(‘কিচেন গার্ডেন’ হল রান্নাঘরের অনতিদূরে রাখা শাকসব্জির যোগানদায়ী এক ক্ষুদ্র বাগিচা। চট করে ফ্রেস-সব্জি তুলে নিয়েই, তা দিয়ে রান্না করা। সঙ্গে থাকবে কিছু উপযোগী ফলের গাছ। দৈনিক খাবারে ফল-সংযুক্তি ঘটাতে হবে শরীর গঠনের জন্য এবং নিরাপদ জীবনচর্যার জন্য। কারণ ‘বারোমাসে বারো ফল/ না খেলে যায় রসাতল।’ লিখেছেন দেবাঞ্জন ভট্টাচার্য এবং ড. কল্যাণ চক্রবর্তী)

১. পুষ্টি বাগানের প্রেক্ষাপট:
‘পুষ্টি বাগান’ (Nutritional Garden) হচ্ছে খাদ্য-নিরাপত্তার (Food security) অব্যবহিত পরে পুষ্টি-নিরাপত্তার লক্ষ্যে (Nutritional security) একটি গৃহলালিত উদ্যোগ। গৃহের এই সমষ্টিগত উদ্যোগ দেশকে পুষ্টিমূল্যে বৈভবশালী করে তুলতে পারে। আঞ্চলিক ইতিহাস মিলেই হয় জাতির বৃহত্তর ইতিহাস রচনা। তেমনই মাইক্রো গার্ডেনের উৎপাদিত ফসলের ক্ষুদ্রতর মাইক্রো-ইকোনোমিকস বুনিয়াদ গঠন করে দিতে পারে দেশের ম্যাক্রো-ইকোনোমিকস। দেশের সব মানুষের মুখে তুলে দিতে হবে পুষ্টির নানান রসদ, তা চষতে হবে বাড়ির লাগোয়া ভূমিখণ্ডটুকুতে। এই হল পুষ্টি বাগানের মূল চিন্তন।

যে উদ্যোগে আবাস সন্নিহিত যৎসামান্য ভূমিকেও আলগোছে ফেলে না রেখে, বৈচিত্র্যময় নানান ফসলের মিশ্রচাষ করে জমির সদ্ব্যবহার করা সম্ভব হয়, তার মধ্যেই নির্মিতি লাভ করে পুষ্টি বাগান। ফাঁকা জমি যদি না থাকে, আমরা ভাবতে পারি গৃহের চাল-মাচাটুকুর কথা। আমরা ভাবতে পারি পুকুর পাড়ের উঁচু জায়গাটুকুর কথা। গোয়ালঘরের চালে তুলে দিতে পারি সীমলতা বা কুমড়োলতা। গোয়ালের পারিপার্শ্বিক ফাঁকা জায়গাও আমাদের নজর এড়ায় না। বাড়ির চৌহদ্দিতে বরাদ্দ বেড়ার উপর অনায়াসে চড়িয়ে দিই উচ্ছে, ঝিঙ্গে, কুঁদরির মতো ফসল। গৃহের প্রবেশপথে খিলানের মতো গেটের মাথায় প্যাশান ফ্রুটের ঝুমকোলতা। আলের উপযুক্ত স্থানে শশা, টক ঢ্যাঁড়শ, বকফুল। জলা জায়গায় জেগে ওঠা শুখা মরশুমের ভূখণ্ডটি হতে সাময়িক সবুজ বাগিচা। টব বা বস্তায় নিবিড়ভাবে, সমন্বিতভাবে কৃষি পদ্ধতি অবলম্বন করে নিত্য ব্যবহার্য নানান কৃষি সামগ্রী উৎপাদন করতে পারি।

পুষ্টিবাগান আমাদের দৈনিক-গৃহীত-খাদ্যে পুষ্টিমূল্য যোগ করে। পরিকল্পিতভাবে পছন্দসই নানান উদ্ভিদ যেমন শাকসব্জি, ফলমূল, উপকারী মশলাপাতি, ওষধি-বীরুৎ, গুল্ম, খাদ্যদায়ী কিছু অনুচ্চবৃক্ষ থেকে আসে আমাদের পুষ্টিমূল্য। উন্নয়নশীল দেশে পুষ্টি সম্পর্কে অজ্ঞতা দূর করে পুষ্টিবাগান। আর্থিক অনটনের মধ্যে পুষ্টি সরবরাহের দুয়ার যায় খুলে, অপুষ্টির হাত থেকে মানুষকে রেহাই দেয় পুষ্টিবাগান। ভারতীয় সংস্কৃতিতে পুষ্টি বাগান হচ্ছে দেবী শাকম্ভরী দুর্গার উদ্ভিজ্জ রূপ, সবুজ ও সোনালি তাঁর আশীর্বাদ। দেবী অন্নপূর্ণা যেখানে খাদ্য-নিরাপত্তার দেবী, দেবী শাকম্ভরী হচ্ছেন পুষ্টি-নিরাপত্তার দেবী।

২. পুষ্টি বাগানের উদ্দেশ্য:
কেন বাংলায় বিবিধ অবকাশে কৃষি বিজ্ঞানী ও পুষ্টিবিশারদেরা আবাস সন্নিহিত পুষ্টিবাগান রচনার কথা বলেন? একটি কৃষক পরিবারের পক্ষে, একজন ভৌম-সক্ষম গৃহস্বামীর পক্ষে কোন একটি বাস্তু বাগানে উৎপাদিত সামগ্রী পরিমাণে কম মনে হলেও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গীতে রাজ্য বা রাষ্ট্রীয় উৎপাদনের নিরিখে এই পুষ্টিগত ভৌম উৎপাদনের সমবেত পরিমাণ নেহাৎ কম নয়। যেহেতু নিজের চাহিদা ও পছন্দমত গৃহস্বামী বা গৃহকর্ত্রী তার নিজের পরিবারের শ্রম-সামর্থ্যে এই টাটকা-উৎপাদন দিনের দিন তুলে নেন এবং অন্ন ও বিবিধ ব্যঞ্জনের সঙ্গে ব্যবহার করেন, তাই এই উৎপাদনের মধ্যে কোনো অপচয় ঘটে না। টাটকা সব্জি, ফল ও অন্যান্য দৈনিক পুষ্টিদ্রব্য গ্রহণের যে সুপারিশ পুষ্টিবিজ্ঞানী ও চিকিৎসকেরা করে থাকেন, পুষ্টিবাগান সে উদ্দেশ্যকেই চরিতার্থ করে। পারিবারিক শ্রম দিয়ে বাড়ির আবর্জনা, বাগানের আগাছা, সব্জি ও ফলের খোসা, গৃহপালিত পশুর মলমূত্র যথাস্থানে পচিয়ে জৈবসার উৎপাদন করে পুষ্টিবাগানে ব্যবহার করা যায়। এই উদ্যোগে চাষের খরচ অত্যন্ত কম। উপরন্তু গৃহ-সংলগ্ন অব্যবহৃত জমির সদ্ব্যবহার সম্ভব হয়। কাজে লাগানো যায় গৃহস্থালি কাজে ব্যবহারের পর পরিত্যক্ত জলটুকুও। পরিবারের সদস্যরা তাদের সুবিধাজনক সময়ে বাগানের কাজ করতে সক্ষম হবেন। এমনকি শিশু ও কিশোরেরাও এই পুষ্টিবাগান পরিচর্যার মাধ্যমে পরবর্তী মূল চাষের অভিজ্ঞতা অর্জন করবেন। তৈরি হবে পারিবারিক শ্রমদিবস। দৈনিক বাজারের খরচ অনেকটা কমবে। উদ্বৃত্ত যদি কিছু থেকে যায়, তা বিক্রি করে কিছুটা আয় করা যাবে। সর্বোপরি গৃহের নান্দনিক সৌকর্য বৃদ্ধি পাবে, বাগান মানেই তাই। সবুজের অনুপম তুলিতে গৃহ পরিবেশ মনোমুগ্ধকর হবে৷ পুষ্টিবাগানের মাপ ছোটো হলেও, তা পরিণত হবে এক উর্বর কৃষিক্ষেত্র। ভূমিক্ষয় রোধেও পুষ্টিবাগান উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে। পাহাড়ি এলাকায় পুষ্টিবাগানে রোপিত ফসলের তালিকায় দীর্ঘমেয়াদী প্লটে সেই অঞ্চলের উপযোগী সাব-ট্রপিক্যাল (নাতিশীতোষ্ণ ফসল) ও টেম্পারেট ফসল (শীতপ্রধান অঞ্চলের ফসল) দুই একটা সংযুক্ত করে নেওয়া যায় যা পাহাড়ি এলাকায় ভূমিক্ষয় রোধ করতে সাহায্য করে, যা অনুর্বর জমি কিংবা অম্লজমি পুনরুদ্ধার করতেও সহায়ক ফসলরূপে বিদ্যমান থাকে। আমরা চাই, যথাসম্ভব কম দূষণের কৃষিকাজ। পুষ্টি বাগান তারই অনুষঙ্গে রচিত। তাই পুষ্টিবাগান যথাসম্ভব জৈবিক পদ্ধতিতেই চাষ হওয়া বাঞ্ছনীয়।

পুষ্টি বাগানে তৈরি কৃষিপণ্য খাবো পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের স্বার্থে এবং সপরিবারে-সবান্ধবে বাঁচতে এবং বাঁচাতে। আমরা দৈনিক খাদ্য গ্রহণ করি কেবল পেট ভরাতে নয়, কেবল পুষ্টি লাভ করতেও নয়, নীরোগ থাকতে এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থেকে সাত্ত্বিক জীবনলাভ করতে। রাসায়নিক-কৃষি অনুসরণ করে সেই পরিবেশবান্ধব জীবনচর্যা সম্ভব নয়। দেহের কোষ-কলায়, নাড়িতে, স্নায়ুতে বিষের অবশেষ নিয়ে; বিষাক্ত নিঃশ্বাস ফেলে সাত্ত্বিক জীবনলাভ সম্ভব নয়। প্রকৃতির মাঝে থাকা মানে প্রকৃতি-দত্ত কৃষি সামগ্রী ভোজন করা, কংক্রিটের জঙ্গলের মধ্যেও যতটা সম্ভব সবুজে-শ্যামলে ভরিয়ে দেওয়া। আর সেজন্যই পুষ্টিবাগানকে জৈবকৃষির আওতায় আনা। সেজন্যই শহর-নগর-রাজধানীর সূর্যকরোজ্জ্বল বিস্তীর্ণ ছাদ, বারান্দা, জানালার প্রান্তে সুযোগ মত সব্জি ও ফলের গাছ লাগিয়ে তা জৈব-সম্মতভাবে চাষ করা। এমনকি ঘরের ভেতরে সুযোগমতো মাশরুমের চাষও করে নিতে পারা। রাসায়নিক চাষের দৌরাত্ম্যে বাড়ছে মহিলাদের ব্রেস্ট-ক্যান্সারের মত মারণ রোগ, শিশুদের লিউকেমিয়া, বয়স্ক মানুষের রক্ত ও স্নায়বিক ব্যাধি। বাড়ছে চর্মরোগের প্রকোপ, টিউমার, জিনগত বৈষম্য, অন্তঃক্ষরা নানান গ্রন্থির সমস্যা। এরজন্য পুষ্টি বাগান একটি আশীর্বাদ হয়ে উঠতে পারে।

৩. বাংলার শাক-সংস্কৃতি:
খনার বচনে আছে, “চাল ভরা কুমড়ো লতা / লক্ষ্মী বলেন, আমি তথা।” এই প্রবাদ আমাদের দেখিয়ে দেয়, ধান্যলক্ষ্মী হয়ে উঠেছেন শাকম্ভরী-লক্ষ্মী। মার্কেণ্ডেয় পুরাণে আমরা শাকম্ভরী-দুর্গার স্তোত্র পাই, দেবী সেখানে নিজ দেহ থেকে শাকসব্জি ও ফলমূল হয়ে অজন্মার হাত থেকে মর্ত্যলোককে বাঁচাচ্ছেন এবং পুষ্টিবর্ধন করছেন। পুষ্টি-বাগান রচনা ভারতবাসীর কাছে কেবল প্রয়োজন নয়, পুষ্টিবাগান ভারতীয় ধর্ম-সংস্কৃতির অঙ্গ। কার্তিক পুজোর সময় যে শস্য-সরা রচনা করা হয়, তাতে বিবিধ খাদ্যশস্যের পাশাপাশি কচু ও সুষনি শাকের চারাও লাগানো হয়। এইভাবে ‘অ্যাডোনিস গার্ডেন’ ধারণা ধর্ম-সংস্কৃতির অঙ্গ হিসাবে আমাদের উদ্যান রচনা করতে শেখায়।

কবি কঙ্কণ চণ্ডীতে নিদয়ার সাধভক্ষণ অংশে নানান শাক রান্নার কথা আছে —
“আমার সাধের সীমা
হেলাঞ্চি কলমী গিমা
বোয়ালী কুটিয়া কর পাক।
ঘন কাটি খর জ্বালে
সাঁতলিবে কটূ তেলে
দিবে তাতে পলতার শাক।।
পুঁই-ডগা মুখী-কচু
তাহে ফুলবড়ি কিছু
আর দিবে মরিচের ঝাল।।”

এখানে হেলাঞ্চি বা হিঞ্চে শাক হল Enhydra fluctuans, Family : Asteraceae; কলমী Ipomea aquatica, Family: Convolvulaceae; গিমা Mollugo cerviana, Family: Aizozaceae; পুঁই Basella alba, Family: Basellaceae; কচু Colocasia esculenta, Family: Araceae; পলতা বা পটল শাক Trichosanthes dioica, Family: Curcurbitaceae.

কবি কঙ্কণ চণ্ডীতে ‘নিদয়ার মনের কথা’ অংশে রয়েছে —
“বাথুয়া ঠনঠন তেলের পাক
ডগি ডগি লাউ ছোলার শাক।।”
এখানে বেতো বা বাথুয়া Chenopodium album, Family: Chenopodiaceae; লাউ শাক Lagenaria siceraria, Family: Curcurbitaceae; ছোলার শাক Cicer arietinum, Family: Fabaceae. 

ভূত চতুর্দশীতে (ভূত তাড়াতে) যে চৌদ্দ শাক আমরা খাই তার মধ্যে আছে ওল, কেঁউ, বেতো বা বাথুয়া, কালকাসুন্দে, সরিষা, নিম, জয়ন্তী, শালিঞ্চ বা শাঞ্চে, গুড়ুচি বা গুলঞ্চ, পটুক বা পটল বা পলতা পাতা, শেলূকা Cordia dichotoma, হিলমোচিকা বা হিঞ্চে, ভন্টাকী বা ঘেঁটু বা ভাট এবং সুনিষণ্নক বা সুষুনি।

চৌদ্দ শাক হচ্ছে:
ওলং কেমূকবাস্তুকং সর্ষপং কালঞ্চ নিম্বং জয়াং শালঞ্চীং হিলমোচিকাঞ্চ পটুকং শৌলফং গুড়ূচীন্ত থা। ভণ্টাকীং শুনিষণ্ণকং শিবদিনে খাদন্তি যে মানবাঃ প্রেতত্বং ন চ যান্তি কার্তিকদিনে কৃষ্ণে চ ভূতে তিথৌ।। 

(ওল, কেঁউ, বেতো, সর্ষে, কালকাসন্দি, নিম, জয়ন্তী, শালঞ্চী, হিঞ্চা, পটলপত্র (পলতা), শুলফা, গুড়িচী (গুলঞ্চ), ভণ্টাকী (ঘেঁটু), শুষনি) [সূত্র: রঘুনন্দনের তিথিতত্ত্ব]

মানভূম অঞ্চলে জীহুড় দিনে (আশ্বিন সংক্রান্তি) ২১ রকমের শাক রান্না করে খাওয়ার বিধি আছে। এই শাকগুলির নাম — ওল, কেঁউ, বেতো, সরিষা, কালকাসুন্দা, নিম, জয়ন্তী, শাঞ্চে, হিলঞ্চ, পলতা, শোলফা, গুলঞ্চ, ভাঁট, সুষনি, কলমি, কুদ্রুং, কুলেখাড়া, থানকুনি, ব্রাহ্মী, বাসক এবং কালমেঘ। 

বাংলার কুমারী মেয়েরা কার্তিক মাস জুড়ে নরকভয় নিবারণের জন্য যমপুকুর ব্রত উৎযাপন করতো। বাড়ির উঠোনে চৌকো পুকুর কেটে তার পাশে লাগাতো কলমি, শুষনি, হিংচে, কচু, হলুদ। পুতুল বসতো পুকুরের পশ্চিম পাড়ে — কাক, বক, হাঙর, কুমির আর কচ্ছপ। পুকুরে জল ঢেলে বলা হত ছড়া
“শুষনি-কলমি ল-ল করে
রাজার বেটা পক্ষী মারে…
কালো কচু, সাদা কচু ল-ল করে,
রাজার বেটা পক্ষী মারে।”
এই ব্রতের মাধ্যমে কুমারীদের শাক-সবজির বাগান তৈরিতে উৎসাহ যোগাতো। শাক নিয়ে নানান আচার, লোকবিশ্বাস, প্রবাদ, ধাঁধা, লোককথার মধ্যে বাংলার একটি বিশেষ সংস্কৃতি ফুটে উঠেছে। তা যে শাকের ভেষজ গুণের জন্যই বুঝতে বাকী থাকে না। এবার করোনা পরিস্থিতিতে চৌদ্দ শাকের গুরুত্ব যে বহুগুণে বেড়ে যাবে, তা শাকের বাজার আর মানুষের আগ্রহ প্রমাণ করে দিচ্ছে। অনেকে নিজের বাড়িতেই ফলিয়েছেন নানান শাক, সোশ্যাল মিডিয়ায় তা শেয়ারও করেছেন অনেকে। চৌদ্দশাক এবার আর রিচ্যুয়াল থাকছে না, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষের রোগ প্রতিরোধের সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাংলার শাক-সংস্কৃতি তো কম পুরোনো নয়! কথায় বলে ‘পুরোনো চাল ভাতে বাড়ে’। ভূতচতুর্দশীতে করোনা নামের নতুন ভূতকে শাকের ঝাড়ফুঁকে নামাতে আপ্রাণ চেষ্টা করবে বাঙালি। শাক ভাতের এ এক ওষধি-কপাল!

৪. শাকসব্জি বিষয়ক প্রবাদ-প্রবচন:
ডাক ও খনার নামে অনেক কৃষি বিষয়ক বচন অখণ্ড বঙ্গপ্রদেশে প্রচলিত ছিল এবং এখনও সেইসব অঞ্চলে প্রচলিত আছে৷ ড. নীহাররঞ্জন রায় (১৯৫০)-র মতে তা প্রাক তুর্কি আমলের প্রবাদ সংগ্রহ, কালে কালে তাদের ভাষা বদলিয়ে গেছে। কেউ কেউ বলেন তা খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যে রচিত। তবে কিংবদন্তি অনুসারে খনার বচনের রচয়িতা বাঙালি নারী জ্যোতিষী প্রাচীন ভারতের সবচেয়ে বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ বরাহ-মিহিরের সমসাময়িক। এই বচনগুলিতে ধানসহ নানান মাঠের ফসল ও উদ্যান ফসল যেমন শাকসব্জি ও ফল সম্পর্কে বেশ কিছু প্রবাদ পাওয়া যাওয়ায়, অনুমান করা যায় বঙ্গদেশে সেই সময় থেকেই মানুষ খাদ্য-নিরাপত্তার পাশাপাশি পুষ্টি-নিরাপত্তার বিষয়েও সচেতন ছিল। খনার বচনে শাকসব্জি হিসাবে শশা, পটল, বেগুন, মূলা, পুঁই, ওল, কচু, লাউ এবং কুমড়োর সন্ধান পাওয়া গেছে। ফল ও আবাদি ফসলের মধ্যে আম, কলা, কাঁঠাল, নারকেল, তাল, খেজুর, তেঁতুল, সুপারি এবং মশলাপাতির মধ্যে আদা, হলুদ ও মরিচের উল্লেখ আছে৷ প্রস্তুত আলোচনায় কয়েকটি সংশ্লিষ্ট বচনের উল্লেখ করা যেতে পারে।
১. ছাইয়ে লাউ, উঠানে ঝাল/ কর বাপু চাষার ছাওয়াল।
২. মূলার ভূঁই তুলা/ কুশরের ভূঁই ধূলা (কুশর মানে আখ)।
৩. ষোল চাষে মূলা/ তার অর্ধেক তুলা/ তার অর্ধেক ধান/ বিনা চাষে পান।
৪. নদীর ধারে পুতলে কচু/ কচু হয় তিন হাত উঁচু।
৫. পটল বুনলে ফাগুনে/ ফল বাড়ে দ্বিগুণে।
৬. শোনরে বাপু চাষার বেটা/ মাটির মধ্যে বেলে যেটা/ তাতে যদি বুনিস পটল/ তাতেই তোর আশা সফল।
৭. খনা বলে শুন শুন/ শরতের শেষে মূলা বুন।
৮. আখ, আদা, পুঁই/ এ তিন চৈতে রুই।
৯. ফাগুনে না রুলে ওল/ শেষে হয় গণ্ডগোল।
১০. আইল অন্তর শশা/ যার যেমন দশা।
১১. বলে গেছে বরাহের পো/ দশটি মাসে বেগুন রো/ চৈত্র-বৈশাখ দিবি বাদ/ ইথে নাই কোনো বিবাদ/ ধরলে পোকা দিবি ছাই/ এর ভালো উপায় নাই/ খরা ভূঁয়ে ঢালবি জল/ সকল মাসেই পাবি ফল।
১২. বাঁশ বনে বুনলে আলু/ আলু গাছ হয় বেড়ালু।
১৩. লাউয়ের বল মাছের জল/ ধেনো মাটিতে ঝাল প্রবল।
১৪. নারকেল বারো, সুপারি আট/ এর ঘন তখনি কাট।
১৫. যত কুয়া আমের ক্ষয়,/ তাল তেঁতুলের কিবা হয়।
১৬. যদি না হয় আগনে বৃষ্টি/ তবে না হয় কাঁঠালের সৃষ্টি।
১৭. আমে বান, তেঁতুলে ধান।
১৮. ডাক দিয়ে বলে খনা/ আষাঢ় শ্রাবণে কলা পুত না।
১৯. আট হাত অন্তর এক জাত খাই/ কলা পোঁতো গো চাষা ভাই।
২০. শোনরে বাপু চাষার পো/ সুপারি-বাগে মান্দার থো।/ মান্দার পাতা পড়লে গোড়ে /ফল বাড়বে ঝটপট করে।
২১. খনা ডাক দিয়ে বলে/ চিটা দিলে নারিকেল মূলে/ গাছ হয় তাজা মোটা,/ শীঘ্র শীঘ্র বাঁধে গুটি।
২২. সকল গাছ কাটি কুটি/ কাঁঠাল গাছে দিই মাটি।
২৩. আগে পুঁতে কলা বাগ বাগিচা ফলা/ শোন রে বলি চাষার পো,/ ক্রমে নারিকেল পরে গো।
২৪. বারো বছরে ধরে তাল/ যদি না লাগে গরুর লাল।

খনার এই বচনগুলি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, কিছু সুনির্দিষ্ট উদ্যানপালন বিষয়ক তথ্য
পাওয়া যাচ্ছে। যেমন ফসল চাষে জমি তৈরির পরামর্শ বা আদর্শ জমি কেমন হবে৷ দেখা যাচ্ছে পটলের জন্য বেলেমাটি, মূলার জন্য তূলা ভূঁই এবং ষোলো বা বহু চাষ, আখের জন্য ধূলা ভূঁই, কচুচাষে নদী তীরস্থ পলিমাটি, মানের জন্য নরম ভূঁই। শস্যপঞ্জিতে কলা রোপণের সময় আষাঢ়-শ্রাবণ, মূলার জন্য আশ্বিন মাস, ওলের জন্য ফাল্গুন, পুঁইয়ের বপন কাল চৈত্র, পটল ফাল্গুন এবং হলুদ রোপণের সময় বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ। ফসল রোপণ বিধিতে দূরত্ব কেমন হবে তার পরামর্শ পাওয়া যায়, যেমন — আম ও কাঁঠালের ক্ষেত্রে বিশ হাত, নারকেলের ক্ষেত্রে বারো হাত, সুপারি আট হাত, কলা আট হাত অথবা সাত হাত তিন বিঘত এবং আল অন্তর শশা। খনার বচনে বিভিন্ন ফসলে যে সমস্ত জৈবসারের সুপারিশ করা হয়েছে, তা হল, মান ও কচুর মতো কন্দ ফসলে ছাই, লাউগাছে মাছের জল বা ফিস-মিল, ওলগাছে কুটিকাটার মতো ঘর গৃহস্থালির জৈববর্জ্য, নারকেল মূলে ধানের চিটে, সুপারি বাগানে সবুজপাতা-সার হিসাবে মান্দার এবং গোবর-সার, নারকেল গাছে পটাসিয়ামের পরিপূরক হিসাবে লুনেমাটি, এবং নানান ফসলে গোঁধলা।

গ্রাম বাংলার প্রতিটি বাস্তুতেই পুষ্টি বাগান হোক। গ্রাম-বাংলার সমৃদ্ধির সঙ্গে আহার ও পুষ্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোগ থাকা উচিত। সমৃদ্ধি তখনই বলবো যখন গ্রামবাসী রোজ দুবেলা পুষ্টিকর খাবার পাতে পাবেন।

অনেক বাস্তুতেই আলগোছে এক-আধ কাঠা জমি পড়ে থাকে, কখনও তারও বেশি। আবাস-সন্নিহিত জমিটুকুকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে ব্যবহার করে কিচেন গার্ডেন বা ঘরোয়া সবজি বাগান গড়ে তোলা যায়। কখনও তার লাগোয়া দু’টো একটা ছোটো মাপের ফলগাছ লাগালে, তা এক পরিপূর্ণ পুষ্টি বাগান বা নিউট্রিশনাল গার্ডেন হয়ে দাঁড়াবে।
সবজি বাগানে এগারো-বারোটি ছোটো প্লট বানিয়ে ফসল চক্র অনুসরণ করে সারাবছর ধরে সবজি লাগালে বাড়ির চাহিদা মিটবে। এই বাগানের বেড়াতে উপযোগী লতানে সবজি তুলে দেওয়া যায়। বাগানে যদি পুরোপুরি বা আংশিকভাবে জৈব পদ্ধতি অনুসরণ করা যায়, তবে বাংলার মানুষ কৃষির রাসায়নিক দূষণ থেকে রেহাই পাবেন।কারণ সবজি আর ফলেই সবচাইতে বেশি সার, কীটনাশক ও ছত্রাকনাশক ব্যবহার করা হয়। শহরতলীতেও যাদের গৃহ-সন্নিহিত এক চিলতে জমি আছে; অথচ তাতে ভালো আলো-বাতাস খেলে, তারাও রচনা করতে পারবেন পুষ্টি বাগান। বাগানের বর্জ্য, গৃহের তরকারির খোসা, মাছের কাঁটা, মাংসের হাড় ইত্যাদি ব্যবহার করে বাগানেই বানিয়ে নেওয়া যায় কম্পোস্ট সারের ভাণ্ড। গ্রামের মানুষ গোবর ও গোমূত্র ব্যবহার করে গোবর সার, তরল জৈবসার এবং কেঁচো ব্যবহার করে ভার্মি-কম্পোস্ট বা কেঁচোসার বানিয়ে এই পুষ্টিবাগানে প্রয়োগ করতে পারেন।

অপুষ্টির অভিশাপ থেকে গ্রাম-বাংলাকে শাপমুক্ত করতে ছড়িয়ে দিন পুষ্টিবাগানের এই প্রস্তুত পাঠ। সবজি উৎপাদনে ভারত দ্বিতীয় স্থানে থাকলেও এখনো দেশের সমস্ত মানুষ আজও দৈনিক ন্যুনতম মাত্রায় সবজি তাদের ব্যঞ্জনে পায় না। অথচ সামান্য সচেতনতা ও প্রচেষ্টা থাকলে এতটা অপুষ্টির পরিমণ্ডল থাকা উচিত নয়। পুষ্টিবাগানের তথ্য ও তার নিবিড় পাঠ বাংলার মানুষকে বাস্তু-বাগান রচনায় মনোনিবেশ করতে সাহায্য করবে। বাড়ির পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রী ও গৃহকর্ত্রীরাই মিলেমিশে রচনা করবেন এই বাগান।

৫. পুষ্টি বাগানের প্লট পরিকল্পনা ও ফসল চক্র:
প্লট -১: জলদি ফুলকপি এবং সাথি ফসল রূপে পালং শাক (আষাঢ় থেকে আশ্বিন), আলু (কার্তিক থেকে ফাল্গুন), নটেশাক (চৈত্র থেকে আষাঢ়)
প্লট -২ : নাবি বাঁধাকপি (আশ্বিন থেকে মাঘ), ভিণ্ডি (ফাল্গুন থেকে আষাঢ়), মুলো (আষাঢ় থেকে ভাদ্র)
প্লট -৩: ফুলকপির সঙ্গে সাথি ফসল ওলকপি (আশ্বিন থেকে মাঘ), গ্রীষ্মকালীন বেগুন সঙ্গে সাথি ফসল নটে শাক (ফাল্গুন থেকে ভাদ্র)
প্লট -৪: জলদি বাঁধাকপি সঙ্গে সাথি ফসল পালং (ভাদ্র থেকে অঘ্রাণ), মটরশুঁটি (পৌষ থেকে বৈশাখ), বরবটি (জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ)
প্লট – ৫: জলদি ফুলকপি সঙ্গে সাথি ফসল লালশাক (শ্রাবণ থেকে কার্তিক), পিঁয়াজ (অঘ্রাণ থেকে জ্যৈষ্ঠ), বরবটি (জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ)
প্লট – ৬: ভিণ্ডি (শ্রাবণ থেকে অঘ্রাণ), আলু (অঘ্রাণ থেকে ফাল্গুন), বরবটি (চৈত্র থেকে আষাঢ়)
প্লট – ৭: টমেটো (কার্তিক থেকে ফাল্গুন), ভিণ্ডি (বৈশাখ থেকে ভাদ্র), মুলো (ভাদ্র থেকে কার্তিক)
প্লট – ৮: বরবটি (ভাদ্র থেকে কার্তিক), পেঁয়াজ (অঘ্রাণ থেকে বৈশাখ), লালশাক (জ্যৈষ্ঠ থেকে শ্রাবণ)
প্লট – ৯: লালশাক (কার্তিক থেকে অঘ্রাণ), টমোটো (অঘ্রাণ থেকে বৈশাখ), উচ্ছে (বৈশাখ থেকে আশ্বিন)
প্লট – ১০: বেগুনের সঙ্গে সাথি ফসল পালং (আষাঢ় থেকে ফাল্গুন), নটে শাক ( চৈত্র থেকে জ্যৈষ্ঠ)
প্লট -১১: পেঁয়াজ (কার্তিক থেকে বৈশাখ), ভিণ্ডি (জ্যৈষ্ঠ থেকে আশ্বিন)
প্লট -১২: অনুচ্চ ও অধিক ফলনশীল ফল ও অন্যান্য দীর্ঘজীবী গাছ যেমন পাতিলেবু, মঞ্জিরা হাইব্রিড আম অথবা বারোমাসি/দোফলা কাটিমন, সুর বা চিনিয়া জাত, ড্রাগন ফল; গ্র্যাণ্ড নাইনির মতো বেঁটে জাতের কলা, বকফুল, করমচা, এল-৪৯ বা খাজা জাতের পেয়ারা, তলায় আনারসের মেঝে বা আদা-হলুদের ভূখণ্ড।

[ তথ্যসূত্র : বিসিকেভি এবং ড. কল্যাণ চক্রবর্তী ও ড. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায়ের কৃষি সংস্কৃতি বিষয়ক নানান প্রবন্ধ।]

দেবাঞ্জন ভট্টাচার্য এবং ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

[ছবি: রান্না বাগান বা কিচেন গার্ডেন। উত্তর ২৪ পরগণার বারাকপুর, নীলগঞ্জে অবস্থিত কেন্দ্রীয় পাট ও পাটজাত অন্যান্য তন্তু ফসল গবেষণা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে নীলগঞ্জে একটি কৃষিবিজ্ঞান কেন্দ্র রয়েছে। তাতে উদ্যানবিদ হিসাবে পরামর্শ দিয়েছেন ড. কল্যাণ চক্রবর্তী।]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.