমে বাঙালিদের বিজ্ঞান চর্চায় অনুপ্রাণিত করেন।
মানভূমের বাংলা ভাষা-আন্দোলন নিয়ে আমাদের আগ্রহ নেই। লাবণ্যপ্রভা ঘোষ ও ভজহরি মাহাতো
আমাদের কাছে অপরিচিত নাম। ‘পরিচিত জনতার সরনিতে’ ওঁদের আনার কোনও আগ্রহ নেই আমাদের। কথাগুলো কেন বলছি জানেন? আজই সেই ১৯ মে। ১৯৬১ সালের এই তারিখে বাংলা ভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেন শিলচরের ১১ জন ভাষা শহিদ।
দিনটি বরাক উপত্যকায় ‘ভাষা শহিদ দিবস’ নামে পরিচিত। ওই ঘটনা আসামে বাংলা ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক ছিল। ২১ ফেব্রুয়ারি এবং ১৯ মে এলে আমাদের যত শোক উথলে ওঠে মাতৃভাষার জন্য। বছরভর খেয়াল থাকে না। খেয়াল রাখার চেষ্টাও করি না।
১৯ মে-র একাদশ শহিদ কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্র দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্রচন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ এবং কমলা ভট্টাচার্য ১৯৭২-এর ১৭ আগস্ট ভাষা আন্দোলনে শহিদ করিমগঞ্জের বিজন চক্রবর্তী এবং ১৯৮৬-র র ২১ জুলাই বাংলা ভাষার দাবির আন্দোলনে আরও দুই শহিদ জগন্ময় দেব ও দিব্যেন্দু দাস— আপনাদের সবাইকে প্রণাম।
—অশোক সেনগুপ্ত। ১৯-৫-২০২৫।
