বঞ্চনা আর শোষণের প্রতিবাদে শহরে নারী ও প্রান্তিক যৌনতার মানুষের মিছিল, কী দাবি তাঁদের?

‘চলবে না আর জারিজুরি, মেয়েদের দাও ঠিক মজুরি’— নারী দিবসের প্রাক্কালে গর্জে উঠল মধ্য কলকাতা। মেহনতি মহিলা এবং প্রান্তিক যৌনতা ও লিঙ্গের মানুষের বঞ্চনা নিয়ে সরব হলেন গ্রাম থেকে শহর, শহরতলি থেকে মফস্‌সলের প্রমীলা ও ক্যুইয়ার পরিচয়বাহী মানুষেরা। দাবি অনেক— ন্যায্য মজুরি, কর্মক্ষেত্রে নিরাপত্তা, শৌচাগার, ক্রেশ। তার সঙ্গে যুক্ত হল যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদও।

নারী দিবস উদ্‌যাপন মঞ্চের ডাকে পদযাত্রায় যোগ দিয়েছিল একাধিক সংগঠন।

সপ্তাহ পেরোলেই আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস। ১৮৫৭ সালে ৮ মার্চ নিউ ইয়র্কের রাস্তায় সুতো কারখানার মহিলা শ্রমিকদের রক্তঝরা প্রতিবাদ থেকেই জন্ম নেয় বিশেষ দিনটি। তাই এই দিন আসলে শ্রমজীবী নারীদের। আর সেই কথা মাথায় রেখেই শনিবার, ১ মার্চ দু’হাজারেরও বেশি নারী জড়ো হয়েছিলেন কলকাতা শহরের রামলীলা ময়দান। নারী দিবস উদ্‌যাপন মঞ্চের ডাকে পদযাত্রায় যোগ দিয়েছিল একাধিক সংগঠন। পশ্চিমবঙ্গের নারী অধিকার সংগঠন, শ্রমিক সংগঠন, ট্রান্স-ক্যুইয়র সংগঠন এবং নাগরিক অধিকার সংগঠন এই উদ্যোগে অংশ নিয়েছে। রানি রাসমণি অ্যাভিনিউতে শেষ হয় সেই যাত্রা। একাধিক জেলা থেকে দলে দলে মেয়েরা যোগ দিয়েছেন এই মিছিলে। ভোর ৪টেয় ট্রেন ধরে কলকাতায় এসে মিছিলে হেঁটে বাড়ি ফিরবেন কেউ কেউ। গোটা মিছিলে একাকার হয়ে গিয়েছিল ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণির বিভাজনরেখা। ব্যানার হাতে প্রায় আড়াই কিমি পথ হাঁটতে হাঁটতে নিজেদের দাবি কণ্ঠে তুলে এনেছেন অংশগ্রহণকারীরা।

অঞ্জলি মানসিক স্বাস্থ্য অধিকার সংগঠনের কর্ণধার রত্নাবলী রায়ের কথায়, “নারী দিবস উদ্‌যাপন মঞ্চের পক্ষ থেকে আমরা চেয়েছি, নারী নিপীড়নের বিরোধিতার অধিকারের সঙ্গে নারী শ্রমিকের অধিকার প্রশ্নটা যাতে সংলাপে থাকে, তা নিশ্চিত করতে। ন্যায্য মজুরি, সম কাজে সম বেতন, সন্তানদের জন্য ক্রেশ, অবসরকালীন সুবিধে, মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা, এই দাবিগুলোর মীমাংসা ঘটলে নারী তার শ্রমশক্তির উপযুক্ত মূল্য পেলে, নারী অত্যাচারের অন্য সমস্যাগুলোও খানিক কমা সম্ভব। কারণ নারী বলেই তার উপর ক্ষমতার আস্ফালন দেখানো যায়, কর্তৃত্ব ফলানো যায়— এই ধরনের ভুল ভাবনাগুলোকে কিছুটা প্রতিহত করা সম্ভব হবে।”

১০০ দিনের কাজ বন্ধ। পরিযায়ী শ্রমিকেরা বাড়ি ফিরে আসায়, খেতে চাষ করার লোকের অভাব নেই, ফলে নানা কারণে মেয়েদের হাতে কাজ নেই। জেলায় জেলায় এক চেহারা। উত্তর ২৪ পরগনার একাধিক জায়গার অসংগঠিত মহিলা শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করেন প্রতিকার ওয়েলফেয়ার সোসাইটির কর্ণধার, সমাজকর্মী তহমিনা মণ্ডল। নিজে এক জন শ্রমিক। ৫০০-১০০০ জন মহিলাকে একজোট করেছেন তিনি। তাঁদের অধিকারের লড়াইয়ে পাশে রয়েছেন তহমিনা। আনন্দবাজার অনলাইনকে তিনি বললেন, “খেতে না পাওয়ার কষ্ট কী, তা আমরা জানি। আমি এবং আমার সঙ্গে যাঁরা আছেন, তাঁরা ভীষণ পিছিয়ে পড়া শ্রেণির। বিড়ি শ্রমিকদের সঙ্গে কাজ করি আমি। ২৭৮ টাকা মজুরি পাওয়ার কথা মহিলাদের। সেখানে দরদাম করে ১৭৫ টাকা পাই আমরা দিনে। অনেকে মিলে ১০০ দিনের কাজ করতাম। দু’বছর হল, সেই কাজও বন্ধ। পটল চাষের শ্রমিকদের গত বছর মজুরি ছিল দিনে ৬০ টাকা। এখন সেটা মাসে ৫০০ টাকা। ভোর থেকে একনাগাড়ে খাটাখাটনি! তাতে এইটুকু টাকায় চলে? কোথাও কোনও শৌচাগার নেই। থাকলেও প্রতি বার ৫ টাকা করে দিলে, তবে ব্যবহার করতে দেয়। চিকিৎসার ক্ষেত্রেও এক অবস্থা। আমরা ওষুধ কিনতে পারি না। অসুস্থ হলে ভয় হয়। টাকা কই? আর এখন সরকারি সমস্ত প্রকল্পের আবেদন করতে হয় অনলাইনে। না আমরা ডিজিটাল কাজকর্ম বুঝি, না বুঝি ইংরেজি। তাই সেখানেও কারও সাহায্য নিতে হয়। তাতেও ২০০-২৫০ টাকা করে খরচ হয়ে যায়। উপরন্তু গুটি কতক মানুষ সেই সব প্রকল্পের সুবিধা পায়।”

আজাদ ফাউন্ডেশনের দোলন গঙ্গোপাধ্যায় জানান, গত এক বছর বিভিন্ন পেশার মহিলা ও প্রান্তিক যৌনতা ও লিঙ্গের মানুষের সঙ্গে কথা বলেছেন তাঁরা৷ তাঁদের অসুবিধা শুনে একজোট করে প্রকাশ্যে আনতে চাইছে বিভিন্ন সমাজসেবী সংস্থা। সরকার, সাধারণ মানুষ এবং বিভিন্ন সংস্থার মালিক পক্ষের কাছে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই এই উদ্যোগ।

মুক্তি রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারের প্রতিষ্ঠাতা বিদিশা ঘোষ বিশ্বাস বললেন, “আমাদের আজকের এই পথ হাঁটাটা ভবিষ্যতে পরিপূর্ণতা পাক, সফল হোক, এই আশাই করি। গ্রাম এবং শহরকে এক করতে গেলে আরও অনেক বেশি আলোচনার প্রয়োজন। স্কুলে, কলেজে মেয়েদের নিজেদের অধিকার বোঝানোর দরকার। শ্রেণি ভেঙে বেরিয়ে আসার জন্য আরও বেশি যোগাযোগ তৈরি করতে হবে।”

কর্মক্ষেত্রে নারী ও ক্যুইয়ারদের সম্মানের অধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষার অধিকারের প্রসঙ্গ ওঠা অবধারিত।

কর্মক্ষেত্রে নারী ও ক্যুইয়ারদের সম্মানের অধিকার নিয়ে কথা বলতে গেলে মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষার অধিকারের প্রসঙ্গ ওঠা অবধারিত। সেই উদ্দেশ্য নিয়েই ‘মননসয়ী’ সংস্থার মেয়েরাও এই মিছিলে হেঁটে সকলের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। সাপোর্ট গ্রুপে সবাইকে আহ্বান জানিয়েছেন তাঁরা। কর্মক্ষেত্রে কোনও সমস্যার সম্মুখীন হলে, তাঁরাও নিজেদের মতো সমাধানের চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন।

শারীরিক ও মানসিক হেনস্থা, বেতনে বিভাজন, নিরাপত্তাহীনতা— এই সব কিছুর বিরুদ্ধে জোর গলায় যাতে সকলে নারী দিবসে তাঁদের অন্তরের কথা বলতে পারেন, তার জন্যই এই উদ্যোগ। স্লোগান ও ঢাকের গর্জন তুলে বারে বারে পথে নামুন নারী ও প্রান্তিক যৌনতা ও লিঙ্গের মানুষেরা, এমনই বক্তব্য মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.