পঞ্চায়েতের দেওয়া ট্রেড লাইসেন্সে বাজি তৈরি! পাথরপ্রতি‌মায় আট মৃত্যুর নেপথ্যে দায় কি প্রশাসনেরও?

বাজি বিপর্যয়ে রাজ্যে আবার প্রাণহানির ঘটনা। বাজি মজুতের সঙ্গে সঙ্গে বাড়িতেই বাজি তৈরির অভিযোগ উঠছে দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমার তৃতীয় ঘেরি অঞ্চলে। সেই সূত্র ধরে জানা যাচ্ছে, কেবলমাত্র পঞ্চায়েত থেকে ইস্যু করা সাধারণ ট্রেড লাইসেন্স ছিল বণিক পরিবারের। সেটি দিয়েই ব্যবসা চলছিল। স্থানীয়দের অভিযোগ, যে বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডে আট জনের মৃত্যু হয়েছে, ওই পরিবারের সঙ্গে প্রভাবশালীদের যোগ রয়েছে। এমনকি, পুলিশের দিকেও আঙুল উঠেছে। যদিও সমস্ত অভিযোগ তদন্তসাপেক্ষ বলে জানিয়েছেন এডিজি (দক্ষিণবঙ্গ) সুপ্রতিম সরকার।

সোমবার রাতে দক্ষিণ ২৪ পরগনার পাথরপ্রতিমার তৃতীয় ঘেরি অঞ্চলে বাজি বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডে একই পরিবারের আট সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। জানা যাচ্ছে, ট্রেড লাইসেন্সটি ছিল বণিক বাড়ির বড় ছেলে চন্দ্রকান্তের স্ত্রী সান্ত্বনা বণিকের নামে। সোমবার রাতে অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয়েছে ২৮ বছরের ওই বধূরও। পুলিশ সূত্রে খবর, বেআইনি ভাবে বাড়িতে বাজি রাখার জন্য বছর তিনেক আগে এক বার গ্রেফতার হন চন্দ্রকান্ত। উদ্ধার হয়েছিল ৬৮.৫ কেজি বাজি। কিন্তু তার পরেও স্থানীয় প্রশাসনের টনক নড়েনি কেন? সোমবার রাতে দুর্ঘটনার পরে সেই প্রশ্ন উঠছে। পুলিশ জানাচ্ছে, এটাও তদন্তসাপেক্ষ। মঙ্গলবার সাংবাদিক বৈঠকে পুলিশকর্তা সুপ্রতিম জানান, বছর দশেক ধরে বণিক পরিবার বাজি ব্যবসা করছে। তবে তাঁদের কাছে লাইসেন্স ছিল কি না, থাকলে তা কী রকম লাইসেন্স, সেটা দেখা হবে।

পাথরপ্রতিমায় ওই বাজি বিস্ফোরণ এবং অগ্নিকাণ্ডে চার শিশু-সহ পরিবারের আট সদস্যের মৃত্যু হয়েছে। মৃত চার শিশুর মধ্যে দু’জনের বয়স এক বছরেরও কম। পুলিশের দাবি, দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিয়েছেন ওই পরিবারের প্রাপ্তবয়স্কেরা। তার মাসুল দিতে হয়েছে তাঁদেরই। যদিও বিস্ফোরক আইনে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের হয়নি।

স্থানীয় সূত্রের খবর, বণিক পরিবারের বাজির ব্যবসা দীর্ঘ দিনের। পঞ্চায়েত ছাড়াএ একাধিক বার জেলা শাসককের দফতরে বাজি তৈরি, মজুত ইত্যাদির লাইসেন্সের জন্য জন্য আবেদন করেছিলেন চন্দ্রকান্ত। কিন্তু পুলিশের তরফে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া মেলায় লাইসেন্স পাননি চন্দ্রকান্ত। তার পর পঞ্চায়েত থেকে মেলা লাইসেন্স দিয়ে বাজি মজুতের সঙ্গে সঙ্গে বাজি তৈরিও করতেন তাঁরা। এলাকাবাসীদের দাবি, প্রশাসন আগেভাগে ব্যবস্থা নিলে এই দুর্ঘটনা হয়তো এড়ানো যেত।

বস্তুত, ২০২৩ সালে পূর্ব মেদিনীপুরের এগরার খাদিকুলে অবৈধ বাজি কারখানায় বিস্ফোরণে প্রাণ যায় ১১ জনের। ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট এলাকায় গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানে তিনি বলেছিলেন, ওই ঘটনা তাঁর চোখ খুলে দিয়েছে। মুখ্যসচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠনের কথা বলেছিলেন। দু’ মাসের মধ্যে তার রিপোর্ট তৈরি করতে বলেন। সেই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘‘আমরা বাজির ক্লাস্টার তৈরি করব।” পাশাপাশি তিনি বলেছিলেন, ‘‘এলাকায় কোনও রকম বেআইনি বাজি কারখানার খবর কানে এলে তা যেন থানায় জানানো হয়। ওসিকে জানান। তিনি যদি ব্যবস্থা না নেন আমাকে জানান। আমি প্রয়োজনে ওসিকে সরিয়ে দেব।’’

কিন্তু তার পরেও রাজ্যে একাধিক বাজি বিপর্যয় দেখা গিয়েছে। এ নিয়ে সুপ্রতিম জোর দিয়েছেন সাধারণ মানুষের দায়িত্বজ্ঞানের উপরে। তাঁর কথায়, ‘‘নিজেদের মধ্যে তো একটা বোধ থাকতে হবে। আমি দাহ্য পদার্থ রাখব, সেখানে শিশুদের নিয়ে থাকব, সেখানেই গ্যাস সিলিন্ডার রেখে রান্না করব— এই ক্ষেত্রে বাড়ি বাড়ি গিয়ে সচেতন করাটা পুলিশের পক্ষে একটু কঠিন। তবু আমরা চেষ্টা করি। সামগ্রিক ভাবে আমরা সকলকেই সচেতন থাকার কথা বলি। জোর করে সচেতন করা যায় না। আইন দিয়েও হয় না। তার জন্য আমরা শুধু আবেদন করতে পারি।’’

অন্য দিকে, মঙ্গলবার বিকেলে তিন সদস্যের ফরেন্সিক দল যায় পাথরপ্রতিমা দক্ষিণ রায়পুরের তিন নম্বর ঘেরি এলাকায়। বিস্ফোরণস্থল পরিদর্শন করে বেশ কিছু নমুনা সংগ্রহ করেছেন ফরেন্সিক বিশেষজ্ঞেরা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.