[ঝাড়গ্রাম জুড়ে রকমারি বাঁশের বাগান। ভালকো, বাঁশনি, কাঁটা, তল্লা, বড় তল্লা, লাঠি, সোনালি, জবা ও মুলিবাঁশ। বাঁশ বিষয়ক নানান বচন ও লোকজ্ঞান প্রচলিত আছে এই জেলার গ্রামে গ্রামে। ফাল্গুন মাসে শুকনো ঝরাপাতায় আগুন ধরিয়ে যে ছাই উৎপন্ন হয়, চৈত্রমাসে তারই উপরে মাটি ফেললে বাঁশঝাড়ের বিস্তার ঘটে সহজে। জেলার অন্যতম অর্থকরী ফসল বাঁশ। ‘বাঁশ বাড়লেই সর্বনাশ’ এমন প্রবাদের পাশাপাশি লৌকিক গৃহনির্মাণ বিধিতে পুবে পুকুর আর পশ্চিমে বাঁশঝাড় রাখা জনপ্রিয় অভ্যাস।]
গত জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারী মাসে পশ্চিমবঙ্গের ঝাড়গ্রাম জেলার বাঁধগোড়া পঞ্চায়েতে গোরগ্রামে কয়েকজন ছাত্র ও শিক্ষকের উপস্থিতিতে কৃষি ও গ্রাম সমীক্ষা করতে যাই। তারই ফাঁকে খেয়াল করি, সেই পঞ্চায়েত এলাকায় বাঁশের নানান বৈচিত্র্য। বহু গৃহেই একটি বাঁশঝাড় লক্ষ্য করা গেছে, বাঁশের বহুল ব্যবহারও। বাঁশবাগানের দৌলতে এবং বিপণনের মাধ্যমে বহুচাষী অতিরিক্ত পয়সা উপার্জন করে থাকেন। গ্রামে বাঁশচাষ সংক্রান্ত লৌকিক জ্ঞানের ভাণ্ডারও পর্যাপ্ত। আমাদের নজর এড়ায়নি বাঁশ কেন্দ্রিক কৃষি এবং লোকসংস্কৃতি। গরুর প্রসবের পর দ্রুত ফুল ফেলতে ভালকো বাঁশের পাতা খেতে দেওয়া হয়। এ সব নিয়েই প্রস্তুত আলোচনা।
গ্রাম বাংলার একটি পরিচিত কৃত্য হল বাঁশ বাগানের মেঝেতে ফাগুনমাসের সন্ধ্যায় অগ্নিসংযোগ। শীতকাল থেকেই বাঁশঝাড়ের তলায় পুরু হয়ে থাকে পাতার রাশি। বাঁশবাগানে হাঁটলে পা দেবে যায়। বড়রা বলেন, “ওদিকে যাস নে, চন্দ্রবোড়া সাপ থাকে।” বাঁশঝাড় পিট-ভাইপারের পছন্দের আস্তানা। গ্রামের ছেলের দল কিন্তু বাঁশবাগানে খেলে বেড়ায়। প্রতি বছর ফাগুনে আগুন জ্বালানোর বন্দোবস্ত করে সাপের চিরস্থায়ী বাসা ভাঙা হয়। বসন্ত ঋতুতে গ্রামাঞ্চলে সন্ধ্যা নামলেই দাউদাউ জ্বলে ওঠে এক একটি বাঁশবাগান। গাঁয়ের মানুষ বলেন, বাঁশঝাড়ে পটাশ সারের চাহিদা নাকি এতে মেটে! বাঁশ পটাশ-প্রিয় গাছ। অযত্নে লালিত ঝাড়ে পটাশের সেই চাহিদা মেটাবে কে? ওই ইকোসিস্টেমে বর্ষাকালে পাতাপচে আপনা থেকেই সার হয়। আর বসন্তে পাতা পুড়িয়ে দিলে সারের যোগান বাড়ে। পাতা পুড়ে গাছের তলায় কালো হয়ে পড়ে থাকে ছাই, তা কোদালে কাচিয়ে ঝাড়ের গোড়ার পানে টেনে আনা হয়, এঁদো পুকুরের কালো পাঁকমাটি কোদালে কেটে, ঝুঁড়িতে বয়ে এনে ঝাড়ের গোড়া ঢেকে দিতে হয়। এক কোদাল, দুই কোদাল মাটি তুলে দেওয়া হয় ছাইয়ের উপরে, বাঁশের গেঁড়োর গোঁড়ায়। দেখতে দেখতে তাগড়াই হয়ে ওঠে বর্ষার জলে। খনার বচনে এভাবেই বাঁশঝাড় পরিচর্যার কথা আছে। এটা বাগানীদের দীর্ঘদিনের লোকজ্ঞান। পরিপাটিতে আসন্ন বর্ষায় আসে বাঁশের নব কোঁড়ক। সারমাটি পেলে সেদিক পানেই ঝাড় হেঁটে যায় অর্থাৎ ঝাড় চলমান হয়। “ফাগুনে আগুন চৈতে মাটি/ তবেই বাঁশের পরিপাটি/ যেদিকে মাটি সেদিকে হাঁটি।” এটাই বাঁশঝাড়ের স্বভাব, পটাশ সমৃদ্ধ সারমাটি পেলে সেইদিকেই ধেয়ে চলে বাঁশের মৃদগত কাণ্ডের চলন। কোথাও প্রবাদে আরও বলা হয়েছে, “ফাগুনে আগুন চৈতে মাটি/বাঁশ বলে শীঘ্র উঠি/বাঁশ ছেড়ে বাশের পিতা’ম কাটি।” অর্থাৎ ছাই ও সারমাটি পেলে বাঁশ তাড়াতাড়ি বড়সড় হয়। একসনী বা দুইসনী বাঁশ না কেটে তিন বা চারসনী বাঁশ কাটাই উপযুক্ত। এই তিন বা চারসনী বাঁশকে পিতা’ম বাঁশ বা পিতামহ বাঁশ বলা হয়। অবশ্য অধিক পাকা, শুকনো এবং হলদে-বাদামী হয়ে ওঠা বাঁশ ব্যবহারের উপযুক্ত নয়। তাই আর একটি প্রবাদে পাই, “পাকলে না নোয়াইলে বাঁশ/ বাঁশ করে ট্যাঁশট্যাঁশ।” গ্রামবাসীরা বলেছেন চারা হিসাবে বর্ষায় লাগানো হয় উপযুক্ত পর্ব (গাঁট) এবং পর্বমধ্য (ফাঁপ) যুক্ত একসনী বাঁশের কাটিং, যেখানে পর্ব থেকে বেরিয়ে এসেছে চোখ ও বায়বমূল। এরই নাম বাঁশের নাতি। একটি প্রবাদে পাচ্ছি, “বাঁশের নাতি, কলার পো/ বছর বছর তুলে রো।”
ভালুকা, ভালকি বা ভালকো বাঁশ ঝাড়গ্রামের সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রজাতি। এর বিজ্ঞানসম্মত নাম Bambusa balcooa Roxb. বাঁশটি পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঝাড়খণ্ড ও অসম রাজ্যে জন্মাতে দেখা যায়। বাঁশঝাড় বেশ বড়, লম্বা, শক্ত, সোজা এবং ঘনঝাড় সমন্বিত। এর তৃণকাণ্ড বা বাঁশডাটা (Culms) গুলি লম্বায় ৫৫ থেকে ৭০ ফুট, প্রস্থচ্ছেদের ব্যাস ৩.৪ থেকে ৬.৭ ইঞ্চি, রং বাদামী সবুজ, অমসৃণ এবং ফাঁপের গায়ে সাদা-বাদামি রঙের কুড়োর উপস্থিতি রয়েছে। ভালকো বাঁশের গোড়ার গাঁটে থাকে সাদা শেকড়, বাঁশ পরিপক্ব হবার সঙ্গে সঙ্গে তা কালচে বর্ণ ধারণ করে। বাঁশের গাঁট থেকে মাঝের বড় কঞ্চি সহ বের হয় তিনটি কঞ্চি। গোড়া থেকে বেরোনো বাঁকা কাঁটার মতো কঞ্চিতে পাতা বের হয় না। ভালকো বাঁশের কোঁড়গুলি দেখতে প্রথমাবস্থায় কালচে সবুজ, পরে হলদেটে। এই বাঁশের পাতা ফলার মতো, আর থাকে ধারালো রোঁয়া।
ভালকো বাঁশ কাটার পর সিজন বা মরশুমিকরণ করে নিলে সহজে ঘুণ ধরে না। অমাবস্যার আগে পরে মিলিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে তিন-চারসনী পুষ্ট বাঁশ কেটে নিতে হবে। তারপর নদী, জলাশয়ে ডুবিয়ে রাখতে হবে বেশ কিছুদিন। তারপর একটা পচনশীল গন্ধ বের হলে এবং বাঁশের পুরু অংশ সাদা থেকে কালো রং হয়ে উঠলে তা পোক্ত হয়েছে ধরে নেওয়া হয়। ভালকি বাঁশে গরুর গাড়ি, খড়ের ঘরের খুঁটির মতো শক্তপোক্ত জিনিস তৈরি করা চলে। বাঁশের ভিতরটি বেশ পুরু। ভেতরের ফাঁকটি সরু। ভালকি বাঁশ যথেষ্ট পুরু। খুব শক্তপোক্ত এই বাঁশ।
কাঁটাবাঁশ বা Bambusa bambos (L.) Voss. ঝাড়গ্রামে খুবই সহজলভ্য। একে Giant Thorny Bamboo অথবা Spiny Bamboo বলা হয়। এই বাঁশে প্রচুর সংখ্যায় কঞ্চি নির্গত হয়, গোড়া থেকে আগা পর্যন্ত প্রতিটি গাঁটেই কঞ্চি আসে। কঞ্চির আধিক্যে ঝাড় খুবই ঘন হয়, কঞ্চি ছড়ানো এবং নিম্নমুখী বাঁকানো৷ কঞ্চির গাঁটে গাঁটে তিনটি কাঁটা ঝাড় অনেকটা উঁচুও হয়ে থাকে, তবে ভালকো বাঁশের মতো বড় হয় না৷ বাঁশের গোড়া মোটা, তাতে শেকড় দেখতে পাওয়া যায়। ঝাড়ের একপাশে দাঁড়ালে অন্যপাশ থেকে দৃশ্যমান হয় না। বহু ছোটোখাটো বন্যজন্তু যেমন বন বেড়াল, শিয়াল, বেজি, গেছো ইঁদুর, নানান পাখির স্বাভাবিক ও নিরাপদ আবাস এই ঘন ঝাড়। কাঁটাবাশ সোজাই বেড়ে ওঠে, বেশ শক্তপোক্ত। এই বাঁশের তৃণকাণ্ড মসৃণ হয়, রং ফিকে সবুজ। এই বাঁশের কোঁড়গুলি কালচে বেগুনি ও কোণাকৃতি হয়৷ কাঁটাবাঁশের ঝাড় গ্রামাঞ্চলে জলাশয়ের ধারে, পতিত জমিতে, পথের ধারে যথেষ্ট সংখ্যায় জন্মাতে দেখা যায়৷ এই বাঁশ লাগানো থাকলে ভূমিক্ষয় রোধ করা যায়।
মাঝারি লম্বা ও শক্ত ফাঁকা ঝাড়ের তল্লাবাঁশ ঝাড়গ্রামে যথেষ্ট সংখ্যায় দৃশ্য। বিজ্ঞানসম্মত নাম Bambusa tulda Roxb.; অন্য যে নামে একে ডাকা হয় তা হল তরল, মোহাল তরল বা বন বাঁশ। একে জবা বাঁশও বলা হয়। লএই বাঁশ স্বভাবে চিরহরিৎ, কখনও পর্ণমোচী এবং যূথবদ্ধ, সবুজ বা ধূসর-সবুজ এর তৃণকাণ্ড, যার উচ্চতা ২০ থেকে ৭০ ফুট এবং ২.২-৪.৪ ইঞ্চি ব্যাস। মাদুর ও ঝুড়ি তৈরির কাজে এই বাঁশ ব্যবহৃত হয়, এর কচি বিটপ খাওয়া হয়, আচারও তৈরি করা হয়।
ঝাড়গ্রামে আরও যে বাঁশ জন্মায় তা হচ্ছে দাঁড়াশ সাপের মতো গড়নের বাঁশনী বাঁশ ( Bambusa vulgaris Schrad. ex Wendl.), যাকে বাইজ্যা বাঁশও বলা হয়, যার পাকা বাঁশ বর্ণে হলদেটে, কাঁচা অবস্থায় সবুজ, গা তেল চকচকে ও মসৃণ। সোনালি বাঁশ বা Golden Bamboo নামে আর একটি চমৎকার সোনালি বর্ণের বড়, সোজা, শক্ত গড়নের এবং ঘন ঝাড় সৃষ্টিকারী বাঁশ দেখতে পাওয়া যায়, যার কোনো কোনো ফাঁপের গায়ে লম্বা সরু দাগ থাকে, যার কোঁড় হলদে রঙের। রঙের কারণে সোনালি বাঁশের চাহিদা দেখতে পাওয়া যায় বড় বড় আবাসনে কিংবা হোটেল বা সরকারি প্রতিষ্ঠানের ফাঁকা জায়গায়। সোনালি বাঁশের বিজ্ঞানসম্মত নাম Bambusa vulgaris Schrad. ex Wendl. var stricta. সোনালি বাঁশের কাছাকাছি চিত্রা বাঁশ বা হলুদ চিত্রা বাঁশ নামে আর একটি বাঁশের নান্দনিক বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মতো, যার বিজ্ঞানসম্মত নাম Bambusa vulgaris
Schrad. ex Wendl. var variegata .
লাঠি বাঁশ নামে হেলে থাকা, শক্তপোক্ত গড়নের, ঘন ঝাড়ের বাঁশ দেখতে পাওয়া যায়, যার বিজ্ঞানসম্মত নাম Dendrocalamus strictus (Roxb.) Nees, যার গোড়ায় কঞ্চি থাকে না, আর বাঁশের গায়ে যেন সাদা গুড়ো ছড়ানো। এছাড়া পাওয়া যায় বড় তল্লা বাঁশ ( Bambusa polymorpha Munro), যাকে বেটুয়া বা জামা বাঁশ বলা হয়; যে বাঁশ বড়সড়, ২০ থেকে ২৭ মিটার লম্বা। আর রয়েছে মুলিবাঁশ ( Melocanna baccifera )।
ঝাড়গ্রামের বাঁশ মূলত বর্ষাকালে কাটা হয়। বাঁশের বয়স ২/৩ বছর হলে, তা কাটার উপযুক্ত হয়। বর্তমানে পাইকারি রেটে প্রতিটি ভালকি বাঁশের দাম ১২০ থেকে ১৫০ টাকা, জবা বাঁশের দাম ৮০ টাকা, কাঁটাবাঁশ ৭০-৮০ টাকা, সরু তরল বাঁশ ৪০-৫০ টাকা, মোটা তরল ৮০-১০০ টাকা, বাঁশলি ৮০-১০০ টাকা। একটি ঝাড়ে গড়ে ২০০ টি বাঁশ জন্মায়, যার মধ্যে বছরে ৫০-৬০ টি কাটার যোগ্য হয়। প্রতি বছর এপ্রিল-মে মাসে ৫ কেজি ১০-২৬-২৬ মিশ্রসার, ২ কেজি ইউরিয়া দিয়ে খড় ও মাটি চাপা দেওয়া হয়, তাতে খরচা পরে ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা। আর ২ জন শ্রমিকের মজুরি ধরে ঝাড় পিছু প্রতি বছর মোট খরচ হয় হাজার টাকা। প্রতি বছর ৫০-৬০ টা বাঁশ বিক্রি হয় গড়ে ১০০ টাকায়। অতএব ঝাড় পিছু পাঁচ-ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত বার্ষিক আয় পাওয়া যায়। খরচ বাদ দিয়ে প্রতি বছর প্রায় চার-পাঁচ হাজার টাকা ঝাড় পিছু লাভ থাকে।
তথ্যসূত্র:
১. দুলাল চন্দ্র পাল (২০১০), বাংলার ঘাস ও বাঁশ, পশ্চিমবঙ্গ জীববৈচিত্র্য পর্ষদ।
২. The wealth of India Vol I (A-B) pp: 145-154.
৩. মনাঞ্জলি বন্দ্যোপাধ্যায় (১৪১৯), বাঁশ ও লোকসংস্কৃতি, বিশ্বকোষ পরিষদ পত্রিকা, ৪(৫): ৮৬-৯১
৪. বাংলাপিডিয়া, বাংলা একাডেমি, বাংলাদেশ
৫. The Bamboos, edited by G. P. Chapman, 1997. The Linnean Society of London,
সুদীপ মণ্ডল এবং ড. কল্যাণ চক্রবর্তী
