‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগানের আড়ালে কমিউনিজমের আসল রূপ ‘গুলাগ’

‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ স্লোগানের আড়ালে মার্ক্সবাদীয় তত্ত্বের বাস্তবায়নের চেষ্টা একবিংশ শতাব্দীতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। সত্যিই আজ সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হোক বা বিজ্ঞানী বা নৃত্যশিল্পী বা কোনো এক লেখক — দেশ-কালের সীমানা পেরিয়ে মানুষকে এক করেছে। বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে আদান-প্রদান বেড়ে ভারতবর্ষের মন্ত্রকেই প্রতিষ্ঠিত করছে — বসুধৈব কুটুম্বকম।
যে মজদুর ভারতবর্ষের ল্যাবোরেটরিতে করোনার ভ্যাক্সিন তৈরি করলো, তিনি ব্রাজিলের মজদুর কে দেখেন নি কিন্তু তার শ্রম ভারত-ব্রাজিলের মধ্যে মৈত্রীর বন্ধন তৈরি করে দিল।আপন আপন সংস্কৃতি নিয়ে তারা আছেন কিন্তু তারা সেই তথাকথিত ‘থিসিস’ কে জিইয়ে রেখেই ‘আন্তর্জাতিক’ । জাতীয়তাকে ভেঙে ‘আন্তর্জাতিক’ হতে হয় নি।
ভূমিকম্প বিধ্বস্ত তুর্কির জন্য ভারতীয় ডাক্তার, বিপর্যয় মোকাবিলার দল তুর্কি পৌঁছে গেলো সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে, তাদের শ্রম দিয়ে তুর্কির ভারত-বিরোধিতা সত্ত্বেও মৈত্রীর হাত বাড়িয়ে দিলেন। কই নিজের দেশের গন্ডীর মধ্যে থেকেই তুর্কির মানুষ ‘সর্বে ভবন্তু সুখিনঃ সর্বে সন্তু নিরাময়াঃ’-র বাস্তবিক রূপটি দেখতে পেলো।
নিজের দেশের সংস্কৃতির বিরোধিতা করে কেউ এক হয় নি কিন্তু দেশের সংস্কৃতির মধ্যে থেকেই দুনিয়াকে এক করতে পেরেছে। আবার ভারতের মিসাইল তৈরি করা বিজ্ঞানী বা শ্রমিক, যারাই ভারত কে শত্রুদেশ থেকে রক্ষার্থে নিজের শ্রম দিচ্ছেন তারা কি সন্ত্রাসবাদী দেশ পাকিস্তানের এক মজদুরের উদ্দ্যেশ্যের সাথে একাত্মতা অনুভব করবেন। এর উত্তর নিশ্চিতভাবে ‘না’। শ্রমমূল্যের থেকে সেখানে দেশপ্রেমের প্রাসঙ্গিকতা সন্দেহের ঊর্ধ্বে।
প্রশ্ন আরো আছে । শুধু মজদুর এক হবে আর মালিক ? কার বিরুদ্ধে এক হবে? কেনো হবে?
এখন যে কম্পিউটারের সফটওয়্যার তৈরি করে সেও কি মজদুর নয়? শুধু কায়িক শ্রম মজদুরি নয়।
বৌদ্ধিক শ্রম প্রয়োগ করে কায়িক শ্রম কমানোতেই কি বিজ্ঞানের সাফল্য ধরা হয় না?

পুঁজি না থাকলে একটি বড় শিল্প, বড় নিয়োগ কখনোই হতে পারে না।পুঁজি আসবে কায়িক বা বৌদ্ধিক শ্রমের ফলে উৎপন্ন লাভ থেকে।লভ্যাংশ কে সবসময় যদি শ্রমিকদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয় তাহলে নতুন প্রয়োগ হবে কি করে?
নদীর জল বাঁধ দিয়ে ধরে রেখে প্রয়োজনের সময় ছেড়ে দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হয় ঠিক তেমনি অর্থ মজুদ করে সাধারণ মানুষের জন্য স্বাস্থ্য, শিক্ষাক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়।পুঁজি, তাই খারাপ নয় ; খারাপ হচ্ছে পুঁজিবাদ। সাম্য খারাপ নয় কিন্তু সেই সাম্যের নামে পাখির আকাশে ওড়া আর মাছের সাঁতার কাটাকে এক বলে তাকে ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ বললে কম্পিউটার ব্যবহার করা প্রজন্ম সহজে মেনে নিবে না।
বর্তমান প্রজন্ম, এখন বাড়িতে বসে মোবাইলের এ্যাপ তৈরি করছে আর ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের’ নামে একসময় কম্পিউটারের বিরোধিতা করা হয়েছে।
তারা সবসময়ই দেশের সংস্কৃতি, প্রচলিত ব্যবস্থাকে ভাঙতে ‘অ্যান্টি থিসিস’ দেয় আর ভাবে কিছু একটা ‘সিন্থেসিস’ হয়ে যাবে কিন্তু প্রায় ১০০ বছরে মার্ক্সবাদ কিছুই দিতে পারেনি ভারতবর্ষে।

দিয়েছে শুধু তোষণ, ভারতবর্ষের কয়েক হাজার বছরের সংস্কৃতির বিরোধিতা।

মার্ক্সবাদের ‘Theory of surplus’ বলে শ্রমিকের শ্রমের ফলে উৎপন্ন লভাংশ , পুঁজিবাদীর পুঁজির রূপ নেয় আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থা লভ্যাংশ বৃদ্ধির জন্য শ্রমিককে নিরন্তর শোষণ করতে থাকে।’সর্বহারার একনায়কত্ব’ নাম নিয়ে যে তন্ত্র বা বলা ভালো যে ‘একনায়ক’ সোভিয়েত রাশিয়ার ক্ষমতা দখল করলো তারা অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী হওয়ার জন্য কৃষক-শ্রমিককে ভরপেট খাওয়া , পর্যাপ্ত ঘুম, স্বাভাবিক বাসস্থান , স্বাধীন জীবন পর্যন্ত দেয় নি ; লভ্যাংশের অধিকার সেখানে কল্পনার বাইরে। যেখানে ‘একনায়কত্ব’ থাকে সেখানে ভুল ধরিয়ে দেওয়া প্রাণদণ্ড পাওয়ার মতো অপরাধ।
মার্ক্স যে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার সমালোচনা করে তা থেকে মুক্তির উপায় দিয়েছিল তা দিয়ে শ্রমিকের মুক্তি তো ঘটেই নি বরং পুঁজিপতির জায়গা নিয়েছিল একটা গোটা দেশের শাসনব্যবস্থা। মানুষ কে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক চাহিদা সম্পন্ন জীব হিসেবে দেখা কমিউনিজমের ধ্বজবাহকরা, সোভিয়েত রাশিয়ায় নির্মাণ করেছিল বিশ্বের ইতিহাসের সবথেকে বড় শ্রম-কারাগার।

‘গুলাগ’ এই শব্দটির মধ্যে সোভিয়েত রাশিয়ার স্বৈরাচারী শাসকদের নৃশংসতা আর কমিউনিজমের ব্যর্থতা লুকিয়ে আছে। প্রতিবিপ্লবী , দেশদ্রোহী , গুপ্তচর, নাশকতায় অভিযুক্ত ও রাজনৈতিক বন্দীদের গুলাগের শ্রমশিবিরে অমানবিক পরিস্থিতিতে জোরপূর্বক কাজ করানো হতো। জার্মানিতে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের আবির্ভাবের অনেক আগেই সোভিয়েত রাশিয়াতে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের প্রয়োগ শুরু হয়। লেনিনের আমলেই গুলাগ তৈরি হয় আর স্তালিনের উচ্চাকাঙ্খী পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য গুলাগ ক্যাম্পের সংখ্যা বাড়তে থাকে।
বিভিন্ন দেশে বামপন্থী দলগুলো স্তালিনের ছবিকে সামনে রেখে শ্রমিকদের অধিকারের জন্য মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও মানবাধিকারের কথা বলে কারণ তারা জানে ‘গুলাগ’ এর ইতিহাস রাজনৈতিক আলোচনা ও ইতিহাস পাঠক্রমে জায়গা পায় নি বলে সাধারণ মানুষ এই নৃশংসতার ইতিহাস জানে না। মার্ক্সবাদ সমাজকে অর্থনৈতিক দিক থেকে শোষক ও শোষিত হিসেবে ভাগ করে। আর শোষিতের অধিকার আদায়ের জন্য ‘Dictatorship of Proletariat’ অর্থাৎ ‘সর্বহারার একনায়কত্ব’ প্রতিষ্ঠার কথা বলে। কিন্তু একবার একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে , সেই তন্ত্র যে শোষকের জায়গা দখল করবে না এর কোনো নিশ্চয়তা ও যুক্তিসঙ্গত বিশ্লেষণ মার্ক্সবাদ দেয় না। বরং সোভিয়েত রাশিয়া প্রমাণ করেছে যে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে শ্রমিকের অধিকার দূরের কথা, মানবিক অধিকার পর্যন্ত সুরক্ষিত থাকে না। আবার যখন স্বৈরাচারী একনায়ক ক্ষমতা দখল করে তখন শুধুমাত্র ক্ষমতা দখল করে রাখার তাগিদে ও নিজের ব্যক্তিগত মত প্রতিষ্ঠার জন্য কমিউনিজমের সমর্থক ও তার সহযোগীদের হত্যা করতেও দ্বিধা করে না। এমনকি একই লক্ষ্যপূর্তির জন্য সর্বাধিনায়কের থেকে ভিন্ন মত পোষণের জন্য প্রাণ হারানোর উদাহরণ সোভিয়েত রাশিয়ায় প্রচুর আছে। মার্ক্সবাদ অনুযায়ী সমাজকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বিশেষ শ্রেণীকে ‘শ্রেণী শত্রু’ বলে তাদের নিশ্চিহ্ন করার প্রক্রিয়া জারের পতনের পর থেকেই চলতে থাকে।
সর্বাধিনায়কের বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হলেই তাকে ‘শ্রেণী শত্রু’ তকমা দিয়ে দিলে সেই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রশ্ন করার অধিকার একনায়কতন্ত্র দেয় না অর্থাৎ আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো জায়গা থাকে না।
সোভিয়েত রাশিয়ায় শিল্পায়নের গতি ও পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য প্রচুর শ্রমিকের প্রয়োজন ছিল। গুলাগের শ্রমশিবিরের মাধ্যমে স্তালিন সেই প্রয়োজন মিটিয়েছিল। পরিকল্পনা ছিল সোভিয়েত রাশিয়া কে দরিদ্র, দুর্বল কৃষি অর্থনীতি থেকে একটি শিল্পশক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা। স্তালিনের ধারণা ছিল কৃষি সমষ্টি করণের মাধ্যমে যে অর্থাগম হবে তা দিয়ে শিল্পের উন্নতি হবে।যে মার্ক্সবাদ, পুঁজিবাদকে শোষণের যন্ত্র বলেছে সেই মার্ক্সবাদ কে সামনে রেখে একজন ‘একনায়ক’ গোটা রাষ্ট্রকেই আপন লক্ষ্যপূর্তির জন্য বড় পুঁজি সৃষ্টির জন্য কৃষির সমষ্টিকরণ ও বিনামূল্যে বিশাল শ্রমিক বাহিনী পাওয়ার জন্য গুলাগ নামের শ্রম-কারাগার সৃষ্টি করেছিল।
গুলাগ-ফেরৎ চিত্রশিল্পী শব্দের পরিবর্তে ছবি দিয়ে কলিমা গুলাগের ভয়াবহতা জনসমক্ষে এনেছিলেন।তার কথায় — “Some may say that the Gulag is a forgotten part of history and that we do not need to be reminded. But I have witnessed monstrous crimes. It is not too late to talk about them and reveal them. It is essential to do so. Some have expressed fear on seeing some of my paintings that I might end up in Kolyma again—this time for good. But the people must be reminded… of one of the harshest acts of political repression in the Soviet Union. My paintings may help achieve this.” ।
মানুষকে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা মার্ক্সবাদের ফল — ‘গুলাগ’।
সমাজকে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিভিন্ন শ্রেণীতে ভাগ করার ফল ‘গুলাগ’। মালিকপক্ষের লাভের অনিয়ন্ত্রিত লোভের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার যে পথের সন্ধান দেয় মার্ক্সবাদ তা আসলে এক মরিচীকা । এই পথে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে যে নরকের দরজা খোলে তার নাম ‘গুলাগ’।

মার্ক্সবাদ শুধু অর্থকেই পৃথিবীর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে দেখতে গিয়ে ভারতবর্ষের দান ও ভক্তিকে
বুঝতে পারে নি। সমস্ত সম্পদের অধিকারী হয়েও ভারতবর্ষে রাজারা কেনো গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী হয়েছে , কেনোই বা সর্বজ্ঞ পন্ডিত গরীবের কুটীর থেকে তুলে এনে শাস্ত্র-শস্ত্রের জ্ঞান দিয়ে একজনকে বিশ্বজয়ী সম্রাট করে নিজে সমস্ত ভোগ থেকে দূরে থাকে ।
কোন উদ্দেশ্যে নিমাই পন্ডিত গৃহসুখ ত্যাগ করে ভক্তির গঙ্গা বইয়ে দেয় , কোন উদ্দেশ্যে এক ১২ বছরের কিশোর পায়ে হেঁটে ভারতবর্ষ ভ্রমণ করে তর্কে বড় বড় পন্ডিতদের পরাজিত করে ভারতবর্ষের চারপ্রান্তে চারটি মঠ প্রতিষ্ঠা করে, কোন উদ্দেশ্যে এক ৩২ বছরের ‘শিক্ষিত’ যুবক অনাহারে থেকে, গতানুগতিক জীবন ত্যাগ করে ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতি-সভ্যতার মহানতা বিশ্বমঞ্চে শোনাতে যায় , কি পাওয়ার জন্য একজন ঔষধ ব্যবসায়ী , সমস্ত কিছু ত্যাগ করে ৬০ বছর বয়সে বিশ্বভ্রমণে বের হয়ে ‘কৃষ্ণনাম’ ছড়িয়ে দেয় সারা বিশ্বে—- এসবের উত্তর দিতে পারে না ‘মার্কসবাদ’ যাকে এই বিদেশীয় তত্ত্বের সমর্থকরা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ বলে আত্মতুষ্টি লাভ করেন।
এ যে শুধু ভারতবর্ষেই সম্ভব, বারবার সম্ভব, কয়েক হাজার বছর ধরে সম্ভব।
ভারতবর্ষ কে ইউরোপীয় চশমা দিয়ে দেখলে বোঝা যাবে না, ভারতবর্ষ কে বুঝতে হলে ভারতীয় দৃষ্টি দিয়েই দেখতে হবে।
তাই ভারতীয় দৃষ্টিতে স্লোগান হওয়া উচিত ‘মজদুর দুনিয়া কে এক করো’।

পিন্টু সান্যাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.