আবার খবরের শিরোনামে অরুন্ধতী সুজান রয় এবং যথারীতি বিতর্কিত মন্তব্য করে। অরুন্ধতী সুজানের মত বাম-ঘেঁষা ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ দের জন্ম হয় বিতর্কিত মন্তব্য বা আচরণ প্রদর্শনের মাধ্যমে যে মন্তব্য বা আচরণ কখনও কখনও ভব্যতার মাত্রা অতিক্রম করে যায়। ‘জন্ম হয়’ না বলে, বলা ভালো, এঁদের ‘জন্ম দেওয়া হয়’। বস্তুতঃ, বামপন্থী ‘অ্যাক্টিভিস্ট’দের যে সুপরিকল্পিতভাবে তৈরি করে ইমপ্ল্যান্ট করা হয় আমাদের পলিটিক্যাল ইকোসিস্টেমে, তা অনুমান করা আদৌ কঠিন নয়; কারণ এইসব ‘অ্যাক্টিভিস্ট’ দের উত্থান ও কার্যবিধির মধ্যে একটা চেনা ছক বার বার দেখতে পাওয়া যায়। কোনো না কোনো তাৎপর্যপূর্ণ একটি ইভেন্টকে উপলক্ষ্য করে উত্থান ঘটে এঁদের। এইসব ‘অ্যাক্টিভিস্ট’দের তৈরি করে এক বিরাট গ্লোবাল বিভেদকামী লবি, যাদের উদ্দেশ্য হল—“ভারত তেরে টুকড়ে হোঙ্গে, ইনশাআল্লাহ, ইনশাআল্লাহ”। এইসব অ্যাক্টিভিস্টরা প্রায়শঃই সেনসিটিভ ইস্যুতে আনতাবড়ি মন্তব্য করে পাবলিক মাইণ্ডকে উৎক্ষিপ্ত ও বেপথু করার প্রয়াস করে থাকেন।
অরুন্ধতী সুজান রয়ের কথায় যাওয়ার আগে সম্প্রতি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন মঞ্চে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রথম স্থানাধিকারী ছাত্রী ‘দেবস্মিতা’র arrogant rise এর দিকেও দৃকপাত করা প্রয়োজন। দেবস্মিতা’র উত্থানের মধ্যেও সেই চেনা ছক আবার দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। দেশের একটি প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় যাদবপুরের সমাবর্তন মঞ্চে ডিগ্রি নিতে উঠে দেশের একটি আইনের প্রতিলিপি ছিঁড়ে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ বলার কোন্ তাৎপর্য দেবস্মিতা’র শিক্ষাজীবনে থাকতে পারে এবং কেন তিনি তা করলেন, তা বোঝা গেল পরদিন পশ্চিমবঙ্গের শাসকপদে তৈলমর্দনকারী সমস্ত সংবাদপত্রগুলির হেডলাইন দেখে। বোঝা গেল, ঐ হেডলাইনগুলি ক্রিয়েট করার জন্যই বোধ করি ‘বোড়ে’ বানানো হল দেবস্মিতাকে, আর তথাকথিত ‘মেধাবী’ দেবস্মিতা তাতে রাজীও হয়ে গেলেন। যদিও এই চিত্রনাট্যে অভিনয় করতে রাজী হওয়ার জন্য বিনিময়মূল্য কি ধার্য করেছিলেন দেবস্মিতা, জনসাধারণ তা জানেন না। বামঘেঁষা অ্যাক্টিভিস্টদের একটি স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হল, মেধা ও মূল্যবোধের এই বিসদৃশরকম ব্যবধান তাদের মধ্যে থাকে।
অরুন্ধতী সুজানও গত সপ্তাহের শুরুর দিকেই ভারতবর্ষের মানুষকে পরামর্শ দিয়ে বসেছেন যে ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্টার তৈরির কাজ করতে সরকারি কর্মচারীরা যখন মানুষের বাড়িতে বাড়িতে যাবেন, তখন মানুষ যেন তাঁদেরকে নিজেদের সম্বন্ধে সঠিক তথ্য না দেন। নাম জিজ্ঞেস করলে মানুষ যেন বলেন তাঁর নাম ‘রঙ্গা’ কিংবা ‘বিল্লা’ ইত্যাদি এবং ঠিকানা রেস কোর্স। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, রঙ্গা-বিল্লা হল সত্তরের দশকে ভারতবর্ষের দুই কুখ্যাত অপরাধী। রঙ্গা—কুলজিৎ সিং আর বিল্লা—জসবীর সিং। ১৯৭৮ এর ২৬শে আগস্ট ইণ্ডিয়ান নেভির অ্যাডমিরাল মদন মোহন চোপড়ার পুত্র সঞ্জয় চোপড়া ও কন্যা গীতা চোপড়া দিল্লিতে আকাশবাণী ভবন যাওয়ার পথে রাস্তায় অপেক্ষা করছিলেন বাসের জন্য। এমনসময় একটি গাড়ি তাঁদের লিফ্ট দেয় এবং অপহরণ করে নিয়ে যায় অন্যত্র, গীতাকে গ্যাংরেপ করে, সঞ্জয় বাধা দিতে গেলে সঞ্জয়কে নৃশংসভাবে তলোয়ারের কোপ মারে এবং এহেন চূড়ান্ত অত্যাচার শেষে দুই ভাইবোনকে হত্যা করে তারা। ২৯শে আগস্ট তাদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ এবং তদন্ত করে জানতে পারে যে মুম্বাই পুলিশের হাত থেকে ফেরার রঙ্গা ও বিল্লা এই জঘন্য অপরাধের কারিগর। ১৯৭৯’র ৭ই এপ্রিল তাদের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন আদালত এবং ১৯৮২’র ৩১শে জানুয়ারী তাদের ফাঁসি হয়।
অরুন্ধতী সুজান ভারতবর্ষের মানুষকে নিজেদেরকে রঙ্গা ও বিল্লার মত ধর্ষক, খুনী ও নৃশংস অপরাধীর নামে আত্মপরিচয় দিতে পরামর্শ দিয়েছেন। ভারতের সাধারণ মানুষ তাঁর পরামর্শমত নিজেদেরকে খুনী, ধর্ষক, ডাকাতের পরিচয়ে পরিচয় দিতে চাইবেন কিনা বা কেন চাইবেন, সে প্রসঙ্গ অন্য, কিন্তু জনগণকে এমনভাবে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করার জন্য, সরকারী কার্যপদ্ধতিতে মিথ্যাচার করার মত একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ করতে জনসাধারণকে উস্কানি দেওয়ার জন্য অরুন্ধতী সুজান রয়ের বিরুদ্ধে কোনো অ্যাকশন এখনও কেন নেওয়া হল না, সে প্রশ্ন উঠছে।
মিথ্যে কথা বলার অধিকার বাক্-স্বাধীনতার মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না, বরং ইণ্ডিয়ান পেনাল কোড অনুযায়ী তা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ। অর্থাৎ বাক্-স্বাধীনতার নামে মিথ্যে বলার অধিকার ভারতের আইন ও সংবিধান কাউকে দেয় নি। কিন্তু NPR এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের নামে অরুন্ধতী সুজান সেই অপরাধটিই করতে উস্কানি দিচ্ছেন মানুষকে। এই উসকানিও যে একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ এবং সেই অপরাধে অরুন্ধতী সুজানকেও যে ‘বুক করা’ যায়, সেই বিষয়টি অনুভব করেই হয়ত নিজের উস্কানিমূলক কথাকে খানিক গিলে নিয়েছেন অরুন্ধতী সুজান। বলেছেন তিনি নাকি NPR এর বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পথ জনগণকে বাতলাচ্ছিলেন। NPR এর মত একটি জনগণনা কার্যক্রম, যেটি প্রতি দশবছরে একবার নিয়মিত হয়ে থাকে, তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের অর্থ কি, এবং কেনই বা সে বিষয়ে মানুষ সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতা করবেন, সেসব প্রশ্নের জবাব অবশ্য সুজান দেন নি।
প্রতিবাদের নামে মানুষকে অপরাধের পথে ঠেলে দেওয়া, ইনকিলাবের নামে ভারতের সংবিধানকে অপমান ও অস্বীকার করতে উস্কানি দেওয়া এবং এইসব আপাত-স্মার্ট কার্যপদ্ধতির দ্বারা দেশের তরুণ প্রজন্মকে বেপথু করে তাদের অনিয়মানুবর্তিতার মন্ত্রণা দেওয়া, তাদের আত্মবিধ্বংসী করে তুলে দেশকে ভিতর থেকে দুর্বল করে দেওয়া—এই সবই অরুন্ধতী সুজান রয়ের মত বামঘেঁষা অ্যাক্টিভিস্টদের কাজ। এদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা অবিলম্বে নেওয়া দরকার।
দেবযানী ভট্টাচার্য