পুরুষদের কাঁধে ব্যাগপত্র। মহিলাদের কাঁখে পুটলি। কারও কারও এক হাতের আঙুল ছুঁয়ে আছে কোনও শিশু। অনেকের পিছু পিছু গবাদি গরু-ছাগল। কয়েক দিন পর তাঁরা সকলেই বাড়ি ফিরছেন। চোখেমুখে ভয়, উদ্বেগ! আবার বাড়ি ফিরতে পারার স্বস্তিও রয়েছে মুখের রেখায়। বাড়ির পথে হাঁটতে হাঁটতে তাঁদেরই এক জন গিন্নিকে আশ্বাস দেওয়ার সুরে বললেন, “দেখো, এ বার সব ঠিক হয়ে যাবে!” নিজেকেও বললেন কি? তবে হ্যাঁ, পুলিশ-প্রশাসনের আশ্বাসে এঁরা সকলে আশ্বস্ত। পুলিশের কাছে পাওয়া সেই আশ্বাসবাণী পরিবারের অন্যদের দিচ্ছেন বাড়ির কর্তারা। মঙ্গলবার সেই আশ্বাস, ভরসা সম্বল করে ওয়াকফ-অশান্ত মুর্শিদাবাদে নিজেদের বাড়িতে ফিরেছে এমন ৩০টি পরিবার।
প্রশাসন সূত্রে খবর, মুর্শিদাবাদের হিংসাকবলিত এলাকায় ঘরছাড়ার সংখ্যা আনুমানিক ৫০০। ইতিমধ্যে প্রায় ২০০ জন বাড়ি ফিরেছেন। বাকিদেরও শীঘ্রই বাড়ি ফেরানোর ব্যবস্থা করা হবে। যদিও স্থানীয়দের একাংশের দাবি, ঘরছাড়াদের সংখ্যাটা হাজার ছাড়িয়েছে। এক বৃদ্ধের কথায়, ‘‘শুধু তো মালদহ নয়, হিংসা-গন্ডগোলে ভয় পেয়ে অনেক মানুষ ঝাড়খণ্ডেও চলে গিয়েছে। এখন পুলিশ, বিএসএফের জন্য আমরা সাহস পাচ্ছি। আশা করছি, তাড়াতাড়ি সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।’’
গত ৪৮ ঘণ্টায় মুর্শিদাবাদের উপদ্রুত এলাকায় পুলিশ, বিএসএফের টহল, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে তাদের নিয়মিত কথাবার্তা হিংসাকবলিতদের মনে আস্থা যুগিয়েছে। অনেকের বাড়িতে লুটপাটের অভিযোগ। কারও গয়না-টাকা গিয়েছে। কারও চুরি হয়ে গিয়েছে গবাদি পশু। তবে বাড়ি ফিরতে পেরে সকলের মুখে স্বস্তির হাসি। অন্য দিকে, অশান্তি পাকানোয় অভিযুক্তদের ধরপাকড়ও জারি রয়েছে। পুলিশ বলেছে, অপরাধীদের ধরতে প্রয়োজনে পাতাল খুঁড়বে তারা। বাস্তবে মাটি খুঁড়তে হয়নি। তবে সামশেরগঞ্জে জোড়া খুনে দুই অভিযুক্তকে মঙ্গলবারই বীরভূম এবং বাংলাদেশ সীমান্ত লাগোয়া একটি জায়গা থেকে পাকড়াও করেছে পুলিশ। এ হেন পদক্ষেপ সাধারণ মানুষের মনোবল যথেষ্ট বাড়াচ্ছে। পুলিশের প্রতি ভরসাও বাড়ছে। আবার ঘরে ফেরার পর স্থানীয় বাসিন্দাদের যাতে নতুন করে অপ্রীতিকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে না হয়, সে ব্যাপারে আপসহীন অবস্থান দেখা যাচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর। ঘরে ফেরা পরিবারগুলির নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে প্রত্যেকের কাছে পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে কেন্দ্রীয় বাহিনীর দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকদের ফোন নম্বর। কোনও রকমের গন্ডগোলের খবর পেলে সেখানে দ্রুত পৌঁছে যাচ্ছে বাহিনী। হিংসায় যুক্ত থাকা হোক বা হুমকি দেওয়া, কাউকেই রেয়াত করা হচ্ছে না। পুলিশের একটি সূত্রে খবর, মঙ্গলবার এমন ২০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সমাজমাধ্যমেও নজরদারি চালাচ্ছে পুলিশ। গুজব ছড়ানো এবং উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে হাজারের বেশি সমাজমাধ্যম অ্যাকাউন্ট ‘ব্লক’ করে দিয়েছে তারা।
অবশেষে ঘরেফেরা
অশান্তির জেরে জঙ্গিপুর পুলিশ জেলার ধুলিয়ান পুর এলাকায় ঘরছাড়াদের সংখ্যা ছিল সবচেয়ে বেশি। মালদহের বৈষ্ণবনগর এবং জেলা সংলগ্ন প্রতিবেশী রাজ্য ঝাড়খণ্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন তাঁরা। অস্থায়ী শিবিরগুলিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে পৌঁছে দেওয়া হয় ত্রাণ। এখন হিংসা রুখে ভয়ের বাতাবরণ কাটিয়ে ঘরছাড়াদের ঘরে ফেরানোই প্রাথমিক লক্ষ্য প্রশাসনের। সেই লক্ষ্যে যৌথ ভাবে কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ ও কেন্দ্রীয় বাহিনী। প্রশাসনের একটি সূত্রে খবর, রবিবার ১৯ জনকে বাড়ি ফিরিয়েছিল পুলিশ। সোমবার সংখ্যাটা দাঁড়ায় ৪৯-এ। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত, মঙ্গলবার আরও ৭২ জন ঘরে ফিরছেন। বিভিন্ন ত্রাণশিবির এবং আত্মীয়দের বাড়িতে আশ্রয় নেওয়া ঘরছাড়াদের দ্রুত ঘরে ফিরিয়ে আনার কাজ করছে প্রশাসন। মুর্শিদাবাদের অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) দীননারায়ণ ঘোষ বলেন, ‘‘আমরা সকলকে আশ্বস্ত করছি। আতঙ্কের কিছু নেই। জেলা প্রশাসন সকলের পাশে আছে। আমরা ‘রিলিফ কিট’ তুলে দিচ্ছি। দু’টি কমিউনিটি কিচেনও চলছে এলাকায়। ঘরছাড়াদের কাছে আবেদন করব, দ্রুত বাড়ি ফিরে আসুন। প্রশাসন আপনাদের পাশে আছে।’’ একই কথা বলছেন জঙ্গিপুর পুলিশ জেলার সুপার আনন্দ রায়। তিনি বলেন, ‘‘এলাকায় সম্পূর্ণ শান্তি ফিরে এসেছে। নতুন করে অশান্তির কোনও খবর নেই। তাই নিজের বাড়িতে না-ফেরারও কোনও কারণ নেই। আজও (মঙ্গলবার) অনেকে ঘরে ফিরেছেন।’’
নববর্ষে খুলল মিষ্টির দোকান
ছন্দে ফিরেছে ধুলিয়ান। গত কয়েক দিনের অশান্তি কাটিয়ে বাংলা বর্ষের প্রথম দিন মিষ্টির দোকান খুলতে দেখা গেল ওই এলাকায়। সামশেরগঞ্জ এবং ধুলিয়ানে বিড়ি শ্রমিকদের মহল্লাতেও কাজ শুরু হয়েছে। গত কয়েক দিন ধরে বন্ধ থাকা বিড়ি কারখানাগুলিও খুলতে শুরু করেছে। রাজ্য পুলিশ এবং কেন্দ্রীয় বাহিনীর যৌথ তৎপরতায় ফের স্বাভাবিক ছন্দে ফিরতে শুরু করেছে এলাকা। পুলিশের উদ্যোগে শান্তি বৈঠকগুলিতে কোথাও উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় থানার ওসিরা, আবার কোথাও থেকেছেন রাজ্য পুলিশের ‘অফিসার অন স্পেশ্যাল ডিউটি’ (ওএসডি)-রা। নতুন করে কোনও অপ্রীতিকর পরিস্থিতি তৈরি হওয়া আটকাতে বিভিন্ন সম্প্রদায় ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে বুথ স্তরে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে শান্তি কমিটি। কোনও রকম অশান্তি বা গুজবের খবর মিললে তা পুলিশের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছে কমিটির উপরে। কমিটির মাথায় বসানো হয়েছে, স্থানীয় স্তরে গ্রহণযোগ্য কোনও ব্যক্তিকে। রবিবার থেকেই এই ধরনের শান্তি বৈঠক শুরু হয়েছিল। সোমবার তা আরও ব্যাপক পরিসরে হয়েছে।
গুজবের বিরুদ্ধে লড়াই
গুজবই শত্রু। অশান্তি দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়তে এর মতো উপাদান আর নেই। খবরের নামে নানা মনগড়া কথা লিখে পোস্ট, গুজব ছড়িয়ে প্ররোচনা আটকাতে সমাজমাধ্যমের উপরে কড়া নজরদারি চালাচ্ছে পুলিশ। রাজ্য পুলিশের এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকারের কথায়, ‘‘ফেসবুক, এক্স হ্যান্ডল, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামের মতো সমাজমাধ্যম ব্যবহার করে বেশ কিছু ব্যক্তি সামশেরগঞ্জ এবং সুতির ঘটনায় প্ররোচনামূলক বক্তব্য ছড়িয়েছেন। ইতিমধ্যে আমাদের তরফ থেকে এমন ১০৯৩টি অ্যাকাউন্ট চিহ্নিত করে সেগুলো ‘ব্লক’ করা হয়েছে।’’ তিনি জানিয়েছেন, উস্কানি এবং প্ররোচনা দেওয়ার ক্ষেত্রে ‘জ়িরো টলারেন্স’ নীতি নিয়েছে রাজ্য পুলিশ। সেই সঙ্গে এলাকায় এলাকায় শান্তি কমিটি তৈরি করে আস্থা ফেরানোর কাজ চালানো হচ্ছে। বিএসএফের দক্ষিণবঙ্গ ফ্রন্টিয়ারের ডিআইজি নীলোৎপল পাণ্ডে বলেন, ‘‘আমরা ধৈর্যশীল। কিন্তু কোনও রকম প্ররোচনা বরদাস্ত করা হবে না। আমরা কোনও বিশেষ সম্প্রদায়ের জন্য কাজ করছি না। আমরা সকলের জন্য। উপদ্রুত এলাকায় শান্তি ফেরানোই আমাদের প্রধান লক্ষ্য।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘ঘরছাড়াদের ১০০ শতাংশকে বাড়িতে ফেরানোর লক্ষ্যে কাজ করছে বাহিনী।’’
দুষ্কৃতী কারা?
বহরমপুরের প্রাক্তন সাংসদ তথা কংগ্রেস নেতা অধীর চৌধুরীর অভিযোগ ভিন্ন। তাঁর ইঙ্গিত, সর্ষের মধ্যেই রয়েছে ভূত। মঙ্গলবার সামশেরগঞ্জে অধীর বলেন, ‘‘ধুলিয়ানে দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে আমরা শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার লড়াই করেছি। সেখানে আজ শান্তির জন্য ছুটে আসতে হচ্ছে! ১২-১৪ বছরের বাচ্চা গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি! কাদের উস্কানিতে এ সব হল?’’ প্রশ্ন থেকে অভিযোগে সরে গিয়ে অধীর বলেন, ‘‘অশান্তির সময় দীর্ঘ চার ঘণ্টা পুলিশকে পাওয়া যায়নি। তখন তারা কোথায় ছিল? গ্রামবাসীরা তো জানাচ্ছেন, বিএসএফের পোশাক পরে অনেক দুষ্কৃতীরা এসেছিল। এদের কেন চিহ্নিত করা হচ্ছে না?’’
মুর্শিদাবাদে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন
সংশোধিত ওয়াকফ আইন বিরোধী আন্দোলন ঘিরে হিংসা এবং মৃত্যুর ঘটনা খতিয়ে দেখতে পাঠানো হচ্ছে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রতিনিধি দল। গত শুক্রবারের হিংসাপর্বের সময় পুলিশ নিষ্ক্রিয় ছিল বলে যে অভিযোগ উঠেছে, কমিশনের প্রতিনিধিরা সে বিষয়েও অনুসন্ধান করবেন। জেলা প্রশাসন সূত্রের খবর, চলতি সপ্তাহের মধ্যে প্রতিনিধিদল যেতে পারে মুর্শিদাবাদ। ‘প্রকাশ কলিঙ্গ রাইটস্ ফোরাম’ নামে ওড়িশার একটি মানবাধিকার সংগঠনের অভিযোগের ভিত্তিতে কমিশনের প্রতিনিধি দল যাচ্ছে বলে খবর।
অতঃপর ওয়াকফ
বুধবার ওয়াকফ সংশোধিত আইন নিয়ে শুনানি হবে সুপ্রিম কোর্টে। প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বে তিন বিচারপতির বেঞ্চ মামলাটি শুনবে। প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খন্নার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে থাকবেন বিচারপতি সঞ্জয় কুমার এবং বিচারপতি কেভি বিশ্বনাথন। অন্য দিকে, ওয়াকফ সংশোধনী আইন নিয়ে রাজ্যের কিছু অংশে এই অস্থিরতার আবহে বুধবার নেতাজি ইন্ডোর স্টেডিয়ামে রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের নিয়ে সম্মেলন করতে চলেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যদিও ওই বৈঠকের পরিকল্পনা সংঘর্ষের ঘটনা ঘটার আগেই করা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই সম্মেলন আরও ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ হয়ে উঠেছে। শাসক শিবিরের একাংশ তো বটেই, প্রসাসনিক এবং রাজনৈতিক মহলও মনে করছে, ওই সম্মেলন থেকে মুখ্যমন্ত্রী সংখ্যালঘু সমাজের উদ্দেশে সামগ্রিক ভাবে ‘গুরুত্বপূর্ণ বার্তা’ দিতে পারেন। সংখ্যালঘু সংগঠনগুলির অভিযোগ, নতুন ওয়াকফ সংশোধনী আইনে তাঁদের ধর্মীয় অধিকার ও ওয়াকফ সম্পত্তির উপর সরকারি ‘হস্তক্ষেপ’ করা হচ্ছে। তাঁদের বক্তব্য, এই আইন সংবিধানসম্মত মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ করছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা অবশ্য ইতিমধ্যেই ঘোষণা করেছেন যে, ওই সংশোধিত আইন পশ্চিমবঙ্গে কার্যকর হবে না। তবে বিভিন্ন এলাকায় এখনও বিক্ষোভ চলছে, অনেক পরিবার ভিটেছাড়া, যা প্রশাসনের জন্য উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর ওই সম্মেলনে উপস্থিত থাকবেন মন্ত্রী ও কলকাতার মেয়র ফিরহাদ হাকিম, নাখোদা মসজিদের ইমাম তথা সভার আহ্বায়ক মওলানা শফিক কাসেমি, মওলানা বাকি বিল্লাহ-সহ রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের ইমাম, মোয়াজ্জিম এবং মুসলিম বুদ্ধিজীবীরা। মূলত এই বৈঠকের মাধ্যমে সংখ্যালঘু সমাজের আশঙ্কা দূর করার চেষ্টা করবে রাজ্য সরকার।