অনেকগুলো ‘মিথ’ ভেঙে গেল। আন্তর্জাতিক সমীকরণে বেশ কয়েকটা নতুন দিক খুলে গেল। পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিহানার পরে ভারতের প্রত্যাঘাত এবং তার জেরে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে কয়েক দিন ধরে যে সংঘর্ষ চলল, তা থামার পরে পাকিস্তান কী বলছে, সে সব নিয়ে ভেবে লাভ নেই। শাহবাজ় শরিফ একে পাকিস্তানের জয় বলে দাবি করেছেন, না কি ভারতের পরাজয় হিসেবে দেখাতে চাইছেন, তাতে আমাদের কিছু যায় আসে না। ভারত নিজের ঘোষিত নীতি অনুযায়ীই এগিয়েছে।
পাকিস্তান ও পাক অধিকৃত কাশ্মীরের ন’টি জায়গায় জঙ্গিঘাঁটি লক্ষ্য করে আঘাত হানার পরে রাত ১টা ৪৪ মিনিটে ভারত যে প্রেস বিবৃতি প্রকাশ করেছিল, তাতে কী লেখা ছিল মনে করুন। ভারত লিখেছিল, এই প্রত্যাঘাত ‘সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যনির্ভর, পরিমিত এবং অ-প্ররোচনামূলক’। ভারত যে পাকিস্তানের কোনও সামরিক পরিকাঠামো লক্ষ্য করে আঘাত হানেনি, সে কথা বিবৃতিতে স্পষ্ট করে লেখা হয়েছিল। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী যদি উত্তেজনা বৃদ্ধি না-করে, তা হলে ভারতও আর কোনও পদক্ষেপ করবে না বলে সেখানে লেখা হয়েছিল। অর্থাৎ পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু করা ভারতের লক্ষ্য ছিল না। যত ক্ষণ পাকিস্তানের সেনা ভারতে আঘাত হানার চেষ্টা করেছে, তত ক্ষণ ভারত পাল্টা আঘাত হেনেছে। যখন পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ডিজিএমও ভারতীয় সেনার ডিজিএমও-কে ফোন করে সংঘর্ষবিরতির কথা বলেছেন, ভারত বিরতিতে রাজি হয়েছে। ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু করে এই সংঘাতের বিষয়ে ভারত যে নীতি ঘোষণা করেছিল, সেই নীতিতেই ভারত এগিয়েছে। তার থেকে একচুলও সরতে হয়নি ভারতকে। উল্টে কোন কোন ‘মিথ’ ভারত এই ক’দিনে ভেঙে দিতে পেরেছে, আসুন দেখে নিই।
প্রথম ‘মিথ’: যতই সন্ত্রাসবাদী হামলা হোক, পাকিস্তানকে ভারত ছুঁতে পারবে না। দূর থেকেই আস্ফালন করবে। পাকিস্তানের মাটিতে ভারত আঘাত করলেই পাকিস্তান পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করবে।
এই ‘মিথ’ ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। ভারতের প্রত্যাঘাতের আগের মুহূর্ত পর্যন্তও পাকিস্তানের মন্ত্রীরা চিৎকার করে পরমাণু হামলার হুমকি শোনাচ্ছিলেন। ১৩০টা পরমাণু বোমাই ভারতের দিকে তাক করে রাখা আছে বলে দাবি করছিলেন। ভারত প্রত্যাঘাত করার পরে আর একবারের জন্যও সে সব কথা পাকিস্তানের মুখে শোনা যায়নি। পরমাণু অস্ত্রের দায়িত্বে থাকা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পাক প্রধানমন্ত্রী বৈঠক করেছেন বলে একটা খবর রটেছিল। কিন্তু তড়িঘড়ি পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী সেই সংশয়ও কাটিয়ে দেন। তিনি জানান, এমন কোনও বৈঠক প্রধানমন্ত্রী করেননি। ভারত গোটা বিশ্বকে দেখিয়ে দিতে পেরেছে যে, পাকিস্তানের পরমাণু-হুমকিকে এক ধমকে থামিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা অন্য কারও থাক বা না-থাক, ভারতের রয়েছে।
দ্বিতীয় ‘মিথ’: পাকিস্তানে ভারত আঘাত হানলেই ভারতকে চিনের আক্রমণের মুখে পড়তে হবে। শুধু পাকিস্তানের সঙ্গে নয়, চিনের সঙ্গেও ভারতকে যুদ্ধ করতে হবে।
এই ‘মিথ’ও ভেঙে গেল। ভারতের মধ্যেই অনেকে এই আশঙ্কা বার বার প্রকাশ করতেন। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ করার কথা উঠলেই তাঁরা ভারতকে চিন-জুজু দেখাতেন। কিন্তু ১৯৯৯ সালে কার্গিলের যুদ্ধে, ২০১৬ সালে সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পরে এবং ২০১৯ সালে এয়ার স্ট্রাইকের পরেও চিন কিছু করতে পারেনি। ২০২৫ সালে ভারতের ‘অপারেশন সিঁদুর’ আরও অনেক বড় ঘটনা। পাক অধিকৃত কাশ্মীরে নয়, এ বার পাকিস্তানের নিজস্ব ভূখণ্ডে ভারত আঘাত হেনেছে। অন্তত ছ’টা বিমানঘাঁটিতে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি করেছে। পাকিস্তানের গুরুত্বপূর্ণ রেডার বেস ধ্বংস করে দিয়েছে। চিন মাঝেমধ্যে বিবৃতি দেওয়া ছাড়া কিছুই করতে পারেনি।
তৃতীয় ‘মিথ’: চিন সামরিক ভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। তাদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নাকি প্রায় গোটা পৃথিবীর কাছে দুর্ভেদ্য। তাই চিনকে নাকি এখন খুব সমীহের চোখে দেখতে হবে।
চিনের এই বানানো ভাবমূর্তি ভেঙেচুরে তছনছ। ভারত-পাকিস্তান সংঘাতে পাকিস্তান মূলত চিনা প্রযুক্তিই ব্যবহার করছিল। দেখা গেল, চিনা এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ভারতীয় আক্রমণের সামনে দাঁড়াতেই পারছে না। দেখা গেল, চিনা ড্রোন পাঠিয়ে ভারতে হামলার চেষ্টা করে কোনও লাভ হচ্ছে না। প্রায় সব ড্রোনকেই মাঝ-আকাশে ভারত নষ্ট করছে। দেখা গেল, চিনা ফাইটার জেটগুলোও ভারতের তেমন কোনও ক্ষতি করতে পারছে না।
এতে চিনের দু’রকম ক্ষতি হল। প্রথমত, চিনের সামরিক সক্ষমতার বিষয়ে গোটা বিশ্বে যে ধারণা তৈরি হয়েছিল, তা বড় ধাক্কা খেল। দ্বিতীয়ত, চিনের কাছ থেকে যে সব দেশ অস্ত্র ও যুদ্ধ সরঞ্জাম কেনার কথা ভাবছিল, তাদের মনে চিনা সরঞ্জামের সক্ষমতা সম্পর্কে বড়সড় প্রশ্নচিহ্ন তৈরি হয়ে গেল।
ফোন এসেছিল পাকিস্তান থেকেই
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলছেন, ভারত-পাকিস্তানের সংঘাত তিনিই থামালেন। শাহবাজ় শরিফ দাবি করছেন, পাকিস্তান জিতে গেল। আবার বলছি, যে যা বলছেন, বলতে দিন। ভারতের বিদেশসচিব আনুষ্ঠানিক ভাবে যে বিবৃতি দিয়েছেন, সেটা খেয়াল করুন। তিনি সরকারি ভাবে জানিয়েছেন, পাকিস্তানের ডিজিএমও ফোন করেছিলেন ভারতের ডিজিএমও-কে। এখনও পর্যন্ত সরকারি ভাবে এ কথাকে আমেরিকা বা পাকিস্তান অস্বীকার করতে পারেনি। পাকিস্তানের ডিজিএমও ফোন করেননি, এ কথা পাক প্রধানমন্ত্রীও বলে উঠতে পারেননি। কারণ মুখে তিনি যা-ই বলুন, আসল ঘটনা তাঁর চেয়ে ভাল ক’জনই বা জানেন?
আমেরিকার উদ্যোগ এবং ভারতের নতুন ‘সমর তত্ত্ব’
আসল ঘটনা আমরাও জানি। আর আমাদের স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, এই সংঘাত থামানোয় আমেরিকা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। আমেরিকার কথা ভারত মেনেও নিয়েছে। কেন আমেরিকা উদ্যোগী হল, সে বিষয়ে আজ কিছু বলছি না। পরে বলব। কিন্তু কেন আমেরিকার অনুরোধ ভারত মানল, সে ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া কঠিন নয়। আমেরিকার অনুরোধে ভারতের এই মান্যতা ভারতের নতুন ‘সমরতত্ত্ব’কে গোটা বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করে দিল। ভারতের নতুন ‘সমরতত্ত্ব’ কী? সেটা হল— ভারতের বিরুদ্ধে যে কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলাকে এখন থেকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা হিসেবে দেখা হবে। এটা খুব শক্তিশালী অবস্থান। এর অর্থ হল, এর পর ভারতে আর কোনও সন্ত্রাসবাদী হামলা হলে ভারতকে আলোচনার টেবিলে বসে সব মিটিয়ে নেওয়ার চাপ কেউ দিতে পারবে না। কিন্তু এই নতুন ‘সমরতত্ত্ব’কে বাস্তবায়িত করতে ভারতকে নিজের সক্ষমতায় আরও শান দিতে হবে। ভারতের প্রত্যাঘাত প্রক্রিয়ায় উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়াতে হবে। আমাদের প্রত্যুত্তর আরও দ্রুত দিতে হবে। এ বারে প্রত্যাঘাত করতে আমরা যতটা সময় নিয়েছি, ততটা সময় নিলে চলবে না। তাঁর জন্য আমেরিকার কাছ থেকেই আমাদের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নিতে হবে। এবং সেই সহযোগিতা এখন আমরা নিজস্ব অধিকারে চাইতে পারব। আমরা আমেরিকাকে বলতে পারব, তোমাদের অনুরোধে আমরা যুদ্ধ থেকে পিছিয়ে এলাম। কিন্তু সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আমাদের যে ঘোষিত নীতি, তার রূপায়ণে এ বার তুমি আমাকে সাহায্য করো। এবং ভারতের এই নতুন ‘সমরতত্ত্ব’ ঘোষণার পরে যে পরিস্থিতি, তার উপরে দাঁড়িয়েই যেহেতু সংঘর্ষবিরতি হয়েছে, সেহেতু ভারতের এই নীতির প্রতি সব পক্ষের অনুমোদন রয়েছে, সে কথা বলাই বাহুল্য।
সৌদি আরবের উদ্যোগ
এ বারের সংঘাত থামানোয় সৌদি আরবের ভূমিকাও যথেষ্ট। ইতিহাস বলছে, অতীতের সব সংঘাতে সৌদি পাকিস্তানের পাশে থেকেছে। কিন্তু এ বারের পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। ভারতের সঙ্গে এখন সৌদির সম্পর্ক যথেষ্ট ভাল। অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক, দু’রকম সমীকরণই রয়েছে তার নেপথ্যে। তাই সৌদি এ বার কোনও পক্ষ না-নিয়ে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে মধ্যস্থতা করার চেষ্টা করেছে। ভারতকে সৌদি অনুরোধ করেছে সংঘাত আর না-বাড়াতে। ভারত জানিয়েছে, সংঘাত বাড়ানোর ইচ্ছা ভারতের নেই। কিন্তু পাকিস্তান যত বার হামলার চেষ্টা করবে, ভারত তত বার পাল্টা আঘাত করবে। ভারতের সেই অবস্থানকেই সৌদি মান্যতা দিয়েছে। পাকিস্তানের উপরে চাপ বাড়িয়েছে।
চিন কেন উদ্যোগী?
সকলেই হয়তো খেয়াল করেছেন, চিনও বারবার এই সংঘাত থামানোর কথা বলছিল। তার পিছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। কিন্তু আগেই বলেছি, অন্যতম বড় কারণ হল নিজেদের মুখ না-পুড়তে দেওয়া। চিনা অস্ত্রাগারের দুর্বলতা রোজ প্রকট হল গোটা বিশ্বের সামনে। পর পর চার রাতে পাকিস্তান চিনা ড্রোন পাঠিয়ে হামলার চেষ্টা করল। এক বারও তেমন কোনও উল্লেখযোগ্য ক্ষতি করতে পারল না। পর পর চার রাতেই ভারত উপযুক্ত প্রত্যাঘাত করল। চিনা আকাশ সুরক্ষা ব্যবস্থা তাকে সামলাতে পারল না। রোজ চিনের অস্বস্তি বাড়ছিল। তাই চিনও চাইছিল এই সংঘাত থেমে যাক।
পাকিস্তান কেন মানল?
এত বড় আঘাত পাকিস্তানের মাটিতে ভারত গত অনেক দশকে হানেনি। পাকিস্তানের গভীরে আঘাত হেনে মুরিদকেতে লশকর এবং বহাওয়ালপুরে জইশের সদর দফতর ভারত গুঁড়ো করে দিয়েছে। এত জন সন্ত্রাসবাদীর মৃত্যু হয়েছে। সন্ত্রাসবাদের পৃষ্ঠপোষক পাকিস্তানের সেনা কিছুতেই তা মেনে নিতে পারছিল না। কিন্তু ভারতে যত বার হামলা করতে যাচ্ছে, তত বার মুখ থুবড়ে পড়ছে। পাল্টা হানায় ভারত কোনও না কোনও সামরিক পরিকাঠামো ধ্বংস করে দিচ্ছে। এই অবস্থায় দাঁড়িয়ে সেনাপ্রধান আসিম মুনির কিছুতেই সংঘর্ষ থামাতে পারছিলেন না। কারণ মুখরক্ষার উপায় খুঁজে পাচ্ছিলেন না। তার পরেও পাকিস্তানের ডিজিএমও ফোন করে সংঘর্ষবিরতির প্রস্তাব দিতে বাধ্য হলেন কেন? কারণ প্রথমত, পাকিস্তান বুঝতে পারছিল, সংঘাত যত এগোবে, পাকিস্তান তত ক্ষয়ক্ষতিতে ডুবতে থাকবে। পাকিস্তান বুঝতে পারছিল যে, ভারত এখনও সংযত ভাবে আঘাত হানছে। কিন্তু যে ভাবে পাকিস্তানের আকাশ-সুরক্ষা ব্যবস্থার দুর্বলতা প্রকট হয়ে গিয়েছে, তাতে এর পরে ভারত আঘাত হানবে পাক বাহিনীর কম্যান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টারে। তার পরে আঘাত হানবে রাওয়ালপিন্ডিতে পাক সেনার সদর দফতরে। রাওয়ালপিন্ডিতে একাধিক আঘাত হেনে ভারত বুঝিয়েও দিয়েছিল যে, আসিম মুনিরদের সদর দফতরে ভারত যখনতখন আঘাত হানতে পারে। যুদ্ধ আরও গড়াতে থাকলে পাকিস্তানের নানা অর্থনৈতিক লক্ষ্যবস্তুতে ভারত আঘাত হানবে বলেও পাকিস্তানের আশঙ্কা ছিল। দ্বিতীয়ত, পাকিস্তানের উপরে আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমশ বাড়ছিল। ভারতের কোনও একটা বড় ক্ষতি না-করতে পারা পর্যন্ত জেনারেল মুনির যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার যে পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, সেই পরিকল্পনাকে আমেরিকা, চিন, সৌদি আরব অনুমোদন করেনি। আগে এই আন্তর্জাতিক চাপ ভারতের উপরে আসত। এ বার পরিস্থিতি উল্টো ছিল। আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়েই পাকিস্তানের সেনাপ্রধানকে পিছু হঠতে হল এ বার। পাকিস্তান এ বার এ কথাও বুঝে গেল যে, সন্ত্রাসবাদী হামলা হলে ভারতের প্রতিক্রিয়া আর অতীতের মতো হবে না। অতীতের চেয়ে অনেক বেশি মাত্রার প্রত্যাঘাত হবে।