কলকাতা থেকে অতীতের অনেক কিছুই হারিয়ে গিয়েছে। সেগুলোর গল্পকথা রয়ে গিয়েছে সংশ্লিষ্ট নানা বই এবং ঐতিহ্যপ্রেমীদের চর্চায়। আপনারা কি জানেন, পায়ে পায়ে স্মরণীয় একটা ঘটনার ৩০০ বছর কেটে গেল?
বলছিলাম গোবিন্দরাম মিত্র প্রতিষ্ঠিত বিখ্যাত সেই মন্দিরের কথা। মন্দির কমপ্লেক্স তৈরির কাজ শুরু হয় ৩০০ বছর আগে, ১৭২৫ সালের দিকে। ১৭৩০-৩১ সালে শেষ হয়। গোবিন্দরাম মিত্রকে সে যুগে লোকে বলত ‘ব্ল্যাক জমিনদার’। অসম্ভব দাপুটে ওই জমিদার দুর্নীতিপরায়ণও ছিলেন। তিনি চিৎপুর রোডের উপরেই প্রতিষ্ঠা করেন ওই বিশাল পঞ্চরত্ন মন্দির ও তাকে ঘিরে তিনটি দো’চালা ও দু’টি নবরত্ন মন্দির-সহ এক ‘মন্দির কমপ্লেক্স’।
একসময় শহরের সবচেয়ে উঁচু ভবন ছিল। একই দিনে ভূমিকম্প এবং ঘূর্ণিঝড়ের হাত থেকে একবার বেঁচে গিয়েছিল! প্রতিষ্ঠার মাত্র সাত বছরের মধ্যে ১৭৩৭-এর ঝড়ে ভেঙে পড়ে মন্দিরের চূড়া। আরও পরে আস্তে আস্তে পুরো মন্দিরটিই ভেঙে যায়। মন্দিরের সর্বোচ্চ বুরুজটি মূলত ১৬৫ ফুট অর্থাৎ অক্টেরলনি স্মৃতিস্তম্ভ (শহীদ মিনার) (১৫৭ ফুট) থেকেও উঁচু ছিল।
মন্দিরের চূড়া দূর থেকে দেখা যেত। সে সময় জলপথই ছিল যাতায়তের প্রধান মাধ্যম। নাবিকদের জন্য ছিল নৌযান সহায়ক, তাই তারা এটিকে ‘প্যাগোডা’ বলত। এক কৃষ্ণাঙ্গ (স্থানীয়) জমিদার তৈরি করেছিলেন বলে নাবিকরা বলত ব্ল্যাক প্যাগোডা। পুরনো কলকাতার কয়েকটি ছবিতে গোবিন্দরাম মিত্রের ওই প্যাগোডার উল্লেখ রয়েছে। টমাস (মতান্তরে থমাস) ড্যানিয়েলের চিত্রকর্ম ‘জেন্টু প্যাগোডা অ্যান্ড হাউস’ (১৭৮৭) অনেকেই দেখেছেন। চার্লস ড’য়লি, টমাস প্রিন্সেপ প্রমুখ শিল্পীদের আঁকা ছবি দেখলে মন্দিরের আসল চেহারা কেমন ছিল সে সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মায়।

পরবর্তীকালে নানা সময়ে সংস্কার করা হয়েছে মন্দিরের। পুরানো ত্রিভুজাকার চূড়াগুলি নতুন ত্রিভুজাকার চূড়া দিয়ে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। বিপরীতে সিদ্ধেশ্বরী মন্দির। এই মন্দির নিয়েও কত কথা!
সেই সাবেক নবরত্ন মন্দিরের টিকে থাকা অংশের ছবিটা এখন কিরকম? মন্দিরে প্রবেশপথের স্তম্ভের গায়ে গোবিন্দরাম মিত্রর মন্দিরের গোলাকার ‘ব্লু প্লাক’। তাতে লেখা ‘গ্রেড ওয়ান হেরিটেজ’। ঢুকেই সামনে বড় ঘরে দেওয়ালে পাশাপাশি তিনটি কাচের খোপে সুন্দর বিগ্রহ। পাশের দুটি ঘরে আছে বেশ বড় মাপের একাধিক শিবলিঙ্গ। সকাল থেকেই আসেন ভক্তরা। পুজো দেন। অন্যনান্য মন্দিরের মতো এটিও দুপুরে বন্ধ থাকে।
উল্টোদিকে মদনমোহনতলা, গোবিন্দরাম মিত্রর রূপকথা-সম সেই পেল্লাই ভবন। পড়ে আছে একরাশ নৈঃশব্দ আর অতীতের নানা কাহিনী জড়িয়ে। এটির মন্দিরটিও বন্ধ থাকে দুপুরে। সকাল/সন্ধ্যায় খোলা থাকে। সব দেখতে সময় লাগবে।
আরও বেশি করে পুরনো কলকাতার প্রাণের স্পন্দন পেতে বড় রাস্তা ধরে উত্তরে আরও একটু এগিয়ে বাঁ দিকে কুমোরটুলি স্ট্রিট ধরলে দুপাশে দেখবেন একাধিক মন্দির। হাঁটাপথেই সেই দেবী ঢাকেশ্বরী মন্দির। ভারত ভাগের উত্তাল সময়কালে ঢাকায় যখন হিন্দুদের ওপর প্রবল আক্রমণ চলছিল, ১৯৪৮-এ সেখান থেকে সযত্নে, সন্তর্পনে এপার বাংলায় নিয়ে আসা হয়েছিল দেবীকে। পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন এখানে। এই মন্দির বন্ধ থাকে বেলা সাড়ে ১২টা থেকে ৪ টে পর্যন্ত। ক’দিন আগে ফেসবুকে লিখেছি সচিত্র ওই মন্দিরের কথা।
পুরির মন্দির, অযোধ্যার মন্দির নিয়ে কত কোটি কথা প্রচারমাধ্যম লিখেছে, ৩০০ বছর আগে যে বিশালাকার মন্দির তৈরির কাজ শুরু হয়েছিল এই কলকাতায়, আজ তা বুঝি হারিয়ে গিয়েছে অতীতের গর্ভে।
অশোক সেনগুপ্ত


